মার্কসবাদ বা মার্ক্সবাদ (ইংরেজি: Marxism) হচ্ছে কার্ল মার্কসের (৫ মে, ১৮১৮ – ১৪ মার্চ, ১৮৮৩) দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা, শিক্ষামালা ও বিশ্লেষণ-প্রক্রিয়ার নাম। জার্মান চিরায়ত দর্শনের দুই দিকপাল ফ্রিডরিখ হেগেল (১৭৭০–১৮৩১) ও লুডউইগ ফয়েরবাখ (১৮০৪-১৮৭২) থেকে দর্শন, ইংল্যান্ডের ডেভিড রিকার্ডো (১৭৭২-১৮২৩) ও অন্যান্যদের কাছ থেকে অর্থশাস্ত্র এবং ফ্রান্স থেকে কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র ও ফরাসি বিপ্লবী মতবাদকে সংশ্লেষণ করে মার্কস নির্মাণ করেছিলেন যে দর্শনের তার নাম মার্কসবাদ। বিশ শতকের শুরুতেই গোটা দুনিয়াব্যাপী মার্কসবাদের সারমর্মরূপে পণ্য, উৎপাদনের উপকরণ, উৎপাদনের উপায়, মূল্যের নিয়ম, উৎপাদনের সমাজতান্ত্রিক উপায়, উদ্বৃত্ত উৎপাদন, উদ্বৃত্ত মূল্য, মজুরি শ্রম; শ্রেণি, শ্রেণি সচেতনতা, শ্রেণিসংগ্রাম, শোষণ, মানব প্রকৃতি, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, উৎপাদন সম্পর্ক; দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, প্রলেতারিয়েত, প্রলেতারিয় বিপ্লব, প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব, প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতাবাদ, বিশ্ববিপ্লব, রাষ্ট্রবিহীন সাম্যবাদ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত নানামুখি ধারনা, তত্ত্ব ও মতবাদ প্রলেতারিয়েতের মুক্তির দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
দর্শনের দরকার নিপীড়িতদের। জ্ঞানের দরকারও সবচেয়ে বেশি নিপীড়িতদের। এ-পৃথিবীতে নিপীড়িতদের স্বর্গরাজ্য কায়েম করতে দরকার দর্শনের। এ-পৃথিবীকে সমতার পদতলে সমর্পণের জন্য দরকার দর্শনের। আর সমতার পৃথিবী নির্মাণের জন্য প্রয়োজন হয় শ্রেণিসংগ্রামের। অন্যভাবে বললে বলতে হয় যেখানে শ্রেণিসংগ্রাম আছে, শুধুমাত্র সেখানেই দর্শন থাকতে পারে। মাও সেতুং লিখেছেন,
‘নিপীড়করা নিপীড়িতদের নিপীড়ন করে, আর নিপীড়িতদের দরকার হয়ে পড়ে একে সংগ্রাম করা এবংএজন্য একটি পথ খুঁজে পাওয়া, তখনই তারা দর্শনের খোঁজ শুরু করে। যখন মানুষ এটাকে সূচনা-বিন্দু হিসেবে গ্রহণ করলো, মাত্র তখনই মার্কসবাদ-লেনিনবাদের উদ্ভব ঘটলো এবং জনগণ দর্শন আবিষ্কার করলেন’।[১]
জগতের সৃষ্টিই এক আকস্মিক বিস্ময়কর দ্বন্দ্বের ফল। এই পৃথিবীর সবকিছুই বিপরীতের সাথে দ্বন্দ্বরত। আর এই দ্বন্দ্ব থেকেই আসে বিকাশ। বিকাশের ও বিবর্তনের ধারনা উনিশ শতকেই প্রায় সমগ্র সামাজিক চেতনার মধ্যে প্রবেশ করেছে। অতিক্রান্ত স্তরের পুনরাবর্তনের মতো বিকাশ, কিন্তু সেই পুনরাবর্তন একটা উচ্চতর স্তরের ভিত্তিতে; সরলরেখায় বিকাশ নয়, বলা যেতে পারে স্পাইরাল বা আঁকাবাঁকা পথে বিকাশ;_ উল্লম্ফন, বিপর্যয়, বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিকাশ;_ ‘ক্রমিকতায় ছেদ’; ‘গুণ ও পরিমাণ’, ‘ইতি ও নেতি’, ‘বাহ্যিক চেহারা ও সারমর্ম’, ‘সারবস্তু ও রূপ’, ‘প্রয়োজনীয়তা ও স্বাধীনতা’, ‘সম্ভাবনা ও বাস্তবতা’ ইত্যাদি দুই বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রামের মাধ্যমে বিকাশ। একটি বস্তুর ওপর, অথবা নির্দিষ্ট ঘটনার পরিসীমার মধ্যে কিংবা একটি সমাজের অভ্যন্তরে সক্রিয় বিভিন্ন শক্তি ও প্রবণতার বিরোধ থেকে, সংঘাত থেকে পাওয়া বিকাশের অভ্যন্তরীণ তাড়না; প্রত্যেকটি ঘটনার সবকটি দিকের