প্রিয় আ. ম.[১]! কী করছেন আপনি? এ-যে একেবারে ভয়ানক ব্যাপার, ঠিক তাইই বটে!
দস্তয়েভস্কি-কে[২] নিয়ে ‘হাহুতাশে’[৩] আপনার জবাব কাল ‘রেচ’-এ পড়ে আমি আনন্দে ভরে উঠতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আজ এল লুপ্তিপন্থীদের কাগজটা, এতে রয়েছে আপনার প্রবন্ধটার একটা অনুচ্ছেদ যা ‘রেচ’-এ ছিল না।
অনুচ্ছেদটা এই:
‘আর “ঈশ্বর সন্ধান”[৪] আপাতত’ (শুধু আপাতত ?) ‘সরিয়ে রাখা দরকার — ঐ কর্মে কোনো ফায়দা হবার নয়: যেখানে কিছুই পাবার নেই সেখানে সন্ধান করে কোনো ফায়দা নেই। বীজ না বুনলে ফসল তোলা যায় না। ঈশ্বর নেই, এখনও’ (এখনও!) ‘সৃষ্টি করা হয় নি। ঈশ্বরদের অনুসন্ধান করতে হয় না — তাদের সৃষ্টি করতে হয়; মানুষে জীবন উদ্ভাবন করে না — জীবন তারা সৃষ্টি করে।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে আপনি ‘ঈশ্বরসন্ধানের’ বিরুদ্ধে শুধু ‘আপাতত’!! দেখা যাচ্ছে আপনি ঈশ্বরসন্ধানের বিরুদ্ধে শুধু সেটার জায়গায় ঈশ্বর-গঠন আমদানি করার জন্যে!!
আচ্ছা, আপনার প্রবন্ধে এমন জিনিস বেরল এটা ভীষণ ব্যাপার নয় কি?
ঈশ্বর-গঠন কিংব ঈশ্বর-সৃষ্টি কিংবা ঈশ্বর-প্রস্তুতকরণ, ইত্যাদি থেকে ঈশ্বরসন্ধানের পার্থক্যটা নীল শয়তান থেকে হলদে শয়তানের পার্থক্যের চেয়ে বড় নয়। সমস্ত শয়তান আর দেবতার বিরুদ্ধে, যে কোনো মতাদর্শগত শবসাধনার বিরুদ্ধে (কোন দেবতা সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, সবচেয়ে আদর্শস্থানীয়, খুঁজে বের-করা নয় কিন্তু গড়ে-তোলা হোক সেটা একই কথা, কোনো দেবতার যে কোনো আরাধনাই শবসাধনা) ঘোষণার জন্যে নয়, কিন্তু হলদে শয়তানের চেয়ে নীল শয়তানকে শ্রেয় বলে ধরার জন্যে ঈশ্বরসন্ধান সম্বন্ধে কথা বলাটা এই বিষয়ে আদৌ কিছুই না বলার চেয়ে শতগুণ নিকৃষ্ট।
সবচেয়ে মুক্ত দেশগুলিতে, যেসব দেশে ‘গণতন্ত্র, জনসাধারণ, জনমত এবং বিজ্ঞানের’ শরণ লওয়া একেবারেই অবান্তর, এমনসব দেশে (আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, ইত্যাদিতে) পরিচ্ছন্ন, পারমার্থিক, গড়ে-তোলা ঈশ্বর সংক্রান্ত এই ধারণাটা দিয়েই জনসাধারণ আর শ্রমিকদের ঝিমিয়ে দেবার জন্যে বিশেষ উৎসাহ খাটান হয়। যেহেতু যে কোনো ধর্মীয় ধ্যানধারণা, আদৌ যে কোনো দেবতা সংক্রান্ত যে কোনো ধারণা, এনকি কোনো দেবতা নিয়ে যে কোনো ঢলাঢলিও সবচেয়ে অকথ্য নোংরামি, যা বিশেষ সহিষ্ণুতা সহকারে (অনেক সময়ে আনুকূল্যের সঙ্গেই) গ্রহণীয় গণতান্ত্রিক বুর্জোয়াদের কাছে – ঠিক এই কারণেই সেটা বিপজ্জনক নোংরামি, সবচেয়ে লজ্জাকর ‘সংক্রমণ’। লক্ষ-লক্ষ দৈহিক অপরাধ, জঘন্য ফাঁকিবাজি, জবরদস্তি আর সংক্রমণ জনতা ধরে ফেলতে পারে ঢের বেশি সহজে, তাই সেগুলো অনেক কম বিপজ্জনক সবচেয়ে মনোহর ‘মতাদর্শগত’ সাজ পরানো ঈশ্বর-সংক্রান্ত