বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ইংরেজি: Bankim Chandra Chattopadhyay; ২৬ জুন ১৮৩৮ – ৮ এপ্রিল ১৮৯৪) ছিলেন একজন ভারতীয় উপন্যাসিক, কবি ও সাংবাদিক। তিনি মূলত সংস্কৃত ভাষায় বন্দে মাতরমের রচয়িতা ছিলেন এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিনি ভারতকে মাতৃদেবতা হিসাবে কল্পনাকারী হিসেবে অনুপ্রেরণাদায়ী কর্মী ছিলেন। চট্টোপাধ্যায় চৌদ্দটি উপন্যাস লিখেছিলেন এবং বহু গম্ভীর, গম্ভীর-হাস্যরসাত্মক, ব্যঙ্গাত্মক, বৈজ্ঞানিক ও সমালোচনামূলক গ্রন্থগুলি লিখেছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন ঔপন্যাসিক ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন, বাংলা সন ১২৪৫, ১৩ আষাঢ় নৈহাটির কাঠালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মেদিনীপুরে ডেপুটি কালেক্টর পদে চাকুরি করতেন। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন যাদবচন্দ্রের তৃতীয় পুত্র। তার প্রথম ও দ্বিতীয় পুত্র যথাক্রমে শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্রের মধ্যে লেখক হিসেবে সঞ্জীবচন্দ্র খ্যাতি লাভ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা পূর্ণচন্দ্র পরবর্তীকালে বঙ্কিম-জীবনের বহু অজ্ঞাত মূলাবান তথ্য তার কাছ থেকে জানা সম্ভব হয়েছে।
ছয় বৎসর বয়স পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্র পৈতৃক নিবাস কঁঠাল পাড়াতেই থাকেন। পাঁচ বছর বয়সে এখানেই তার হাতেখড়ি হয় কুলপুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে। শিশু বয়স থেকেই বঙ্কিমচন্দ্রের অসাধারণ মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি একদিনেই বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করেছিলেন।
পুত্রের অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পেয়ে যাদবচন্দ্র তার শিক্ষার ব্যাপারে খুবই সতর্ক ও যত্নবান ছিলেন। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ছয় বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে এসে কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। নম্র ব্যবহার ও নিরীহ প্রকৃতির জন্য অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এখানে সকলের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। ক্লাসের পাঠেও বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়ে তিনি সকলকে চমৎকৃত করেন।
১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিম আবার কাঠাল পাড়ায় ফিরে আসেন। এই সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই নারায়ণপুর গ্রাম নিবাসী পাঁচ বছরের এক বালিকার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিযের সময়ে বঙ্কিমের বয়স হয়েছিল এগারো।
১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ বঙ্কিমের জীবনে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই বছরেই সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পারিতোষিক লাভ করেন। তার কবিতার নাম ছিল- “কামিনীর উক্তি। তোমাতে লৌ ষড়ঋতু”। কবিতাটি যথারীতি সংবাদ প্রভাকরে মুদ্রিত হয়।
উল্লেখযোগ্য যে হুগলী কলেজে পড়ার কালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বর গুপ্তের আদর্শে সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য ও পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরে তার বহু গদ্য ও পদ্য রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়।
হুগলী কলেজে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় ১৮৫৬ খ্রিটাব্দে সকল বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে বঙ্কিমচন্দ্র দুই বছরের জন্য কুড়িটাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বৎসরই তিনি হুগলী কলেজ পরিত্যাগ করে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। একই বছরে তার ললিতা, পুরাকালিক গল্প, তথা মানস নামক কবিতা পুস্তক প্রকাশিত হয়। তার গদ্য, পদ্য রচনা প্রকাশে কবিবর ঈশ্বর গুপ্তের বিশেষ সহায়তার কথা পরবর্তীকালে মুক্তকণ্ঠে তিনি প্রকাশ করেন।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারেব মত বি এ পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু।