পরস্পর নির্ভরতা এবং সুনিবিড় অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, এমন সম্পর্ক যা থেকে গতির একক নিয়মানুগ বিশ্বপ্রক্রিয়ার উদ্ভব_ বিকাশের আরো সারগর্ভ মতবাদ রূপে দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের উদ্ভব এবং বস্তুবাদের দ্বান্দ্বিক মূলনীতিকে মানব সমাজ ও মানুষের সামাজিক ইতিহাসের ক্ষেত্র পর্যন্ত প্রসারিত করে মার্কসবাদ প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের দার্শনিক সংশ্লেষণ ঘটালো। তাই একুশ শতকে এই পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশকে টিকাতে, মানুষের সমতার যুগ সৃষ্টি করতে কতিপয় দ্বন্দ্বের সমাধান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই দ্বন্দ্বগুলোকে সমাধান করে সামনে এগোনোর জন্যই মার্কসবাদের দরকার।
মার্কসবাদ কোনো ফুলেল শান্তিবাদী মতাদর্শ নয়। মার্কসবাদ গোড়া থেকেই বিদ্রোহ ও বিপ্লবকে সৃষ্টি করবার এক বাস্তব প্রভাবক। এটি মানুষকে সব সময় বিশ্ব-ইতিহাসের মধ্যে দেখেছে এবং প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়ার দ্বন্দ্বের সমাধান করে সমতার সমাজ নির্মাণের ইতিহাসে নিজেকে সংযুক্ত করেছে। মাও সেতুং লিখেছেন,
‘আমাদের এই জগতে কীভাবে কোনো হৈ-হট্টগোল ও বিতর্ক না থাকতে পারে? মার্কসবাদ যেহেতু দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামকে নিয়েই কাজ করে, সেজন্য এটা হচ্ছে হৈ-হট্টগোল ও বিতর্কের মতবাদ। দ্বন্দ্ব সর্বদাই আছে, এবং যেখানেই দ্বন্দ্ব আছে সেখানেই সংগ্রাম আছে।’[২]
সমাজের অভ্যন্তরে সংগ্রাম করতে হয় দ্বন্দ্বসমূহের সমাধানের জন্য। সমাজ এগিয়ে চলে সমাজের অভ্যন্তরের শ্রেণিদ্বন্দ্বের কারণেই, উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের কারণেই। কেননা
‘একথাগুলি সুবিদিত যে একটা নির্দিষ্ট সমাজের কিছু লোকের প্রচেষ্টার সংগে অন্যকিছু লোকের প্রচেষ্টার সংঘাত বাধে, সামাজিক জীবন বিরোধে ভরা, ইতিহাসে দেখাযায় শুধু জাতিতে জাতিতে ও সমাজে সমাজে সংগ্রাম নয়, জাতির অভ্যন্তরে, সমাজের অভ্যন্তরেও সংঘাত লাগে এবং উপরন্তু পালা করে দেখা দেয় বিপ্লব ও প্রতিক্রিয়া, শান্তি ও সমর, অচলাবস্থা ও দ্রুত প্রগতি অথবা অবক্ষয়ের পর্ব। এই আপাতদৃশ্যমান বিশৃঙ্খলা ও গোলকধাঁধার মধ্যে নিয়মবদ্ধতা আবিষ্কার করার চাবিকাঠি এনে দিয়েছে মার্কসবাদ।’[৩]
মার্কসবাদই সর্বপ্রথম মানবজাতির ইতিহাস অধ্যয়নে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবর্তন করেছে। বুর্জোয়া বৈজ্ঞানিকেরা সমাজের ক্রমবিকাশের নিয়ম ব্যাখ্যা করতে অক্ষম ছিলো। তাঁরা সমাজের ইতিহাসকে কেবল আকস্মিক ঘটনাবলীর এক অবিচ্ছিন্ন ধারারূপে চিত্রিত করেন যেখানে তাদের যুক্ত করে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম আবিষ্কার করা অসম্ভব। মার্কসই প্রথম দেখান যে, প্রকৃতির বিকাশের মতো সমাজের বিকাশও নির্দিষ্ট অভ্যন্তরীণ নিয়ম মেনে চলে। তা হলেও মানুষের সমাজের ক্রমবিকাশ প্রাকৃতিক ক্রমবিকাশের মতো মানুষের ইচ্ছা ও কাজের উপর নির্ভর না করে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে হতে পারে না; বরং ব্যাপক জনসমষ্টির কাজের মধ্য দিয়েই মানবসমাজের ক্রমবিকাশ ঘটে থাকে।[৪]
