কার্ল মার্কসের বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব (ইংরেজি:Theory of alienation) জনগণের বিচ্ছেদকে (ইংরেজি: estrangement, জার্মান: Entfremdung) মানব প্রকৃতির বিশেষ দিক হিসেবে আলোচনা করে এবং বলে যে বিচ্ছিন্নতা সামাজিক শ্রেণিতে স্তরীভূত সমাজে বসবাস করার একটি পরিণতি। মার্কস পুঁজিবাদী সমাজের দুই প্রধান ত্রুটি শোষণ ও বিচ্ছিন্নতার ধারণা দিয়েছেন। ব্যক্তিমালিকানার ওপর প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকেই হয় শোষণের সৃষ্টি এবং শোষণের থেকেই উদ্ভব ঘটে বিচ্ছিন্নতার।
মার্কসবাদ মনে করে, পুঁজিবাদে মানুষের সৃষ্টি হয়ে ওঠে সেই মানুষের বিরুদ্ধেই বিচ্ছিন্ন শক্তি (alien power)। মার্কস ও এঙ্গেলস পুঁজিবাদের অবসানের মধ্য দিয়ে বিচ্ছিন্ন সম্পর্কের অবসানের (ইংরেজি: abolition of the alien attitude) কথা বলেন। মার্কস বিচ্ছিন্নতার ধারনার যে বিরোধিতা করেছেন তার মধ্যেও সে পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি পুঁজির পরিচালক ভূমিকার বিরোধিতা করেন। পুঁজির সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার জন্য তিনি পুঁজিবাদের সমালোচনা করেন। অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০) বলেছিলেন যে ‘যদি দরকার পড়ে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদনশীল শ্রমকে কাজে লাগানোর জন্য মজুদিকৃত ও পুঞ্জিভূত রাখা যায়’।[১] কার্ল মার্কস এ থেকেই পুঁজিকে বলেন পুঞ্জিভূত শ্রম[২] (ইংরেজি: stored-up labour) বা মৃত শ্রম। পুঁজিবাদী সমাজে এই মৃত শ্রম বা পুঁজি, যা হলও অতীত, আধিপত্য করে বর্তমানের উপর। মার্কস ও এঙ্গেলস বলেন,
“বুর্জোয়া সমাজে জীবন্ত পরিশ্রম পূর্বসঞ্চিত পরিশ্রম [পুঁজি] বাড়াবার উপায়মাত্র। কমিউনিস্ট সমাজে কিন্তু পূর্বসঞ্চিত পরিশ্রম শ্রমিকের অস্তিত্বকে উদারতর, সমৃদ্ধতর, উন্নততর করে তোলার উপায়।
সুতরাং বুর্জোয়া সমাজে বর্তমানের উপরে আধিপত্য করে অতীত; সাম্যবাদী সমাজে বর্তমান আধিপত্য করে অতীতের উপর। বুর্জোয়া সমাজে পুঁজি হলওস্বাধীন, স্বতন্ত্র-সত্ত্বা, কিন্তু জীবন্ত মানুষ হলও পরাধীন, স্বতন্ত্র-সত্ত্বাবিহীন।”[৩]
একটি পুঁজিবাদী সমাজে, শ্রমিকের মানবতা থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতা ঘটে কারণ কারণ শ্রমিকগণ কেবল শ্রম প্রকাশ করতে পারেন আর সেই শ্রম হচ্ছে একটি নিজস্ব ব্যক্তিস্বভাবের সামাজিক দিক। সেই শ্রম প্রকাশিত হতে পারে শিল্প উৎপাদনের ব্যক্তিগত প্রক্রিয়ায় যেখানে প্রত্যেক শ্রমিক একটি যন্ত্র (ইংরেজি: instrument), একটি জিনিস, এবং নন একজন ব্যক্তি। ‘জেমস মিল প্রসঙ্গে মন্তব্য’ (১৮৪৪) লেখায় মার্কস বিচ্ছিন্নতাকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে:
“ধরে নেয়া যাক যে আমরা মানুষ হিসেবে উৎপাদন করেছি। সে ক্ষেত্রে আমরা উভয়েই দুই রকমে নিজেকে এবং অন্যকে তার উৎপাদনে স্বীকৃতি দিতে পারতাম। (১) আমার উৎপাদনে আমার স্বতন্ত্রতার বিশেষ স্বভাবকে বস্তুত্বরোপ করতে পারতাম আর সে কারণে আমার কাজের কালে আমার নিজ স্বতন্ত্র জীবনের প্রকাশকে উপভোগের সাথে সাথে বস্তুটির দিকে তাকিয়ে একরকম স্বতন্ত্র আনন্দ উপভোগ করতে পারতাম, আমি আমার ব্যক্তিত্বকে সন্দেহের সকল ছায়ার ঊর্ধ্বে নৈর্বক্তিক, সংবেদনে দৃশ্যমান শক্তি হিসেবে জানতে পারতাম। (২) আমার উৎপন্ন তোমার ব্যবহার বা উপভোগের মাধ্যমে আমি প্রত্যক্ষ সন্তুষ্টি পেতাম, জানতে পারতাম যে আমার শ্রম দিয়ে আমি কোন মানব প্রয়োজন মেটাতে পেরেছি, মানে আমি মানব স্বভাব বস্তুত্বরোপ করে অপর মানুষের প্রামাণিক স্বভাবের প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট জিনিস সৃষ্টি করেছি। … (৪) আমার নিজ জীবনের স্বতন্ত্র প্রকাশে আমি তোমার জীবনে তোমার প্রকাশকে সৃষ্টি করতে পারতাম, আর তাই আমার ব্যক্তিগত কাজে আমি সরাসরি আমার সত্য স্বভাব, আমার মানব স্বভাব, আমার সম্প্রদায়গতস্বভাব নিশ্চিত করে বাস্তবায়িত করতে পারতাম।
