
আবুল কাসেম ফজলুল হক যে গণতন্ত্র চিন্তা ও চর্চার কথা বলেছেন তা অনেক গভীর ও ব্যাপক। তাঁর চিন্তা দেশ থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে জাতি, জাতি থেকে জাতিরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষের আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক আবহে দেশ ভিত্তিক ঐক্যবোধ বা ঐক্যচেতনা গড়ে উঠে। এই ঐক্যচেতনাকেই জাতীয়তাবোধ বা জাতীয় চেতনা বলা হয়। জাতীয়তাবোধ সম্পন্ন জনগোষ্ঠীই জাতি। আবার এই জাতিই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতি রাষ্ট্র গঠন করে। সুতরাং দেশ ও রাষ্ট্র এক নয়।
তিনি দেখিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত জীবনধারার প্রয়োজনে রাষ্ট্র গঠন করতে হয়েছে। সুতরাং প্রতিটি দেশের নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক সীমানার রূপ ও প্রকৃতি হয় ভিন্ন ভিন্ন। রাষ্ট্রের অন্তর্গত জণগণের মধ্যেও নানা বিরোধ থাকে, বাহির থেকেও বিরোধিতা আসে। অন্তর্গত ও বহিরাগত বিরোধকে প্রতিহত করেই রাষ্ট্রকে টিকে থাকতে হয়।
এই যে একটি দেশ জাতি, জাতি থেকে রাষ্ট্র গঠন এর উদ্দেশ্যে হলো দেশের মানুষ যেন স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক মানবিক অধিকার পায়।এর মধ্যে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অর্থাৎ এর জন্য দরকার জণগণের সরকার। জণগণের সরকারই Government of the people by the people for the people গঠন করতে পারবে। গণতন্ত্রের এই ধারনার আগেও রাষ্ট্রের মধ্যে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, ব্রাক্ষণ্যতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জমিদারতন্ত্র ছিল। কিন্তু ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সূচনাকাল থেকেই আধুনিক গণতন্ত্রের ধারনা বিকশিত হয় এবং আঠারো,ঊনিশ ও বিশ শতকের ঔপনিবেশিক যুগে গণতন্ত্রের ধারনা ইউরোপ থেকে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
গণতন্ত্র, যেহেতু সকল মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদা ও অধিকারের সাথে সম্পর্কিত সেহেতু প্রত্যেকটি জাতির গণতন্ত্রের ধারনা ও বিকাশের বৈশিষ্ট্যও স্বতন্ত্র। পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় গণতন্ত্র অনুশীলন নির্ভর। অনুশীলনের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয় ও প্রতিষ্ঠা পায়। আবার গণতন্ত্রের আদর্শও পরিবর্তনশীল। গণতন্ত্রের চিন্তা, কর্ম ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে এবং গ্রহণ বর্জন সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। মানবতাবাদের আদর্শ ই গণতন্ত্রের আদর্শ। এ সম্পর্কে আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন:
গণতন্ত্র একটি বিকাশমান মতাদর্শ । মানবতাবাদের আদর্শের উপরে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। মানবাতা বাদও বিকাশমান আদর্শ। আদর্শ সম্পর্কে এ কথাটা সব সময় মনে রাখতে হবে যে, আদর্শ বাস্তব নয়, বাস্তবের সাথে আদর্শের সব সময়েই পার্থক্য থাকে, যখন কোন আদর্শ বাস্তবায়িত হয়ে যায় তখন তা আর আদর্শ থাকেনা। তবে বিশেষ বিশেষ বাস্তব অবস্থার উপর ভিত্তি করেই মানুষ বিশেষ বিশেষ আদর্শ সৃষ্টি করে এবং কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন আদর্শকে পেছনে ফেলে নতুন আদর্শ সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যায়। আদর্শ হল তাই, যা বাস্তব নয়, অথচ যা বাস্তবায়িত করতে চায়, যার বাস্তবায়নে মানুষ পরম কল্যানের সম্ভাবনা উপলব্ধি করে। আদর্শের মধ্যে মানবজাতির মহত্তম সব আশা আকাঙক্ষার প্রতিফলন থাকে। মানবতাবাদ ও গনতন্ত্রকে এভাবেই বুঝতে হবে।
