ফ্যাসিবাদের শ্রেণি চরিত্র

কমরেডগণ,

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যনির্বাহী কমিটির ত্রয়োদশ প্লেনাম সঠিকভাবেই শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ফ্যাসিবাদকে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে জাভিদাম্ভিক এবং লগ্নী পুঁজির সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিভূর প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব বলে বর্ণনা করেছিল।

সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ধরনের ফ্যাসিবাদ হলো জার্মান ফ্যাসিবাদ। এর নিজেকে জাতীয় সমাজতন্ত্র বলে অভিহিত করার ধৃষ্টতা রয়েছে, যদিও সমাজতন্ত্রের সঙ্গে এর কোনই মিল নেই। হিটলারের ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ নয়, এ হলো পাশবিক জাতিদম্ভ। এ হলো রাজনৈতিক দস্যুতার এক শাসনব্যবস্থা, শ্রমিক শ্রেণি এবং কৃষক, পেটিবুর্জোয়া ও বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লবী অংশের বিরুদ্ধে প্ররোচনা ও নির্যাতনের ব্যবস্থা। এ হলো মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও পাশবিকতা; অন্যান্য জাতির বিরুদ্ধে বল্গাহীন আক্রমণ।

জার্মান ফ্যাসিবাদ আন্তর্জাতিক প্রতিবিপ্লবের উদ্যত খড়গ হিসাবে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের প্রধান প্ররোচক হিসাবে এবং সমগ্র বিশ্বের মেহনতী মানুষের মহান পিতৃভূমি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জেহাদের প্রবর্তক হিসাবে কাজ করে চলেছে।

… … ফ্যাসিবাদ হলো লগ্নী পুঁজিই শক্তি। এ হলো শ্রমিকশ্রেণী, কৃষক ও বুদ্ধিজীবীর বিপ্লবী অংশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী প্রতিহিংসার সংগঠন। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ হলো জাতিম্ভের নগ্নতম রূপ যা অপরাপর “জাতির বিরুদ্ধে পাশবিক ঘৃণার প্ররোচনা জোগায়।

ফ্যাসিবাদের এই সঠিক চরিত্রের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ অবশ্যই করতে হবে, কারণ অনেকগুলি দেশে ফ্যাসিবাদ সমাজবাদী বুলির আড়ালে সেই অগণিত পেটিবুর্জোয়া জনগণের, যারা সংকটের আবর্তে নিজ নিজ গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের, এবং এমনকি সর্বহারা শ্রেণির সবচেয়ে পশ্চাৎপদ স্তরের কোনো কোনো অংশেরও সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ফ্যাসিবাদের প্রকৃত শ্রেণি চরিত্র ও এর সঠিক প্রকৃতি অনুধাবন করলে, তারা কখনই একে সমর্থন জানাত না।

এক একটি বিশেষ দেশের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী এবং জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আন্তর্জাতিক অবস্থান অনুযায়ী ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বের বিকাশ বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। কোনো কোনো দেশে, বিশেষ করে যেখানে ফ্যাসিবাদের কোন ব্যাপক গণভিত্তি নেই এবং যেখানে ফ্যাসিবাদী বুর্জোয়াদের নিজেদের শিবিরে নানা উপদলের সংঘর্ষ খুব তীব্র, সেখানে ফ্যাসিবাদ সরাসরিভাবে সংসদকে অবলোপ করার সাহস রাখে না, আর তাই অন্যান্য বুর্জোয়া দল এবং এমনকি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকেও কিছু পরিমাণ বৈধতা রাখবার অনুমতি দেয়। অন্য সকল দেশে, যেখানে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি এক আসন্ন বিপ্লবের আবির্ভাব সম্পর্কে শঙ্কিত সেখানে তারা হয় তৎক্ষণাৎ, অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও উপদলের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও সন্ত্রাসের শাসনকে তীব্রতর করে তার সীমাহীন একচেটিয়া রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এর দ্বারা ফ্যাসিবাদের অবস্থা যখন বিশেষভাবে সঙ্কটাপন্ন হয়ে ওঠে তখন এর দরুন কিন্তু ফ্যাসিবাদের পক্ষে নিজেদের শ্রেণি চরিত্রকে পরিবর্তিত না করেও প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্বের সঙ্গে স্থুল ভুয়ো সংসদীয় পন্থার সংযুক্তি সাধন ও নিজের ভিত্তি প্রসারের প্রচেষ্টার বাধা হয় না।

ফ্যাসিবাদের ক্ষমতলাভ এক বুর্জোয়া সরকার থেকে অপর এক সরকারে মামুলী উত্তরণ নয়, এ হলো বুর্জোয়াদের শ্রেণি কর্তৃত্বের একটি রাষ্ট্রীয় রূপ, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের জায়গায় অন্য এক রাষ্ট্রীয় রূপের প্রকাশ্য সন্ত্রাসমূলক একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা। এই পার্থক্যটি উপেক্ষা করা গুরুতর ভুল হবে; এই ভুল বিপ্লবী সর্বহারাদের ফ্যাসিবাদী ক্ষমতা দখলের বিপদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য শহর ও গ্রামের মেহনতী মানুষের ব্যাপক সমাবেশ ব্যাহত করবে এবং তাদের বুর্জোয়া শিবিরের মধ্যের স্ব-বিরোধিতার সুযোগ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করবে। কিন্তু আবার ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে বুর্জোয়া শ্রেণির অনুসৃত ক্রমবর্ধমান প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ, যা মেহনতী জনগণের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে দমন করে, সংসদের অধিকারকে খর্ব করে ও তা নিয়ে জোচ্চুরি করে এবং বিপ্লবী আন্দোলনের বিরুদ্ধে দমন নীতিকে তীব্র করে, সেগুলির গুরুত্বকে ছোট করে দেখা কিছু কম বিপজ্জনক ও কম গুরুতর ভ্রান্তি নয়।