আমাদের উৎপাদন হতো আমাদেরই স্বভাব ঝলমল করা অজস্র আয়না।”[৪]
মানুষ এমন শ্রমের বিভাগ তৈরি করে, এমন সমস্ত কাজ করে, এমন সমস্ত কিছু সৃষ্টি করে যে নিজে তারই দ্বারা শর্তাধীন হয়ে পড়ে। যা নিজে উৎপাদন করছে, সে সমস্তই তাঁর কাছে পর; যা সে চায় না তাই তাকে করতে হয়; যার সাথে মেলামেশার আগ্রহ, যেভাবে বসবাসের আকাঙ্ক্ষা, তার কোনো কিছুই করতে না পেরে সে হয়ে পড়ে একা, সম্পূর্ণ একা। গোটা পরিবেশকে অসহনীয় মনে হচ্ছে অথচ এই পরিবেশই প্রতিনিয়ত সে গড়ে তুলছে।[৫] শ্রমের বিভাগ সম্পর্কে মার্কস এঙ্গেলস লিখেছেন, শ্রম বিভাগ হবার কারণে মানুষের
“কাজ আর স্বেচ্ছামূলক নয়, প্রকৃতিগতভাবেই হয়ে পড়ে বিভক্ত। মানুষের নিজের কাজ তার নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে তার বিরুদ্ধেই হয়ে পড়ে এক বিচ্ছিন্ন শক্তি। যেইমাত্র শ্রমের বণ্টন একটা অস্তিত্ব লাভ করে, প্রতিটি মানুষের একটি বিশিষ্ট কাজের এলাকা হয়ে যায় যেটি জোরপূর্বক চাপানো এবং যেটি থেকে সে পালাতে পারে না।”[৬]
পুঁজিবাদী সমাজে সৃষ্ট পুঁজি শ্রমিকেরই শ্রমশক্তির রূপান্তর, সেই পুঁজি তাঁকেই শ্রমদাসত্বে বন্দি করে রেখেছে। নীতি, নিয়ম, আইন, অর্থ, পণ্য, পুঁজি সবই তার সৃষ্টি। আবার এই সবই পিঞ্জর হয়ে উঠেছে তার কাছে।[৭] অর্থাৎ তার সৃষ্টিই তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
মার্কসবাদীদের মতে ব্যক্তিমালিকানাধীন শ্রেণিবৈষম্যমূলক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাই বিচ্ছিন্নতার মূল উৎস। আর্থ-সামাজিক অবস্থানগত বৈষম্যই সমাজে মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যবধান গড়ে তোলে। এ সমাজে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে মানুষের পরিচয় বহিরাগত [ইংরেজি: outsider] হিসেবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও মানুষের অভাব অনটন দূর হয়নি। বরং পুঁজিপতি শ্রেণির সম্পদ ও প্রাচুর্য আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শ্রমিক আরো নিঃস্ব হচ্ছে। পুঁজি মানুষের সহজাত শ্রম ও মেধাকে নগণ্য করে তুলেছে। এ সমাজ একটা উৎপাদন যন্ত্র আর মানুষ তার নাটবল্টু। সমাজ বিকাশে মানুষের আর কোনো ভূমিকার প্রয়োজন নেই। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের জন্য শ্রম নয়, শ্রমের জন্যই মানুষ এবং মানুষই আবার মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত। সৃষ্টির তাগিদে নয়, মানুষ কাজ করে জৈবিক প্রয়োজন মেটাতে। যন্ত্রে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে মানুষ। যন্ত্র মানুষকে ঘোরাচ্ছে না, ঘোরাচ্ছে যন্ত্রের মালিক পুঁজিপতি। এখানে বিচ্ছিন্নতার কারণ যন্ত্র নয়, যন্ত্রের মালিক অর্থাৎ উৎপাদনের উপকরণের মালিক। উৎপাদনের উপকরণের এই ব্যক্তিমালিকানাই বিচ্ছিন্নতার মূল উৎস। বিচ্ছিন্নতা পুঁজিবাদী সমাজের এমন একটি ব্যাধি যার ফলে মানুষ যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে, মানুষের জীবন অনেক বেশি যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে, যন্ত্রের যাঁতাকলে তার স্বাধীন সত্তা দলিত মথিত হচ্ছে।[৮]