আশা আকাঙক্ষার সমর্থনে – পৃষ্ঠা নং: 4
আবুল কাসেম ফজলুল হকের গণতন্ত্র চিন্তা গতানুগাতিক গণতন্ত্র চিন্তার বিপরীত। তিনি গণতান্ত্রিক চিন্তাকে ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত করতে চেয়েছেন, ব্যক্তি থেকে সমষ্টির মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র চিন্তার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। কারণ, জাতীয়তাবাদ-ই জাতি রাষ্ট্র গড়ে তোলে। আরো গভীরভাবে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, জাতি রাষ্ট্র গড়ে তোলে জাতীয় সংস্কৃতি। আবার জাতীয় সংস্কৃতির মাধ্যমেই গঠিত হয় জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদদের মূলে থাকে জাতীয় সংস্কৃতি। তাঁর গণতান্ত্রিক চিন্তার গভীরতা ও প্রসারতা এখানেই যেটিকে সূত্রাকারে লিখলে দাঁড়ায় এমন: জাতীয় সংস্কৃতি>জাতীয়তাবাদ> জাতি রাষ্ট্র।
জাতিরাষ্ট্র |
জাতীয়তাবাদ |
জাতীয় সংস্কৃতি |
তিনি জাতিরাষ্ট্র গঠনে পরমতসহিষ্ণু গণতান্ত্রিক চেতনার রাজনৈতিক উত্তরণ প্রত্যাশা করেন। যুক্তি ও বিবেকের চর্চায় মানবিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। গ্রহণ-বর্জন ও সমন্বয়ের ধারায় গণতান্ত্রিক চিন্তা ও চর্চা তিনি করতে চান।
তিনি গণতন্ত্র চিন্তায় রাজনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। এজন্য তিনি রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সংকট ও সমাধানের সূত্র নির্ধারণের চেষ্টা করেন। বাংলাদেশে গত চার দশকের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, চিন্তার দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, শুধু তাই নয় জাতিকে নানাভাবে বিভক্তও করেছে। এ সম্পর্কে দীর্ঘ সমালোচনা তাঁর চিন্তায় উঠে এসেছে। বিশেষ পরিসর জুড়ে রয়েছে চার দশকের রাজনৈতিক সংঘাত। চার দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেতৃত্বের সংকট কীভাবে গণতন্ত্রের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার সুদীর্ঘ বিশ্লেষণ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের ও পরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে নিরপেক্ষ নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি নেতৃত্ব সংকটকে চিহ্নিত করেছেন। স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের দুর্বলতা ও সম্ভাবনার সূত্র নির্ণয় নির্দেশ করেছেন। এজন্য তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে তাজউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা কে তার আলোচনায় বার বার এনেছেন।
তিনি বিশ্বাস করেন, উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। প্রচলিত গণতন্ত্র দিয়ে সে আকাঙক্ষা পূরণ অসম্ভব বলেও তিনি মনে করেন। প্রচলিত গণতান্ত্রিক ধারণা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন ভোটাভোটি সর্বস্বতা। তাঁর মতে বর্তমান বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে ভোটাভোটিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়- যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি শর্তমাত্র। কিন্তু এই একটি শর্তকেই একমাত্র করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটাভোটি গণতন্ত্রের একটি শর্ত কিন্তু একমাত্র নয়। বর্তমানে তা একমাত্র হয়েছে।
তিনি মনে করেন, গণতান্ত্রিক চরিত্রের মানুষ ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। আজকের বাংলাদেশের গণতন্ত্রে মানুষের চেয়ে ধন-সম্পদের মূল্য বেশি। ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়িয়ে আধিপত্যবাদ ও প্রভূত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করাই রাজনৈতিক নেতৃত্বের চালিকাশক্তি। তাই তারাও গণতান্ত্রিক নয় তাদের দল ও নেতৃত্বও গণতান্ত্রিক নয়। জনগণের গণতন্ত্র এখানে অনুপস্থিত। জনগণের গণতন্ত্র জনগণের মতের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি আরোও বলেন:
