শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ইংরেজি: Sarat Chandra Chattopadhyay; ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ – ১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮) ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী। তাঁর রচিত গল্প ও উপন্যাসের জনপ্রিয়তা তুলনাহীন। বিগত একশ বছর যাবৎ তাঁর রচিত গল্প উপন্যাসের জনপ্রিয়তা ও সমাদর অম্লান রয়েছে। তৎকালীন সমাজের ক্রুটি বিচ্যুতি অনাচার স্খলন, কুসংস্কার, ভন্ডামী সুদক্ষ চিত্রকরের মত তিনি তার সাহিত্যে চিত্রিত করেছেন। নিপুণভাবে নিজেকে আড়ালে রেখে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের ইঙ্গিত আভাসিত করেছেন।
সরল সহজ ভাষায়, অননুকরণীয় ভঙ্গিতে সমাজের বিভিন্ন চরিত্রের দুঃখ বেদনা, অভাব, অভিযোগ, মনন ও চিন্তার জটিল আবর্ত তিনি অতি সার্থকভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। বিশেষ করে নারীজাতির স্নেহ, মমতা, সরলতা ও বাৎসল্য, তাদের অন্তর্গঢ় আবেগ, আর্তি, ব্যথা, বেদনা, কুটিলতা, তাদের প্রতি পুরুষশাসিত সমাজের অবিচার, নির্যাতন, এক কথায় তৎকালীন সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত নারী সমাজের সমাগ্রিক রূপ তিনি গভীর মমত্ববোধ ও সহানুভূতির সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন। সমাজের ক্রটি ও দুর্বার প্রতি তার বক্তব্য ও ইঙ্গিত আজও প্রাসঙ্গিক।
শরৎচন্দ্রের জন্ম হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাহিত্যানুরাগী, পান্ডিত্যের জন্যও তাঁর খ্যাতি ছিল। কিন্তু অস্থির স্বভাবের জন্য তার সব গুণই অপচয়িত হয়। উদাসী প্রকৃতির এই মানুষটি সংসারের প্রতিও ছিলেন উদাসীন, ফলে দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। প্রধানত এই কারণেই শরৎচন্দ্রকে কিশোর বয়সে ভাগলপুরে মাতুলালয়ে গিয়ে থাকতে হয়েছিল।
নিজের ও পরিবারের কথা বলতে গিয়ে পরে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, ‘আমার শৈশব ও যৌবন ঘোর দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। অর্থের অভাবেই আমার শিক্ষালাভের সৌভাগ্য ঘটেনি। পিতার নিকট হতে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকার সূত্রে আর কিছুই পাইনি। পিতৃদত্ত প্রথম গুণটি আমাকে ঘরছাড়া করেছিল— আমি অল্পবয়সেই সারা ভারত ঘুরে এলাম। আর পিতার দ্বিতীয় গুণের ফলে জীবন ভরে আমি কেবল স্বপ্নই দেখে গেলাম। আমার পিতার পান্ডিত্য ছিল অগাধ। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা– এক কথায়, সাহিত্যের সকল বিভাগেই তিনি হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনটাই শেষ করতে পারেননি’।
তার লেখা থেকেই জানা যায় অল্প বয়সেই তিনি দেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন। তাদের দুঃখ বেদনার সংবাদ জানতে পেরেছিলেন যা পরবর্তী জীবনে তার সাহিত্যরচনার শাথেয় হয়েছিল। কৈশোর ও যৌবন কেটেছিল তার ভাগলপুরেই। তার এখানকার জীবনের পরিচয় জানা যায় তার বিখ্যাত শ্রীকান্ত উপন্যাস থেকে।
দুঃখ কষ্টের মধ্যে থেকেও ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে শরৎচন্দ্র প্রবেশিকা পাশ করেন। কলেজে ভর্তি হয়েও টাকার অভাবে কলেজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। লেখাপড়ার প্রতি গভীর আগ্রহ বশেই এক সময়ে সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হন। সতের বছর বয়সেই গল্প লেখা আরম্ভ করেন।
ভাগলপুরে বন্ধুদের সঙ্গে নাটকে অভিনয় করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর অর্থোপার্জনের চেষ্টায় কিছুদিন চাকরি করেন। পরে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ভাগ্যান্বেষণে ব্রহ্মদেশে পাড়ি দেন। রেঙ্গুনে তিনি অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের অফিসে চাকরি নিয়ে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন।