সূক্ষ্ম-চতুর পারমার্থিক ধারণার চেয়ে। যে-পাদরি পাদরির পোশাক পরে না, যে-পাদরি চলে স্থূল ধর্ম ছাড়াই, মতাদর্শ দিয়ে সজ্জিত এবং গণতন্ত্রী যে-পাদরি কোনো ঈশ্বর সৃষ্টি এবং উদ্ভাবনের প্রচার চালায় তার চেয়ে অনেক কম বিপজ্জনক হলো — বিশেষত ‘গণতন্ত্রে’র পক্ষে — তরুণীদের বিপথগামিনী করে যে-ক্যাথলিক পাদরি (তার সম্বন্ধে আমি আপতিকভাবে সবে পড়লাম একটা জার্মান সংবাদপত্রে)। কেননা আগের পাদরির স্বরূপ খুলে ধরে নিন্দা করে তাকে বিতাড়িত করা যায় সহজেই, কিন্তু অত সহজে বিতাড়িত করা যায় না পরেরটাকে; এর স্বরূপ খুলে ধরা ১০০০-গুণ বেশি কঠিন, আর তাকে ‘নিন্দা করতে’ রাজি হবে না একজনও ‘দুর্বলচিত্ত এবং জঘন্যভাবে দোলায়মান’ কূপমণ্ডূক।
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে একটি আলোচনা দেখুন
আর আপনি কিনা (রুশী: রুশী কেন? ইতালীয় কি অপেক্ষাকৃত কিছু ভাল?) কূপমণ্ডূক অন্তরাত্মার ‘দুর্বলচিত্ত এবং জঘন্যভাবে দোলায়মানতা’র কথা জেনে সেই অন্তরাত্মাকে গুলিয়ে ফেলছেন সবচেয়ে মিষ্টি বিষের সঙ্গে, যা ললিপপ্-এ এবং হরেক রকমের রংবেরং মোড়কে লুকানো থাকে খুবই কার্যকর উপায়ে!!
এ বাস্তবিকই ভয়ানক ব্যাপার।
‘ঢের হয়েছে আত্ম-অবমাননা, যা হলো আত্মসমালোচনার জন্যে আমাদের প্রতিকল্প’
ঈশ্বর-গড়া নয় কি সবচেয়ে নিকৃষ্ট রকমের আত্ম-অবমাননা? যে কেউ কোনো ঈশ্বর গড়তে লাগেন তিনি, কিংবা এমন কাজকর্ম যিনি শুধু বরদাস্ত করেন তিনিও নিজের অবমাননা করেন যারপরনাই নিকৃষ্ট ধরনে, কেননা ‘কৃতি’র বদলে তিনি প্রকৃতপক্ষে ব্যাপৃত রয়েছেন আত্ম-পরিচিন্তনে, আত্মশ্লাঘায়, অধিকন্তু, ঈশ্বর-গড়া দিয়ে দেবত্বারোপিত ‘অহম’-এর সবচেয়ে নোংরা, সবচেয়ে নির্বোধ, হীনতম উপাদান বা প্রলক্ষণগুলো নিয়েই এমন ব্যক্তির ‘পরিচিন্তন’।
ব্যক্তির নয়, সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত রকমের ঈশ্বর-গঠন হলো ঠিক মাথামোটা কূপমণ্ডূকের, সাধারণ দুর্বলচিত্ত মানুষের নির্বোধ আত্মপরিচিন্তনই, অর্বাচীন পেটি বুর্জোয়ার স্বপ্নাবিষ্ট ‘আত্ম-অবমাননা’, যে পেটি বুর্জোয়া ‘অবসন্ন এবং হতাশাগ্রস্ত’ (যা আপনি সদয় হয়ে খুব ঠিকই বলেছেন ঐ অন্তরাত্মা সম্বন্ধে: শুধু আপনার বলা দরকার ছিল ‘রুশী’ নয়, তার বদলে পেটি-বুর্জোয়া, কেননা ইহুদি, ইতালীয়, ইংরেজ রকমরেফগুলো সবই সেই একই অভিন্ন শয়তান; দুর্গন্ধী কূপমণ্ডূকতা সর্বত্র সমানই ন্যক্কারজনক — কিন্তু বিশেষত ন্যক্কারজনক হলো মতাদর্শগত শবসাধনায় ব্যাপৃত গণতান্ত্রিক কূপমণ্ডূকতা)।
আপনার প্রবন্ধটি বারবার পড়ে এবং কোথা থেকে আসতে পারে আপনার এই মুখ-ফসকানি সেটা বের করার চেষ্টা করতে গিয়ে আমার ধাঁধা লাগছে। কী বোঝাচ্ছে এতে? যা আপনি নিজে অনুমোদন করেন নি সেই ‘স্বীকারোক্তি’র অবশেষ?? কিংবা সেটার প্রতিধ্বনি??
