বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ-বিচারবাদ বা বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা বইটিতে গ্রন্থে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন মার্কসবাদী দর্শনের বিরোধীদের স্বরূপ উদঘাটন করেন। লেখেন ১৯০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসে। তিনি এই গ্রন্থে আরো দেখান যে দর্শন ও রাজনীতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ বর্তমান। গ্রন্থটি তাঁর মৌলিক দার্শনিক চিন্তার প্রকাশ হিসাবে সুপরিচিত। মার্কসবাদ ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বিকৃতির অপচেষ্টাকে লেনিন তাঁর এই গ্রন্থে আপোসহীনভাবে বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করেন। এই বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে তিনি বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিষ্কার ও তত্ত্বসমূহ সম্পর্কে এবং জ্ঞানের সমস্যায় তাঁর মতামত উপস্থাপিত করেন।
এই গ্রন্থটির পুরো নাম বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা: এক প্রতিক্রিয়াশীল দার্শনিক মত প্রসঙ্গে বিচারমূলক মন্তব্য (ইংরেজিতে: Materialism and Empirio-criticism: Critical Comments on a Reactionary Philosophy)। লেনিনের জীবদ্দশায় গ্রন্থটির দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়, প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে এবং দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে। ১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে প্রায় নয় মাস সময় নিয়ে লেনিন এই গ্রন্থ রচনা করেন। এই বইটি লেখার জন্য তাঁর প্রচুর গবেষণার প্রয়োজন হয়েছিলো। প্রধানত জেনেভা শহরের গ্রন্থাগারে লেনিন এই গবেষণার কাজ সমাধা করেন, যদিও আরো কিছু বই পড়াশোনার জন্য ১৯০৮ সালের মে মাসে তিনি কিছুদিন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কাজ করতে যান।[১]
১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতার পরবর্তী পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বুদ্ধিজীবিদের একাংশের মধ্যে নানা দার্শনিক বিভ্রান্তির প্রকাশ দেখা যায়। ম্যাক, অ্যাভানারিয়াস প্রমুখ চিন্তাবিদগণ ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ‘এ্যামপিরিও ক্রিটিসিজম’ নামক এক তত্ত্ব দাঁড় করান। রুশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে এই তত্ত্বের অনুসারীদের লেনিন ‘ম্যাকিসটস’ বলে আখ্যায়িত করেন। এই তত্ত্বের মূল বিভ্রান্তির দিক উন্মোচন করে তার যে বিশ্লেষণ লেনিন রচনা করেন তাঁর সেই রচনা ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এন্ড এমপিরিওক্রিটিসিজম’ নামে ১৯০৯ সনে প্রকাশিত হয়।
এই গ্রন্থে মোট দুশোর বেশি বইয়ের উল্লেখ দেখা যায়। এই বইগুলোর ভেতরে যেমন আছে কঠিন দার্শনিক বিষয়ের বই, তেমনি বিশেষভাবে আছে বিশ শতকের প্রথম দশকে পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক মহলে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টিকারী কিছু বিজ্ঞান বিষয়ের রচনা। লেনিনের মতো বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতার পক্ষে সমসাময়িক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় গভীর আগ্রহ যেকোনো পাঠকের কাছে গভীর আগ্রহের বিষয়। দার্শনিক ও পদার্থবিজ্ঞানের বিপুল পাঠ্য থেকে সংকলিত সমস্ত তথ্য নিপুণ দার্শনিক বিচারের কষ্টিপাথরে লেনিন যাচাই করেছেন। সেই উদ্দেশ্যেই তাঁর পক্ষে প্রয়োজন হয়েছে তুমুল বিতর্কের অবতারণা করবার।
লেনিন ‘ম্যাকিসটস’ তাত্ত্বিকদের আলোচনা করে বলেন, আন্দোলনের বিপর্যয়কালে যেখানে প্রয়োজন দ্বান্দ্বিক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল সত্যকে সংশোধনবাদের আঘাত হতে রক্ষা করা, রুশ ‘ম্যাকিটস’গণ সেখানে ‘সংশোধনবাদী নব অভিজ্ঞতাবাদের’ ‘আত্মগত’ বা ‘সাবজেকটিভ’ ভাববাদ এবং জ্ঞানের প্রশ্নে ‘অজ্ঞানবাদ’কে প্রচার করার চেষ্টা করেছেন। বাজারভ, বোগদানভ, লুনাচারস্কি প্রমুখ সমাজতন্ত্রী বুদ্ধিজীবিগণ সংগ্রামের পথ পরিত্যাগ করে গ্রহণ করেছেন রহস্যবাদ এবং হতাশাবাদকে। অভিজ্ঞতাবাদ, উপলব্ধিবাদ, প্রতীকবাদ প্রভৃতি নতুন নতুন শব্দের আড়াল দিয়ে তাঁরা বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ তথা মার্কসবাদকে।[২]
বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ-বিচারবাদ গ্রন্থটি সমালোচনার সমালোচনা
