ফ্যাসিবাদ শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরীর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু বাস্তবে তাদের জীবিকার মানকে আরোও নিম্নতর করেছে, ভিক্ষুকের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। ফ্যাসিবাদ বেকারদের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের কাছে অনাহারের তীব্র যন্ত্রণা ও বাধ্যতামুলক দাসসুলভ শ্রমকেই বহন করে এনেছে। প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদ শ্রমিকদের ও বেকার জনগণকে পুঁজিবাদী সমাজের অন্ত্যজে পরিণত করে, তাদের অধিকার হরণ করে, ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে বিনষ্ট করে, ধর্মঘটের অধিকার থেকে ও শ্রমিক শ্রেণির নিজস্ব সংবাদপত্র প্রকাশের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে, তাদের ফ্যাসিবাদী সংগঠনে যোগ দিতে বাধ্য করে, তাদের সামাজিক বীমার তহবিল লুট করে এবং মিল ও কারখানাগুলিকে ব্যারাকে পরিণত করে সেখানে পুঁজিবাদীদের অবাধ স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করে।
ফ্যাসিবাদ খেটে খাওয়া যুবকদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের এক প্রশস্ত পথের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু বাস্তবে এর পরিণাম হলো তরুণ শ্রমিকদের পাইকারী ছাঁটাই, শ্রমশিবির ও পররাজ্যগ্রাসী যুদ্ধের জন্য অবিরাম সামরিক কুচকাওয়াজ।
ফ্যাসিবাদ অফিস কর্মচারিদের, অধস্তন আমলাদের এবং বুদ্ধিজীবিদের জীবনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার, ট্রাস্টগুলির সর্বব্যাপক ক্ষমতা বিনষ্ট করার এবং ব্যাঙ্ক পুঁজির প্রয়াস নিশ্চিহ্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সে আগামী দিন সম্বন্ধে তাদের নৈরাশ্য ও নিশ্চয়তার মাত্রাকে আরও গভীর করে তুলেছে; তাদেরকে নিজেদের সবচেয়ে অনুগত অনুগামিদের দ্বারা গঠিত নতুন এক আমলাতন্ত্রের অধীন করেছে, ট্রাস্টগুলির এক অসহনীয় স্বৈরাচার গড়ে তুলেছে এবং এক অভূতপূর্ব পরিসরে দুর্নীতি ও অধঃপতনকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
ফ্যাসিবাদ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও দারিদ্র্য পীড়িত কৃষক সমাজের কাছে তাদের ঋণের বন্ধন ছিন্ন করার, খাজনা লোপ করার এবং এমনকি ভুমিহীন ও দুর্গত কৃষকদের স্বার্থে বিনা ক্ষতিপূরণে ভূসম্পত্তি হস্তান্তর করার অংগীকার করেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে মেহনতী কৃষকদেরকে ট্রাস্ট ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে এক অভূতপূর্ব দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ করছে এবং বড় বড় ভূস্বামী., ব্যাঙ্ক ও মহাজনদের দ্বারা কৃষক সমাজের এক ব্যাপক অংশের চুড়ান্ত শোষণকেই সাহায্য করছে। … …
কিন্তু এও সব নয়। প্রতিদিন ফ্যাসিবাদী জার্মানির বন্দী শিবিরগুলিতে, গেস্টাপোর (জার্মানির গুপ্ত পুলিশের) ভূগর্ভস্থ কক্ষে, পোল্যান্ডের নির্যাতন কক্ষে, বুলগেরিয়া ও ফিনল্যাণ্ডের গুপ্ত পুলিশের কারাগারে, বেলগ্রেডের “গ্লাভনিয়াচার”, রুমানিয়ার “সিগুরাঞ্জ”য় এবং ইতালির দ্বীপগুলিতে শ্রমিক শ্রেণি ও বিপ্লবী কৃষকদের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা, যারা মানবজাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করছে, অকথ্য নির্যাতন ও অপমানের সম্মুখীন হচ্ছে, যার সামনে জারদের গুপ্ত পুলিশের সমস্ত ঘৃণ্য কার্যাবলীও ম্লান হয়ে গেছে! ফ্যাসিবাদী জার্মান দুবৃত্তরা স্ত্রীদের চোখের সামনে তাদের স্বামীদের প্রহার করে রক্তমাখা মাংসপিণ্ডে পরিণত করে, এবং নিহত সন্তানদের দেহাবশেষ মোড়কে করে ডাক মারফৎ পাঠিয়ে দেয় তাদের জননীদের কাছে। নির্বীর্যকরণকে রাজনৈতিক যুদ্ধের এক পদ্ধতিতে পরিণত করা হয়েছে। নির্যাতন কক্ষগুলিতে ধৃত ফ্যাসিবিরোধীদের দেহে বিষ ইনজেকসন দেওয়া হয়, তাদের হাত ভেঙ্গে দেওয়া ও চোখ উপড়ে ফেলা হয়। তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয় ও দেহে জল পাম্প করা হয় এবং জীবন্ত দেহে ফ্যাসিবাদের প্রতীক স্বস্তিক চিহ্ন দেগে দেওয়া হয়।
