সাম্যের বিভিন্ন রকমের প্রকারভেদ হচ্ছে স্বাভাবিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি

সাম্যের ধারণাটির বিভিন্ন রকমের ধরন বা প্রকারভেদ (ইংরেজি: Types of equality) রয়েছে। সাম্য নামক এই সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্বটির সূক্ষ্ম বিচারের খাতিরে এটির বিভিন্ন রূপ কী সে প্রশ্নও পাঠকের বিবেচনায় থাকা দরকার। সাম্যকে প্রধানত স্বাভাবিক সাম্য, সামাজিক সাম্য, রাজনৈতিক সাম্য, আর্থনৈতিক সাম্য, নাগরিক সাম্য —এই ভাবে শ্রেণিবিভক্ত করা যায়।

সাম্যের প্রকারভেদ

ক. স্বাভাবিক সাম্য (Natural Equality): স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক সাম্য হচ্ছে, প্রকৃতি সবাইকে সমানভাবে সৃষ্টি করেছে। প্লেটো বা এরিস্টটলের অসাম্যের ভাবনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নির্বিকারবাদী দার্শনিকেরা (Stoic Philosophers) রোমক চিন্তাবিদ সিসেরো, খ্রিস্টিয় ভাবনায় ‘পিতা ঈশ্বরের রাজ্যে মানুষের অবস্থান ভ্রাতৃপ্রতিম’ এই ধারণা প্রচার পেয়েছে। রুশো তাঁর ‘Discourse on the Origin of Inequality’ তে বলেছেন নৈতিক ও সরল মানুষ কীভাবে সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ভেদাভেদ ও বৈষম্যের সম্মুখীন হলো।

খ. সামাজিক সাম্য (Social Equality): প্রাকৃতিক সাম্য সাম্যের এক আদর্শ ও নৈতিক অবস্থান। সামাজিক সাম্য বাস্তবে সাম্য কী তার কথা বলে। সাম্য ছাড়া যে মানুষের সামাজিক অস্তিত্বই বিপন্ন সামাজিক সাম্যে একথাই বলা হয়েছে। কোনো কৃত্রিম কারণ যথা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ, লিঙ্গ বা শ্রেণি ভেদাভেদে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ করা চলে না। শিক্ষার সমতা, সামাজিক ক্ষেত্রে সমান নিরাপত্তা এই সাম্যের দৃষ্টান্ত।

(গ) রাজনৈতিক সাম্য (Political Equality): রাজনৈতিক সাম্য হলো ক্ষমতার অলিন্দে সকলের সমান প্রবেশাধিকার। রাজনীতির গণতান্ত্রিক পরিবেশ রাজনৈতিক সাম্যের প্রধান শর্ত। রাষ্ট্র শাসনে শ্রেষ্ঠত্ব, প্রভুত্ব, ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীভবন রাজনৈতির সাম্যের অন্তরায়। ভোটাধিকার, আইনের চোখে সমানাধিকার (Equality before law), সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগ রাজনৈতিক সাম্যের কিছু দৃষ্টান্ত।

(ঘ) অর্থনৈতিক সাম্য (Economic Equality): অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া অন্যান্য সাম্য অর্থহীন। কাজের অধিকার, মজুরির অধিকার, বেকারত্ব ও বার্ধক্যে নিরাপত্তা অর্থনৈতিক সমতার দাবি করে। অর্থনৈতিক ক্ষমতা কতিপয়ের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া, সমান কাজ ও পরিশ্রমে সমান মজুরির ক্ষেত্রে ভেদাভেদ, কাজের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, কাজের ক্ষেত্রে অবসর বা নিরাপত্তার অভাব অর্থনৈতিক সাম্যের ধারণাকে কলুষিত করে।

(ঙ) নাগরিক সাম্য (Civil Equality): নাগরিক সাম্যের উৎপত্তি হয়েছে নাগরিক অধিকারকে কেন্দ্র করে। সকল নাগরিকের সমানভাবে নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করাকে নাগরিক সাম্য বলা হয়। মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক জীব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক সকল সামাজিক অধিকার সমানভাবে ভোগ করে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা নাগরিক অধিকার নির্ধারিত হয়।

(চ) সাম্যের অন্যান্য ক্ষেত্র (Other areas of Equality): সমতার অন্যান্য কতকলি ক্ষেত্র হলো সঠিক আইনি ও বিচারব্যবস্থার উপস্থিতি, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, জাতিরাষ্ট্রের ভেদাভেদ ও বৈষম্যের অনুপস্থিতি এবং মানবাধিকার রক্ষার উপযুক্ত আওর্জাতিক বাতাবরণ। ব্যক্তিগত সামর্থ্যে প্রত্যেকেই যাতে সমানভাবে তার অধিকার ভোগ করতে পারে। সমতার প্রশ্নে সেটিও এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায় যে, সার্বিক বিশ্লেষণে সাম্যের বিভিন্ন রকমের প্রকারভেদ হিসেবে উপরোক্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। ব্যক্তিত্ব বিকাশে উল্লেখিত সাম্যগুলো অপরিহার্য। উল্লেখিত সাম্যগুলো বাস্তবায়িত করা সম্ভব হলে ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষ বিকাশের পথ সুগম হবে। এগুলোর কোনো একটিকে উপেক্ষা করা চলে না।

তথ্যসূত্র

১. দেবাশীষ চক্রবর্তী, রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়সমূহ, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ৪৭-৪৯।
২. মো. আবদুল ওদুদআলেয়া পারভীন, রাজনৈতিক তত্ত্বের পরিচিতি, মনন পাবলিকেশন, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ আগস্ট ২০১১, পৃষ্ঠা ১৪৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!