ভ্যানগার্ডবাদ বা ভ্যানগার্ড পার্টি বা মার্কসবাদী বলশেভিক ভ্যানগার্ড পার্টি বা সাম্যবাদী অগ্রদূত বা বিস্তৃত অর্থে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির অগ্রগামী বাহিনী (ইংরেজি: Vanguardism) গঠন বিষয়ে ভি আই লেনিন গুরুত্ব দিয়েছিলেন খুব বেশি। বিপ্লবী কাজকর্মের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত থাকার কারণে লেনিনের মনে এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে বিপ্লবকে সফল করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন, আর এর জন্য প্রয়োজন হয় একটি রাজনৈতিক দলের।[১]
ভি আই লেনিনের পার্টি গঠন চেষ্টার শুরুর দিকে পার্টির নাম ছিলো রুশ সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি। যদিও ১৮৯৮ সালে এই পার্টির প্রথম কংগ্রেস বসে এবং সেখানে গঠিত হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তখনও পার্টি গড়ে ওঠেনি। তখন পার্টির কোনো কর্মসূচি বা নিয়ম-কানুন ছিল না। প্রথম কংগ্রেসে যে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয় তারা গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের স্থানে আর কেউ নির্বাচিত হয়নি, তাদের স্থান নেবার মতো কেউ ছিল না। তার চেয়েও খারাপ কথা এই যে, প্রথম কংগ্রেসের পর দলের নীতি সম্বন্ধে ও সংগঠন সম্বন্ধে ঐক্যবোধের অভাব আরও বেশি লক্ষ্য করা যায়। সেই পার্টি একটি মার্কসবাদী পার্টি হিসেবে গড়ে ওঠে মূলত দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর থেকে।
কেন্দ্রীকতাবাদী দৃঢ়-সংগঠিত একটি ভ্যানগার্ডবাদ নির্ভর লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার লক্ষ্যে লেনিন কয়েকটি পুস্তক রচনা করে মতাদর্শিক ভিত্তি তৈরি করেছিলেন। লেনিনের কী করতে হবে? পুস্তকটি ছিলো পার্টি গড়ে তোলার মতাদর্শগত প্রস্তুতি, তাঁর এক পা আগে দুই পা পিছে বইটি ছিলো পার্টি গড়ে তোলার সাংগঠনিক প্রস্তুতি, তাঁর গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাসির দুই রণকৌশল বইটি ছিলো পার্টি গড়ে তোলার রাজনৈতিক প্রস্তুতি, তেমনি তাঁর বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ-বিচারবাদ বইটি হয়েছিলো পার্টি গড়ে তোলার তত্ত্বগত প্রস্তুতি।[২]
ভ্যানগার্ডবাদ বা ভ্যানগার্ড পার্টি
অগ্রণী বাহিনী বা ভ্যানগার্ডবাদ বা কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করার ক্ষেত্রে লেনিন গুরুত্ব দিয়েছিলেন পার্টির প্রকৃতি, শ্রমিক শ্রেণির সম্পর্কে তার ভূমিকা এবং তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে। লেনিন মত ছিল যে, পার্টিকে হতে হবে শ্রমিক শ্রেণির অগ্রণী বাহিনী, সর্বহারা শ্রেণিসংগ্রামের সমন্বয়সাধনে ও পরিচালনায় ব্রতী এই পার্টিকে হতে হবে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের পথ প্রদর্শক শক্তি। লেনিনবাদী পার্টি সাধারণ প্রলেতারিয়েতের অগ্রগামি বাহিনী যাকে লেনিন ভ্যানগার্ড পার্টি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মার্কস এবং এঙ্গেলস কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারের প্রলেতারিয়রা এবং কমিউনিস্টরা অংশে লিখেছিলেন,
“কমিউনিস্টরা হলো একদিকে কার্যক্ষেত্রে প্রতি দেশের শ্রমিক শ্রেণির পার্টিগুলোর সর্বাপেক্ষা অগ্রসর ও দৃঢ়চিত্ত অংশ_ যে অংশ অন্যান্য সবাইকে সামনে ঠেলে নিয়ে যায়, অপরদিকে তত্ত্বের দিক দিয়ে প্রলেতারিয়েতের অধিকাংশের তুলনায় তাদের এই সুবিধা যে, প্রলেতারিয় আন্দোলনের এগিয়ে যাওয়ার পথ, শর্ত এবং শেষ সাধারণ ফলাফল সম্বন্ধে তাদের স্বচ্ছ ধারনা রয়েছে।