জাতীয়বাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে জনগণের গণতন্ত্র আমার কাম্য এবং সমাজতন্ত্রকে সংশ্লেষিত করে সেবার তাগিত আমি অনুভব করি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের কর্তৃত্বে পরিচালিত বর্তমান বিশ্বায়ন বা এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার মতবাদকে আমি জাতির জন্য ক্ষতিকর মনে করি।
বাংলাদেশ কোন পথে, ভূমিকা অংশ
প্রচলিত গণতন্ত্রের এই ভোটাভুটি সর্বস্বতার তিনি তীব্র সমালোচনা করেছেন। চার দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতন্ত্রের অন্তরায়। তাই তিনি তার সমালোচনা করেছেন। নেতৃত্বের দায়বদ্ধতার দিক থেকে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের স্বরূপ কি ছিল তার বিশ্লেষণ তিনি করেছেন। দেশপ্রেম ও নৈতিক মূলবোধের অবক্ষয়কে তিনি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেছেন। এরই মধ্যে ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। তার বিশ্লেষণে দেখা যায় দূতাবাসমুখিতা ও রাজনীতিতে সক্রিয় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চিন্তা ও চর্চাকে পরনিরর্ভশীল করে ফেলেছে। বিশেষ করে বাইরের দিক থেকে আধিপত্যবাদ এবং ভিতরের দিক থেকে পরনির্ভর রাখতে রাজনীতিতে সক্রিয় বুদ্ধিজীবীরা ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
তাই দেখা যায় দেশপ্রেম ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চিন্তা ও চর্চা অবনমনমুখী। দেশের বর্তমান অবস্থায় তাঁর গণতন্ত্র চিন্তা সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে। তিনি রাজনীতির মধ্য দিয়ে যে গণতন্ত্র দেখছেন বা দেখেছেন তাও হতাশাব্যঞ্জক। বিংশ শতাব্দির শেষার্ধে যেটুকু প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র যাত্রা শুরু করেছিলো একবিংশ শতাব্দির তৃতীয় দশকে এসে তা অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। যে ভোটাভোটি সর্বস্বতাকে গণতন্ত্রের সার্বিক প্রতিফলনের অন্তরায় বলে আবুল কাসেম ফজলুল হক দাবী তুলেছিলেন এখন বর্তমান সংসদ ও রাষ্ট্রে তাও অতীত হয়ে যাচ্ছে। শুধু ভোট দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সুযোগ জনগণ পেয়েছিলেন এখন তাও নেই।
ভোটবিহীন ক্ষমতা দখল এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির হাতিয়ার। সংসদীয় ব্যবস্থায় নেই কোন জবাবদিহিতা। বিরোধি দলও নেই। সরকার এককভাবে কীভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিতে পারে? অথচ সরকারের পক্ষ থেকেই এটাকেই গণতন্ত্র বলা হচ্ছে। নিজের ইচ্ছা ও কর্মকে তারা গণতন্ত্রের নামে চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় গণতন্ত্র আরও জটিল রূপ ধারন করেছে। এ অবস্থায় জনগণের মনে গণতন্ত্রের অনুভুতিই বা কতটুকু অবশিষ্ট থাকে? গণতন্ত্রকামীর জন্য তা এখন ব্যপক চিন্তা, কর্ম ও অনুশীলন দাবী করে। তাই আজকের বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চিন্তা ও চর্চাকে পূর্বের চেয়ে আরোও বেশি সূক্ষ্ম ও জনমুখী কর্মপরিকল্পনা ও কর্মপরিসর নির্ধারণ করে এগিয়ে নিতে হবে।
গণতন্ত্রকামীরা আজকে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে নাকি গণতন্ত্রের জন্য অন্য শর্তগুলো প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করবে? এটি বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।