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মার্কসীয় দর্শনে ব্যাখ্যা ও যথার্থতা নিয়ে এক বিতর্ক শুরু হয়। একদল মাকর্সবাদ ও বস্তুবাদের সমালোচনা করেন। তারা বলেন মার্কসবাদ ও বস্তুবাদ নৈতিকতা এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকে গুরুত্ব দেয় না। বর্তমানকে অস্বীকার করে মার্কসবাদ ভবিষ্যতকে প্রাধান্য দেয়। ব্যক্তি নিজস্ব মূল্যবোধের বিনিময়ে সামাজিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ফলে ব্যক্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। যে সময়ে মার্কসীয় দর্শন এই রকম তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছিল, ঠিক সেই সময় লেনিন বলশেভিক পার্টি গঠন বিপ্লব ও অন্যান্য নানা সমস্যায় তিনি ব্যস্ত ছিলেন। লেনিন কিন্তু মার্কসবাদী দর্শনের উপর এই আক্রমণকে মেনে নেননি। এই গ্রন্থটি লেখার অব্যবহিত উদ্দেশ্য ছিলো রুশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে কিছু তথাকথিত মার্কসবাদীরা যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিলেন তার নিরসন করা।
সেসময় একদল রুশ বুদ্ধিজীবী আর্নস্ট মাখের (১৮৩৮-১৯১৬) দার্শনিক মত দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের মার্কসবাদী বলে ঘোষণা করতেন এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মতাদর্শগত প্রচারেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। এসব তাত্ত্বিক রুশ নেতাদের মধ্যে ছিলেন এ. বগদানভ (১৮৭৩-১৯২৮), ভি. বাজারভ (১৮৭৪-১৯৩৯), এ. ভি. লুনাচারস্কি (১৮৭৫-১৯৩৩), জে. এ. বারমান (১৮৬৮-১৯৩৩) সহ আরো কয়েকজন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে এঁদের মধ্যে বারমান ছাড়া বাকি সকলেই কালক্রমে বলশেভিক আন্দোলনের সংগে সম্পর্ক ত্যাগ করেন।
লেনিন বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ-বিচারবাদ গ্রন্থে বিশপ বার্কলির (১৬৮৫-১৭৫৩) মতামতকে তুলে আনেন। বার্কলির মূল প্রতিপাদ্য হলো, সাধারণ মানুষ যাকে বাস্তব বহির্জগত বলে মনে করে আসলে তা নেহাতই মন গড়া। আমাদের মনের বাইরে বাস্তব বহির্জগত বলে সত্যিই কিছু থাকতে পারে না। সেই বার্কলির সাথে মাখের পার্থক্য হচ্ছে মাখ রকমারি অভিনব পরিভাষা ব্যবহার করেন। এছাড়া মাখপন্থীরা সকলেই বস্তুবাদকে আক্রমণ করেছেন। লেনিন ব্যঙ্গ করে বলেছেন যে,
“আর্নস্ট মাখের সাম্প্রতিক পজিটিভিজম মাত্র দুশো বছরের পুরনো এক দর্শন। ইতিপূর্বে বার্কলি পর্যাপ্তভাবেই প্রমাণ করেছেন যে ‘সংবেদন বা মানসিক উপাদান থেকে’ একজ্ঞাতাবাদ ছাড়া আর কিছুই গড়া সম্ভব নয়”।
লেনিন উক্ত গ্রন্থে একদিকে পজিটিভিজম, একজ্ঞাতাবাদ বা Solipcism, অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা এবং আপেক্ষিকতাবাদীদের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং অন্যদিকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে আঁকড়ে ধরেন।[৩] লেনিনের এ গ্রন্থ ভাবধারার ক্ষেত্রে সংগ্রামের প্রশ্নে তাঁর আপসহীনতারও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাজারভ, বোগদানভ, লুনাচারস্কি এরাও সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, কাজেই তাদের আক্রমণ করে রুষ্ট না করে তাঁদের সঙ্গে আপসের প্রস্তাব করলে লেনিন গোর্কীকে বলেন,
‘আপনি নিশ্চয়ই একদিন স্বীকার করবেন যে, আদর্শের ক্ষেত্রে কোনো মতকে যদি দলের কর্মী স্বপ্রত্যয়ে ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকর বলে জানে, তবে সে ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকর মতের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম করাই তার অনিবার্য্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়; তার সঙ্গে আপস করা নয়।’
লেনিন তাঁর এই গ্রন্থে বার্কলে, কান্ট, হউম প্রভৃতি আধুনিক মুখ্য ভাববাদীদের দর্শনসহ সমগ্র ভাববাদের, দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদের ভিত্তিতে, তাঁর বিশিষ্ট রচনাশৈলীতে তীক্ষ্ম সমালোচনা উপস্থিত করেন। লেনিনের ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এন্ড এমপিরিও-ক্রিটিসিজম’ সংগ্রামী দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক সংযোজন।[২]
লেনিন Materialism and Empirio-criticism গ্রন্থে মার্কসবাদের সমালোচকদের সমালোচনা করেন। মার্কস ও এঙ্গেলসের বস্তুবাদ সম্পর্কিত যাবতীয় তত্ত্বকে লেনিন একত্রিত করেন। তিনি দ্বান্দ্বিকতাকে বিশ্লেষণ করে বলেন দ্বন্দ্ব বস্তুবাদের নীতিগুলি শুধুমাত্র বাস্তবের চিরকালীন নিয়ম নয়, চিন্তনেরও নিয়ম, দ্বান্দ্বিকতার এই নীতিগুলি মানুষের বস্তুগত কার্যাবলীকে সংঘবদ্ধভাবে পরিচালনা করার এক কৌশল বা পদ্ধতি। লেনিনকে একজন গোঁড়া মার্কসবাদী বলে অভিহিত করা হলেও এবং মার্কসবাদের বিকাশ সাধনে তার অবদান সর্বজন স্বীকৃত হলেও, তিনি যে সবসময় মার্কস ও এঙ্গেলসকে অনুসরণ করেছে তা বলা যায় না।[৪]
তথ্যসূত্র
১. গ. দ. অবিচকিন ও অন্যান্য; ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, সংক্ষিপ্ত জীবনী; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭১; পৃষ্ঠা-৯৩
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৭৯।
৩. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, দার্শনিক লেনিন, মনীষা কলকাতা, আগস্ট ১৯৮০, পৃষ্ঠা ২২-৪৩।
৪. গোবিন্দ নস্কর, Political thought, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ৩৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।