কমিউনিস্টদের আশু লক্ষ্য অন্য সমস্ত প্রলেতারিয় পার্টির উদ্দেশ্য থেকে অভিন্নঃ প্রলেতারিয়েতকে শ্রেণি রূপে গঠন করা, বুর্জোয়া আধিপত্যের উচ্ছেদ, প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার।”
পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করাই হলো কমিউনিস্ট পার্টির চরম লক্ষ্য। ইস্ক্রা প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই লেনিন এই মত পোষণ করতেন যে, এখনই জারতন্ত্রের নিপাত ঘটাতে না পারিলে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ সম্ভব নয়। তখনই পার্টির প্রধান কর্তব্য ছিল শ্রমিক শ্রেণি ও সমগ্র জনসমষ্টিকে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করা, জনগণের বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলা এবং সমাজতন্ত্রের রাস্তায় প্রথম গুরুতর প্রতিবন্ধক যে জারতন্ত্র তার বিলোপ ঘটানো। লেনিন লিখেছেন,
‘যে কোন দেশের সর্বহারার যে সব আশু কর্তব্য উপস্থিত, তাদের মধ্যে সর্বাধিক বৈপ্লবিক যে কর্তব্য তাই ইতিহাস আমাদের সম্মুখে উপস্থিত করেছে। এই কর্তব্য পালন করতে পারলে অর্থাৎ শুধু ইউরোপ নয়, (আজ বলা যায়) সমস্ত এশিয়ার বিপ্লব বিরোধী শক্তির সবচাইতে মজবুত কেল্লাকে ধ্বংস করতে পারলে রুশ সর্বহারা সারা দুনিয়ার বিপ্লবী সর্বহারাদের মধ্যে অগ্রণী বাহিনীতে পরিণত হবে।’[৩]
তিনি আরো বলেছেন, ‘আমাদের কাজ বিপ্লবীকে অপেশাদার পর্যায়ে উন্নীত করা নয়, অপেশাদারদের বিপ্লবীদের পর্যায়ে উন্নীত করা’।
তিনি আরও বলেছেন আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণ রাখতে হবে যে, আংশিক দাবির জন্য সরকারের সঙ্গে লড়াই বা ছোটখাটো দাবির আংশিক পূরণ শত্রুর সঙ্গে সামান্য হাতাহাতি বা শত্রু সীমান্তে খণ্ডযুদ্ধ ছাড়া কিছু নয়; কিন্তু চূড়ান্ত সংগ্রামের এখনও বিলম্ব আছে। সমস্ত শক্তি নিয়ে শত্রু দুর্গ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত রয়েছে, আমাদের ওপর গোলাগুলি বর্ষণ করছে আমাদেরই শ্রেষ্ঠ সৈনিকদের হত্যা করছে। আমাদের এই দুর্গ দখল করতেই হবে; এবং আমরা যদি জাগরণোম্মুখ সর্বহারাদের সমস্ত শক্তির সঙ্গে রুশ বিপ্লবীদের সমস্ত শক্তিকে এমন একটি পার্টিতে মিলাতে পারি যা রুশদেশের সমস্ত প্রাণবন্ত ও অকপট লোককে আকৃষ্ট করে, তা হলে আমরা নিশ্চয়ই এই দুর্গ জয় করব। আর শুধু তখনই বিপ্লবী রুশ শ্রমিক পিওতর এলেকসিয়েভের মহৎ ভবিষ্যৎ বাণী সফল হবে: কোটি কোটি শ্রমিকের পেশীবহুল বাহু উত্থিত হইবে এবং অত্যাচারের যে যুপকাষ্ঠকে সৈনিকের তরবারি রক্ষা করছে তা চূর্ণ হয়ে অণুপরমাণুতে পর্যবর্ষিত হবে।[৪]
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, ২৮ এপ্রিল ২০১৯, “মার্কসবাদী বলশেভিক ভ্যানগার্ড পার্টি গঠন সম্পর্কে লেনিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/ideology/leninism/on-marxist-party/
২. অমল দাশগুপ্ত, কমরেড লেনিন, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, এনবিএ-র প্রথম সংস্করণ, ২০১৩, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১৭৪
৩. ভি আই লেনিন, সিলেকটেড ওয়ার্কস, রুশ সংস্করণ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২।
৪. ভি আই লেনিন, সিলেকটেড ওয়ার্কস, রুশ সংস্করণ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা উনিশটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।