কিংবা ভিন্ন কিছু: যেমন, প্রলেতারিয়েতের দৃষ্টিভঙ্গির বদলে সাধারণভাবে গণতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে বেঁকে ফিরে যাবার ব্যর্থ চেষ্টা? হয়ত ‘সাধারণভাবে গণতন্ত্র’ নিয়ে কথা বলার জন্যে আপনি (মাফ করবেন কথাটার জন্যে) সাধ মিটিয়ে খোকা-বুলি বলতে মনস্থ করেছিলেন? কূপমণ্ডূকদের কাছে ‘জনবোধ্য ব্যাখ্যানের জন্যে’ই হয়ত আপনি তাদের, কূপমণ্ডূকদের বদ্ধধারণাগুলো মুহূর্তের জন্যে মেনে নিতে মনস্থ করেছিলেন?
কিন্তু তাহলে সেটা সমস্ত অর্থে এবং সমস্ত দিক দিয়ে ভ্রান্ত দৃষ্টিপাত!
উপরে আমি লিখেছি, গণতান্ত্রিক দেশে কোনো প্রলেতারিয়ান লেখকের পক্ষে ‘গণতন্ত্র, জনসাধারণ, জনমত এবং বিজ্ঞানের’ শরণ নেওয়াটা একেবারেই অবান্তর। আচ্ছা, কিন্তু রাশিয়ায় আমাদের বেলায় অবস্থাটা কী? অমন শরণ নেওয়াটা উপযোগী নয় সম্পূর্ণত, কেননা সেটা কোনো-কোনোভাবে কূপমণ্ডূকদের বদ্ধধারণাগুলোকেও তোষণ যোগায়। সাধারণ গোছের আবেদন হলে, এতই সাধারণ যাতে সেটা অস্পষ্টতার কিনারে — তাতে ‘রুস্কায়া মিসল’-এর[৫] ইজগোয়েভ[৬] পর্যন্ত সই দেবেন দুহাত দিয়ে। তাহলে কেন বেছে নিলেন এমনসব নীতিবাক্য যেগুলিকে আপনি চমৎকার পৃথক করে বুঝতে পারেন ইজগোয়েভ-এর নীতিবাক্য থেকে, কিন্তু পাঠক পৃথক করে বুঝে নিতে পারবেন না?? (যারা শরিফ মেজাজে থাকতে জানে কথায়ই শুধু নয়, যারা নিজেদেরটা থেকে বুর্জোয়াদের ‘বিজ্ঞান আর জনমত’, প্রলেতারিয়ান গণতন্ত্র থেকে বুর্জোয়া গণতন্ত্র পৃথক করে বুঝে নিতে পারে সেই) প্রলেতারিয়ানদের থেকে (দুর্বলচিত্ত, জঘন্যভাবে দোলায়মান, অবসন্ন, হতাশাগ্রস্ত, আত্ম-পরিচিন্তনরত, ঈশ্বরচিন্তারত, ঈশ্বর-গঠনকারী, ঈশ্বর-তোষণকারী, আত্ম-অবমাননাকারী, না-বোধগম্যভাবে-নৈরাজ্যবাদী ― অতি চমৎকার শব্দ বটে!! ইত্যাদি, ইত্যাদি) কূপমণ্ডূকদের স্পষ্ট পৃথক করে না ধরে প্রশ্নটার উপর পাঠকদের সামনে একটা গণতান্ত্রিক পরদা টেনে দেওয়াটা কেন?