এরপর বঙ্কিমচন্দ্র আইন পরীক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। কিন্তু পরীক্ষার আগেই তিনি সেই বছরেই যশোর জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে সরকারী চাকরিতে যোগ দেন। বারো বছর পরে চাকুরিরত অবস্থায় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইন পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।
বঙ্কিমচন্দ্র দীর্ঘ তেইশ বছর সরকারি পদে চাকুরী করার পর ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে অবসর গ্রহণ করেন।| যশোরে থাকাকালে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্রের পত্নী বিয়োগ হয়। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। সহধর্মিনী রাজলক্ষ্মী দেবী সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র পরবর্তীকালে বলেছেন, ‘আমার জীবন অবিশ্রান্ত সংগ্রামের জীবন। একজনের প্রভাব আমার জীবনে বড় বেশি রকমের—আমার পরিবারের। আমার জীবনী লিখিতে হইলে তাহারও লিখিতে হয়। তিনি না থাকিলে আমি কি হইতাম বলিতে পারি না’।
বঙ্কিমচন্দ্র হাকিমরূপে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করায় মানুষের দুঃখ বেদনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার দেশপ্রেম ও স্বদেশ হিতৈষণা ছিল প্রগাঢ়।
শাসকের জাতি ইংরেজদের সঙ্গে ভারতীয়রাও সমান মর্যাদা লাভ করবে তিনি এই নীতি মেনে চলতেন বলে কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতানুরূপ উন্নতি লাভ করতে পারেননি। চাকরি জীবনেই নীলদর্পণ খ্যাত দীনবন্ধু মিত্রের সঙ্গে তার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। প্রবল দেশপ্রেম পরস্পরকে প্রভাবিত ও তাদের চিন্তার পরিপুষ্টি সাধন করে।
কিশোরীচাঁদ মিত্র সম্পাদিত ইন্ডিয়ান ফিল্ড নামের ইংরাজি পত্রিকায় বঙ্কিমের Rajmohan’s wife ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এটিই তার প্রথম উপন্যাস। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে দুর্গেশনন্দিনী পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এরপর কপালকুন্ডলা ও মৃণালিনী প্রকাশিত হয়। এই তিনটি উপন্যাসই বাংলা উপন্যাস সাহিত্যকে প্রতিষ্ঠা দান করে।
স্বদেশ সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি বঙ্কিমের ছিল গভীর টান। ফলে পরদেশী শাসনে দেশের মানুষের নিপীড়িত অবস্থা তাকে অহরহ পীড়া দিত। এ বিষয়ে শিক্ষিত সমাজ না জাগলে সাধারণের চেতনা ঘটানো সম্ভব নয়। এ সত্য তিনি উপলব্ধি করেছিলেন স্বদেশবাসীকে আত্ম-সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রকাশ শুরু করেন। অচিরেই এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল একটি শক্তিশালী সাহিত্যিক গোষ্ঠী। বঙ্কিমের সম্পাদিত বঙ্গদর্শনে সাহিত্য, বিজ্ঞান,দর্শন,কাব্য,সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, অর্থনীতি, প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা প্রকাশিত হতো।
বাংলার সমাজ ও সাহিত্য জীবনে এই পত্রিকা বিপুলভাবে সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়েছিল। বঙ্কিমের স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ উপন্যাস রাজসিংহ, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী, সীতারাম প্রভৃতি ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং এগুলোকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে পাবনা সিরাজগঞ্জে যে প্রজাবিদ্রোহের সূচনা হয় তার সূত্রপাত ঘটেছিল বঙ্কিমের একটি লেখা প্রকাশের অব্যবহিত পরেই। তিনি পূর্ববঙ্গের কৃষক নামের একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধে ভূমি সমস্যা ও কৃষক সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলেন। ভারতের অন্যতম জাতীয় সঙ্গীত বন্দেমাতরম বঙ্কিম রচনা করেছিলেন ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি স্থায়ীভাবে কলকাতাতেই বাস করতে থাকেন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। বঙ্কিমচন্দ্র মোট চোদ্দটি উপন্যাস রচনা করেন। এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য বইগুলি হলো কৃষ্ণচরিত, লোকরহস্য, বিজ্ঞান রহস্য, ললিতা, দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী, ধর্মতত্ত্ব, শ্রীমদ্ভাগবতগীতা প্রভৃতি।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৩০-৩২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।
তথ্য লেখা, অনেক কিছু জানলাম।