বিপ্লব বা রাজনৈতিক বিপ্লব (ইংরেজি: Revolution) হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক সংগঠনের একটি মৌলিক এবং তুলনামূলকভাবে আকস্মিক পরিবর্তন। বিপ্লব ঘটে সাধারণভাবে অনুভূত রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক নিপীড়ন বা রাজনৈতিক অক্ষমতার কারণে যখন জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
বিপ্লব শব্দের অর্থ হলো আমুল পরিবর্তন। সেটা যে কোনো ক্ষেত্রে হতে পারে। যথা, ঔষধের ক্ষেত্রে, পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে, রসায়নের ক্ষেত্রে, জেনেটিক-এর ক্ষেত্রে বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে। আমরা সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিপ্লবের কথা বলতে পারি অথবা তাদের মধ্যে যুক্তভাবেও বলা যায়।
মনে রাখা দরকার পরিবর্তন সব সময়ে সব সমাজে ঘটে চলে। অর্থাৎ, কোনো সমাজব্যবস্থাই পরিবর্তনহীন নয়। তবে পরিবর্তনের ধরন ও গতির মধ্যে তফাৎ থাকে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই চলতে থাকা পরিবর্তন সমাজ শুষে নেয়, প্রায় বোঝাই যায় না। তবে এমনও সময় আসে যখন তা সম্ভব হয় না। তখন বিপ্লব ঘটে।
কোনো জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতি আসে যখন খুব দ্রুত পরিবর্তন হয় এবং তার সঙ্গে খুব জরুরি ভিত্তিতে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়াটা চালাতে হয়। সব পরিবর্তনই উপস্থিত ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করে কারণ প্রচলিত প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের বদলে সময় লাগতে পারে। তবে যখন পরিবর্তন অতি দ্রুত হয় তখন চাপ অসহনীয় হতে পারে ফলে সমাজ ভেঙে পড়ার অবস্থায় দাঁড়ায়।
সব চেয়ে বড় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সমাজের মূল স্তম্ভগুলির পরিবর্তন লাগে। তাই সব থেকে বড় পরিবর্তনগুলো বিপ্লব। রাজনৈতিক অর্থে, যখন একই সাংবিধানিক ব্যবস্থার মধ্যে আইনসংগতভাবে একটি গোষ্ঠী থেকে অন্য এক গোষ্ঠী ক্ষমতা নেয় তাকে বিপ্লব বলা হয় না। কিন্তু যখন সংবিধান ও সরকার দুইই নতুন করে ঢেলে সাজানো হয় তখন বিপ্লব ঘটে। সাংবিধানিক পরিবর্তনের পাশাপাশি যদি আমূল সামাজিক পরিবর্তনও হয় তা হলে বিপ্লব আরো সর্বাত্মক।
গত তিনশো বছরের মধ্যে যে বড় বড় বিপ্লব ঘটেছে সেগুলির ক্ষেত্র দেখা যায় যে ১৭৭৫-১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের আমেরিকান বিপ্লব সরকার ও সংবিধানের পরিবর্তন আনে, ১৬৪৫-১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের ইংল্যান্ডের বিপ্লব সংবিধান ও সরকারের পরিবর্তন আনার সাথে সাথে চার্চ ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়টিও স্থির করে এবং একটি নতুন বাণিজ্যিক শ্রেণির আধিপত্য স্বীকৃত হয়। ফরাসি বিপ্লব যেটি ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় সেটি ইংল্যান্ডের বিপ্লবের চেয়েও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমাজে আরো বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করে। আর ১৯১৭-র রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে সমাজে সব থেকে আমূল পরিবর্তন আনে।[১]
Word Net Dictionary-র সংজ্ঞা অনুসারে বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া বলতে বোঝায়, ক. শাসিতদের দ্বারা সরকারের উচ্ছেদ এবং খ. চিন্তা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন। শিল্প বিপ্লবও সামাজিক বিপ্লব ছিল।
অধিকাংশ সংজ্ঞাই বিবরণমূলক বা নানা ভাবনার সমন্বয়। অর্থাৎ বিপ্লব কী দাঁড়িয়েছে তার বিবরণ থেকে শুরু করে। কাল গ্রীওয়ান্ধকে উদ্ধৃত করে ই. জে. হবসম লেখেন:
এখনও পর্যন্ত বিপ্লব সেই ঐতিহাসিক ঘটনার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয় যেখানে তিনটি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটে। প্রথম, একটি প্রক্রিয়া যেটি সহিংস ও হঠাৎ ধাক্কা দেয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আইনের ক্ষেত্রে বিশেষত যেন ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া বা উল্টে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, আছে একটি সামাজিক অংশ। এটি গোষ্ঠী বা জনগণের আন্দোলনে বা তার খোলামেলা প্রতিরোধে দেখা যায়। অবশেষে, একটি কর্মসূচি বা মতাদর্শের তাত্ত্বিক অংশ। এটি পুনর্গঠন ও উন্নয়নের ইতিবাচক লক্ষ্য নির্ধারণ করে।[২]
এর সঙ্গে হবসম জনগণের সংগঠিত হওয়ার গুরুত্ব উল্লেখ করেন ও বলেন যে সেটি বাদে খুব কম ইতিহাসবিদই বিপ্লবকে চিহ্নিত করতেন।
হ্যানা আরেন্ড On Revolution-এ (নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৩) বলেন, “বিপ্লবকে যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক, সেগুলি নিছক পরিবর্তন নয়। এখান থেকে শুরু করে Chalmer Johnson ‘Revolution and the Social System’ এ বলেন ‘সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে বিপ্লব এক ধরনের পরিবর্তন; যে কোনো পরিবর্তন নয়, তবুও পরিবর্তন।
জন ডান লিখেছিলেন— ‘বিপ্লব প্রকৃতির বাস্তব ঘটনা। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সমতুল্য। প্রচণ্ড শক্তি মুক্তি পায়… নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কহীন, অনিবার্য। তার পথে যা পড়ে সব কিছু ধ্বংস করে… বাধা দেওয়া অর্থহীন, এবং দাঁতোর কথায় তা পরীক্ষা করতে যাওয়া অবাস্তব।[৩]
বিপ্লবের সব সময়েই প্রায় দুটো দিক প্রকাশ পায়। একটি সুন্দর বিপ্লব-পরবর্তী সময়ের মানবিক স্বপ্ন। অপরটি অমার্জিত, সংহিস বাস্তব যেটি কিছুটা আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা শাসকের শাসন করার অক্ষমতা প্রকাশ করে। তবে, আরো অনেক পরিস্থিতি আছে যেখানে শাসক শ্রেণি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে অক্ষম হয় কিন্তু এই বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটে তার চেয়ে বড় ঘটনা।
তথ্যসূত্র
১. দেবী চ্যাটার্জী, রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়সমূহ, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ১৩২-১৩৩।
২. E. J. Hobsom, Revolution, Rosernary H. T. O’ Kane সম্পাদিত ‘Revolution critical Courts in Political Science.’ খণ্ড ১, Routledge, লন্ডন, ২০০০, পৃ. ৮৫
৩. John Donne, Modern Revolutions, Cambridge University Press, লন্ডন, ১৯৭২, পৃ.৩
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।