মার্কসবাদ আবিষ্কার করেছে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার অন্তর্নিহিত বিরোধের দরুন নিজের ধ্বংসের দিকে অবিচলিতভাবে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্কসবাদ এই শিক্ষা দেয় যে, পুঁজিবাদের ধ্বংস আপনা আপনি আসবে না, বরং বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের নির্মম শ্রেণিসংগ্রামের ফলেই কেবল তা ধ্বংস হবে। যেহেতু সমাজ নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ি বিকাশ লাভ করে, সেহেতু, ঐ নিয়মগুলিই পুঁজিবাদের স্থানে সমাজতন্ত্র নিয়ে আসবে, কিন্তু সেই আশাতেই শ্রমিক শ্রেণি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। সমাজ বিকাশের নিয়মগুলি নিজে থেকে কার্যকর হয় না। সমাজে যে শ্রেণিসংগ্রাম চলছে, তার মধ্য দিয়েই ঐ নিয়মগুলি নিজের পথ তৈরি করে চলে।[৪]
মার্কসবাদের কাজ সত্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। মার্কসবাদীরা ও সাম্যবাদীরা সত্য প্রকাশে কখনোই ভয় পায় না। আর জগতের সমস্ত সত্য সংশ্লেষিত হয়েছে মার্কসবাদে। মাও সেতুং বলেছেন,
‘মার্কসবাদ হাজার হাজার সত্যের সমষ্টি, কিন্তু এগুলো সবই কেন্দ্রিভুত হয় একটি মাত্র বাক্যে_ বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত। হাজার হাজার বছর ধরে, এটা বলে আসা হচ্ছিল যে দাবিয়ে রাখাটা ন্যায়সঙ্গত, শোষণ করাটা ন্যায়সঙ্গত এবং বিদ্রোহকরাটা অন্যায়। এই পুরোনো সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র মার্কসবাদের উদ্ভবের পরই উল্টে গেল। এটা একটা মহান অবদান। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সর্বহারা শ্রেণি এই সত্য শিখেছে এবং মার্কস এই উপসংহার টেনেছেন। এবং এই সত্য থেকেই তারপর আসে প্রতিরোধ, সংগ্রাম, সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই।’[৫]
তাই শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত শ্রেণিসংগ্রামে মার্কসবাদ এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে গত দুটি শতক অতিবাহিত করেছে এবং সমতার যুগ সৃষ্টি পর্যন্ত তার আবেদন শ্রমিক শ্রেণির কাছে বিন্দুমাত্র ক্ষয়িষ্ণু হবে না। শ্রমিক শ্রেণির বা প্রলেতারিয়েতের মুক্তির মতবাদরূপে মার্কসবাদ তার পতাকা ওড়াতে থাকবে এই নীল গ্রহটির দশদিকে।[৬]
তথ্যসূত্র
১. মাও সেতুং; ১৯৬৪; দর্শন সম্পর্কে একটি আলোচনা, মাও সেতুঙের শেষ জীবনের উদ্ধৃতি, আন্দোলন প্রকাশনা, ঢাকা, মে, ২০০৫, পৃষ্ঠা, ২২।
২. মাও সেতুং; প্রদেশ, মিউনিসিপ্যাল ও স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলেরপার্টি কমিটিগুলোর সেক্রেটারিদের এক সম্মেলনে আলোচনা (১৯৫৭),পুর্বোক্ত, পৃষ্ঠা, ২২।
৩. ভি. আই. লেনিন; মার্কস-এঙ্গেলস-মার্কসবাদ; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; তারিখহীন; পৃষ্ঠা- ১৭-১৮।
৪. এ লিয়েনটিয়েভ, মার্কসীয় অর্থনীতি, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা লিমিটেড, কলকাতা, সেপ্টেম্বর ২০১৪, পৃষ্ঠা ১০
৫. মাও সেতুং; স্তালিনের ষাটতম জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ইয়েনানে সর্বস্তরের জনগণের সমাবেশে একটি ভাষণ থেকে, পুর্বোক্ত, পৃষ্ঠা, ২২।
৬. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] রচিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত মার্কসবাদ গ্রন্থের ১১-১৫ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশিত হলো।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।