প্রবাসের জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। এখানেই বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু দুরারোগ্য প্লেগ রোগে অকালেই স্ত্রী বিয়োগ হয়। ব্রহ্মদেশে থাকবার সময়েই তিনি বন্ধুদের আগ্রহে সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। কলকাতার যমুনা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় রামের সুমতি। ১৩১৯-২০ বঙ্গাব্দে এই পত্রিকায় তার আরো দুটি উপন্যাস পথ-নির্দেশ ও বিন্দুর ছেলে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। তার এই লেখাগুলো পাঠক সমাজে সাড়া জাগিয়েছিল।
পরের দুই বছরে বিখ্যাত ভারতবর্ষ পত্রিকায় বিরাজ বৌ, পন্ডিতমশাই, পল্লীসমাজ পরপর প্রকাশিত হয়। প্রথম রচনা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতবর্ষে প্রকাশিত উপন্যাস তাকে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করল। এরপর তিনি সাহিত্যকেই জীবিকার্জনের মাধ্যম রূপে গ্রহণ করেন এবং ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফিরে এসে সম্পূর্ণভাবে সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।
শরৎচন্দ্র কিছুকাল কলকাতার অদূরে বাজে শিবপুর অঞ্চলে বসবাস করেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে হাওড়া জেলার পানিত্রাস গ্রামে বাড়ি করে বসবাস করতে থাকেন। শেষ জীবনে কলকাতায়ও একটি বাড়ি করেছিলেন এবং সেখানেই বাস করেন।
শরৎচন্দ্রের প্রথম মুদ্রিত গল্পের নাম মন্দির। এই গল্পের জন্য তিনি কুন্তলীন পুরস্কার লাভ করেন ১৩০৯ বঙ্গাব্দে। বড়দিদি উপন্যাস তার প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। ছদ্মনামেও তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যমুনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল অনিলা দেবী ছদ্মনামের নারীর লেখা, নারীর মূল্য, কানকাটা, গুরু-শিষ্য-সংবাদ প্রভৃতি। বিভিন্ন সাময়িক পত্রে রাজনীতি বিষয়ক প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। তরুণের বিদ্রোহ তার উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক রচনা।
স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গেও শরৎচন্দ্র অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। প্রকাশ্য ভাবেও বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। হাওড়া জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন। পরে বিতশ্রদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সরে আসেন।
স্বদেশী যুগে তাঁর পথের দাবী উপন্যাসটি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বাংলার বিপ্লববাদের সমর্থক অভিযোগ তুলে ব্রিটিশ সরকার এই উপন্যাস ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বাজেয়াপ্ত করেছিল।
শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা তার জীবিতকালেই প্রবাদ রূপ লাভ করেছিল। তার গ্রন্থের প্রতি দেশের সর্বস্তরের মানুষই আগ্রহ বোধ করত। সাহিত্য তাকে অর্থ, যশ, সম্মান দুহাত ভরে দিয়েছিল। অনন্যসাধারণ সাহিত্যকীর্তির জন্য বহু সম্মান তিনি লাভ করেছিলেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে জগত্তারিণী পদক দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডি-লিট উপাধি পান। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য হন।
শরৎচন্দ্র সাহিত্যক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে গুরুর মর্যাদা দিতেন। রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস সাহিত্যে শরৎচন্দ্রকে জয়মাল্য দিয়েছিলেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র লোকান্তরিত হন।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৩৭-৪০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।