বিপ্লবী যোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রেড এইড কর্তৃক সংগৃহীত জার্মানি, পোলান্ড ইতালি, অষ্ট্রিয়া, বুলগেরিয়া ও যুগোশ্লভিয়ায় নিহত, আহত, ধৃত এবং নির্যাতনের ফলে মূক ও মৃতের একটি পরিসংখ্যানের সংক্ষিপ্ত সার আমার সামনে আছে। কেবলমাত্র জার্মানিতেই, ন্যাশনাল সোশ্যালিস্টরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ৪,২০০’র বেশী ফ্যাসিবাদবিরেধী শ্রমিক, কৃষক, কর্মচারী এবং বুদ্ধিজীবিদের—যাদের মধ্যে কমিউনিস্ট, সোশ্যাল ডেমোক্রাট ও বিরোধী খৃস্টান সংস্থার সদস্যরা রয়েছেন— হত্যা করা হয়েছে; ৩,১৭,৮০০ জনকে গ্রেপ্তার ও ২,১৮,৬০০ জনকে আহত এবং চরম নির্যাতন ও যন্ত্রণার শিকার করা হয়েছে। অস্ট্রিয়াতে গত বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের যুদ্ধের পর, “খৃস্টান” ফ্যাসিবাদী সরকার ১,৯০০ বিপ্লবী শ্রমিককে হত্যা করেছে, ১০,০০০ জনকে আহত ও বিকলাঙ্গ করেছে এবং ৪০,০০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। কমরেডগণ, এই সংক্ষিপ্তসারও কিন্তু সম্পূর্ণ চিত্রের কাছাকাছিও পৌঁছায় না।
আরো পড়ুন
- যুক্তফ্রন্ট ও যুবসমাজ
- ট্রেড ইউনিয়ন ঐক্যের জন্য সংগ্রাম
- ময়মনসিংহে সাম্প্রতিক বর্ণবাদচর্চা
- ফ্যাসিবাদ-বিরোধী গণফ্রন্ট
- যুক্তফ্রন্টের সারবস্তু ও রূপ
- যুক্তফ্রন্ট-বিরোধীদের প্রধান যুক্তি
- যুক্তফ্রন্টের গুরুত্ব
- ফ্যাসিবাদ একটি হিংস্র কিন্তু অস্থিতিশীল শক্তি
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উৎস ও চরিত্র
- ফ্যাসিবাদের জয় কি অনিবার্য?
- বিজয়ী ফ্যাসিবাদ জনগণের জন্য কী বহন করে আনে?
- ফ্যাসিবাদের শ্রেণি চরিত্র
- সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদী চিন্তা হচ্ছে আগ্রাসনবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী
- সুভাষচন্দ্র বসুর রাষ্ট্রচিন্তা হচ্ছে স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ও জাতীয় মুক্তি
বিভিন্ন ফ্যাসিবাদী দেশে মেহনতী জনগণ যে অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করছে তার চিন্তা যে ঘৃণা ও ক্রোধের সঞ্চার করে তার বর্ণনা করতে আমার কথা হারিয়ে যায়। উপরোক্ত পরিসংখ্যান কিন্তু অসংখ্য পুঁজিবাদী দেশে শ্বেত সন্ত্রাস শ্রমিক শ্রেণির নিত্যকার জীবনে যে অসহনীয় শোষণ ও নির্যাতন সৃষ্টি করেছে তার প্রকৃত চিত্রের এক-শতাংশকেও প্রতিফলিত করে না। ফ্যাসিবাদের দ্বারা মেহনতী জনগণের অপরিমেয় নির্যাতনের আসল স্বরূপ অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যেও বোধ হয় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। … …
কমরেডগণ, লেনিন আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, হয়ত বুর্জোয়ারা অল্প সময়ের জন্য পাশবিক সন্ত্রাসের দ্বারা মেহনতী জনগণকে পরাস্ত করতে, বিপ্লবী শক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশকে প্রতিহত করতে সমর্থ হবে, কিন্তু এই সব সত্ত্বেও এই পাশবিক সন্ত্রাস তাকে চূড়ান্ত বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
লেনিন লিখেছিলেন:
“জীবন নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে। ক্ষিপ্ত বুর্জোয়াদের উন্মত্তের মত আচরণ করতে দাও, চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে তারা চরম মূর্খতার পরিচয় দিক, আগে থেকেই বলশেভিকদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করুক এবং (যেমন ভারত, হাঙ্গেরী, জার্মানি ইত্যাদিতে) শত, সহস্র, লক্ষ লক্ষ বিগত কালের ও আগামী দিনের বলশেভিককে তারা হত্যা করার প্রচেষ্টা চালাক। কিন্তু এই কাজ করে বুর্জোয়ারা ইতিহাসের অভিশপ্ত শ্রেণিগুলির অনুরূপ ভূমিকাই গ্রহণ করছে। কমিউনিস্টদের জানতে হবে যে যাই হোক, ভবিষ্যত তাদেরই। আর সেইজন্যই আমরা মহান বিপ্লবী সংগ্রামের তীব্র আবেগের সঙ্গে বুর্জোয়াদের ক্ষিপ্ত উন্মত্ততার অত্যন্ত শান্ত ও সংযত মূল্যায়নের সংযোগ সাধন করতে পারি এবং তা আমাদের করতেই হবে।
ভি আই লেনিন, ‘বামপন্থী কমিউনিজম—শিশুদের রোগ’ —নির্বাচিত রচনা—মস্কো-সংস্করণ, খণ্ড ২, পৃ. ৬৩৩)
হ্যাঁ, যদি আমরা এবং সমগ্র বিশ্বের সর্বহারারা দৃঢ়তার সঙ্গে লেনিন ও স্তালিন প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করি তাহলে সব কিছু সত্ত্বেও বুর্জোয়াদের পতন হবেই।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।