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা মানে হলো উৎপাদনের সাথে শ্রমের এক বিরোধাত্মক সম্পর্ক। এর ফলে শ্রম পরিণত হয় এক ভিন্ন বস্তুতে [ইংরেজি: alien object]। উৎপাদন থেকে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতার অর্থ হলো সৃজনশীল কর্মকাণ্ড থেকে তার বিচ্ছিন্নতা, প্রজাতি জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতা। অর্থাৎ মানুষ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা। মানুষ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা তখনই ঘটে যখন তার নিজের মধ্যেই এক বিরোধাত্মক সম্পর্ক তৈরি হয়।[৯]
১৮৪৪-এর অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়াতে (১৯২৭), কার্ল মার্কস শিল্প উৎপাদনের পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ার অধীনে শ্রমকারি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ঘটা চার রকমের বিচ্ছিন্নতাকে চিহ্নিত করেছেন।[১০] প্রথমটি হচ্ছে মানুষ তার কাজের উৎপাদিত দ্রব্য হতে বিচ্ছিন্ন_ এই উৎপন্ন পুঁজিপতির দখলে চলে যায়। দ্বিতীয় হচ্ছে মানুষ খোদ তার উৎপাদনশীল কাজ হতেই বিচ্ছিন্ন, এই কাজ আর তার প্রামাণিক স্বভাবের স্বীকৃতি না থেকে অস্বীকৃতি হয়ে যায়। তৃতীয়টি হচ্ছে মানুষ তার প্রামাণিক স্বভাব হতে, তার প্রজাতি সত্তা হতে, তার মানব প্রকৃতি হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চতুর্থটি হচ্ছে মানুষ অপর মানুষ হতে, কর্মী অপর কর্মী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।[১১]
তথ্যসূত্র:
১. Adam Smith, The wealth of Nations, Chapter III: On the Accumulation of Capital, or of Productive and Unproductive Labour, প্রথম অনুচ্ছেদ, লিংক: https://www.marxists.org/reference/archive/smith-adam/works/wealth-of-nations/book02/ch03.htm
২. Karl Marx, Economic and Philosophical Manuscripts of 1844, পুঁজির মুনাফা, ১-এর শেষাংশে, লিংক: https://www.marxists.org/archive/marx/works/1844/manuscripts/capital.htm
৩. মার্কস ও এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, পৃষ্ঠা-৪০
৪.Marx, Karl. Comment on James Mill, Economic and Philosophical Manuscripts of 1844, 1844
৫. সমীরণ মজুমদার, মার্ক্সবাদ বাস্তবে ও মননে, স্বপ্রকাশ, কলকাতা, ১ বৈশাখ, ১৪০২, পৃষ্ঠা ৮৮
৬. Karl Marx. The German Ideology. 1845 Part I: A. Idealism and Materialism, Private Property and Communism, লিংক: https://www.marxists.org/archive/marx/works/1845/german-ideology/ch01a.htm
৭. সমীরণ মজুমদার, মার্ক্সবাদ বাস্তবে ও মননে, স্বপ্রকাশ, কলকাতা, ১ বৈশাখ, ১৪০২, পৃষ্ঠা ৮৮
৮. হারুন রশীদ, মার্কসীয় দর্শন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৪২
৯. হারুন রশীদ, মার্কসীয় দর্শন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৪৫
১০. Alienation. A Dictionary of Philosophy, Revised Second Edition (1984), p. 10.
১১. মার্কসের বিচ্ছিন্নতার ধারণা সম্পর্কে আরো পড়ুন, হারুন রশীদ, মার্কসীয় দর্শন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৩৯-১৫২ এবং ইংরেজি উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ Marx’s theory of alienation. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] লিখিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত মার্কসবাদ গ্রন্থের ৯৬-১০১ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরে ডট কমে ১৪ আগস্ট ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত। সেখান থেকে লেখাটি ৩০ জুন ২০২২ তারিখে ফুলকিবাজ ডট কমে পুনরায় প্রকাশ করা হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ৫ এপ্রিল ২০১৫।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।