এমনটা করলেন কেন?
ঘোর হতাশাজনক ৷
ভবদীয় ভ. ই.
পুনশ্চ : রেজিস্ট্রি-করা বুক-পোস্টে উপন্যাসখানা আমরা আপনার কাছে পাঠিয়েছি। পেয়েছেন?
পুনঃপুনশ্চ: আমাদের অনুরোধ, দেখবেন আপনার চিকিৎসাটা যথাসম্ভব ভাল হয় যেন, যাতে শীতকালে ভ্রমণ করতে পারেন কিন্তু ঠাণ্ডা না লাগে (শীতকালে তা বিপজ্জনক)।
আরো পড়ুন
- ধর্ম প্রসঙ্গে গ্রন্থের রুশ সংস্করণের ভূমিকা
- লেনিনবাদী বিশ্বদৃষ্টিতে ধর্ম
- সংগ্রামী বস্তুবাদের তাৎপর্য
- যুব লীগের কর্তব্য
- রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-এর খসড়া কর্মসূচি থেকে ধর্ম প্রসঙ্গে
- নারী-শ্রমিকদের প্রথম সারা রুশ কংগ্রেসে বক্তৃতা
- মাক্সিম গোর্কির কাছে
- মাক্সিম গোর্কির কাছে
- ধর্ম এবং যাজনতন্ত্রের প্রতি মনোভাব অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণি আর পার্টি
- ধর্ম প্রসঙ্গে শ্রমিক পার্টির মনোভাব
- লেভ তলস্তয় – রুশ বিপ্লবের দর্পণ
- সমাজতন্ত্র ও ধর্ম
- লেনিন রচিত ধর্ম প্রসঙ্গে বইয়ের পূর্বকথা ও সূচিপত্র
ভবদীয় ভ. উলিয়ানভ
লেখা হয় ১৯১৩ সালে ১৩ কিংবা ১৪ নভেম্বর।
পাঠান হয় ক্রাকোভ থেকে ইতালির কাপ্রিতে।
টিকা
১. গোর্কি, (পেশকভ) আলেক্সেই ম্যাক্সিমভিচ (১৮৬৮-১৯৩৬) — রুশ লেখক, সোভিয়েত সাহিত্যের জনক।
২. দস্তয়েভস্কি, (১৮২১-১৮৮১) — রুশ লেখক।
৩. দস্তয়েভস্কি-র প্রতিক্রিয়াশীল উপন্যাস দানবেরা মস্কো আর্ট থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল, তাতে আ. ম. গোর্কি সংবাদপত্রে যে-প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন সেই কথা বলছেন লেনিন।
৪. ঈশ্বর-গড়া, বা ভগবান গঠন বা ভগবান-সন্ধান — মার্কসবাদের বিরোধী ধর্মীয়-দার্শনিক এক ধারা। ১৯০৭ থেকে ১৯১০ সালের স্তলিপিন প্রতিক্রিয়াশীলতার সময় এই ধারাটির উদ্ভব হয় এমন কিছু, পার্টি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাদের মার্কসবাদ থেকে বিচ্যুতি ঘটে ১৯০৫-১৯০৭ সালের বিপ্লবের পরাজয়ের পর। ঈশ্বর-গড়িয়েরা নতুন ‘সমাজতান্ত্রিক ধর্ম সৃষ্টির কথা বলত, চেষ্টা করত ধর্মের সঙ্গে মার্কসবাদের আপস করাতে। ১৯০৯ সালের জুন মাসে ‘প্রলেতারি’র সম্পাদকমণ্ডলীর এক বর্ধিত সভায় ইশ্বর-গড়ার নিন্দা করে বিশেষ এক সিদ্ধান্তে বলা হয় যে, ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের এমন ধরনের বিকৃত ভাবধারার সঙ্গে বলশেভিক গ্রুপের কোনো সম্পর্ক নেই।
৫. রুস্কায়া মিসল (রুশী চিন্তা) কাদেত দক্ষিণ তরফের একটা পত্রিকা।
৬. ইজগোয়েভ, (লান্দে), আলেক্সান্দ্র সলমোনভিচ (১৮২১-১৮৮১) — কাদেতী পার্টির মতাদর্শী।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (২২ এপ্রিল, ১৮৭০ – ২১ জানুয়ারি, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।