কমরেডগণ, ফ্যাসিবাদের ক্ষমতালাভকে এইরকম সরলীকৃত ও স্বচ্ছন্দরূপে কল্পনা করা ভুল হবে যে এ যেন লগ্নী পুঁজির কোনো একটি কমিটি কোনো এক নির্দিষ্ট তারিখে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। বাস্তবক্ষেত্রে, ফ্যাসিবাদ সাধারণত ক্ষমতায় আসে পুরনো বুর্জোয়া পার্টিগুলির অথবা ঐ পার্টিগুলির কোনো নির্দিষ্ট অংশের মধ্যে পারস্পরিক লড়াইয়ের গতিপথে, অথবা কখনও কখনও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর লড়াইয়ের গতিপথে, এমনকি ফ্যাসিস্ট শিবিরের মধ্যেই লড়াইয়ের গতিপথে—কখনও কখনও এ লড়াই সশস্ত্র সংঘর্ষে পরিণত হয়, যেমন হয়েছিল জার্মানি, অষ্ট্রিয়া ও অপরাপর দেশে। এই সবকিছু কিন্তু এই সত্যটিকে চাপা দেয় না যে, ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার আগে বুর্জোয়া সরকারগুলি সাধারণত কতকগুলি প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রম করে এবং কতকগুলি প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা অবলম্বন করে যা ফ্যাসিবাদের ক্ষমতা দখলের পথকে প্রত্যক্ষভাবে সুগম করে। বুর্জোয়াদের এই প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং প্রস্তুতি পর্বে ফ্যাসিবাদের শক্তি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম না করে সে ফ্যাসিবাদের বিজয়কে প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে না, বরং সেই বিজয়ের পথ প্রশও করে।

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতারা ফ্যাসিবাদের প্রকৃত শ্রেণি চরিত্রকে চাপা দিয়ে জনতার কাছ থেকে তাকে গোপন রেখেছিল, এবং বুর্জোয়াদের ক্রমবর্ধমান প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থাবলীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য তাদের আহ্বান জানায় নি। তারা এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব বহন করছে এই কারণে যে, ফ্যাসিবাদী দেশে মেহনতী জনগণের এক বিশাল অংশ ফ্যাসিবাদের মধ্যে তাদের সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু, রক্তলোলুপ, লুণ্ঠনকারী লগ্নী পুঁজিকে চিনতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং ঐ জনগণ তাকে প্রতিহত করতে প্রস্তুত ছিল না।

সমাজতন্ত্র সম্পর্কে একটি আলোচনা দেখুন

জনগণের উপর ফ্যাসিবাদের প্রভাবের উৎস কি? ফ্যাসিবাদ জনগণকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই কারণে যে, জনগণের সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন ও দাবিগুলির কাছে সে মহাবাগাড়ম্বরে আবেদন করে। ফ্যাসিবাদ শুধু জনগণের মধ্যে গভীরভাবে বদ্ধমূল সংস্কারগুলিকেই উক্কিয়ে দেয় না, উপরন্তু তাদের অপেক্ষাকৃত উন্নততর অনুভূতিগুলি, যেমন তাদের ন্যায়বিচারের চেতনাকে, এমনকি কখনও কখনও তাদের বিপ্লবী ঐতিহ্যকেও কাজে লাগায়। কেন জার্মান ফ্যাসিবাদীরা, যারা বড় বড় বুর্জোয়াদের সেবাদাস ও সমাজতন্ত্রের মারাত্মক শত্রু, জনগণের কাছে নিজেদেরকে “সমাজতন্ত্রী” বলে পরিচয় দেয় এবং তাদের ক্ষমতা দখলকে বিপ্লব বলে বর্ণনা করে? তার কারণ জার্মানির অগণিত মেহনতী জনগণের সমাজতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষা এবং বিপ্লবের প্রতি যে বিশ্বাস রয়েছে তাকেই কাজে লাগাবার চেষ্টা করা!

ফ্যাসিবাদ চরম সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থেই কাজ করে কিন্তু জনগণের কাছে নিজেকে উপস্থিত করে নির্যাভিত জাতিগুলির রক্ষকের ছদ্মবেশে এবং অপমানিত জাতীয় অনুভূতিগুলিকে নাড়া দেয়, যেমনটা জার্মান ফ্যাসিবাদীরা করেছিল “ভার্সাই চুক্তির বিরোধিতার” শ্লোগান তুলে পেটি বুর্জোয়া জনগণের সমর্থন অর্জন করতে!

ফ্যাসিবাদের উদ্দেশ্য হলো জনগণের উপর বলগাহীন শোষণ কায়েম করা, কিন্তু লুণ্ঠনকারী বুর্জোয়া, ব্যাঙ্ক, ট্রাস্ট ও ধনকুবেরদের বিরুদ্ধে মেহনতী জনগণের তীব্র ঘৃণা নিয়ে ফ্যাসিবাদ অতি সুকৌশলে, পুঁজিবাদবিরোধী বুলি কপচিয়ে ও রাজনৈতিকভাবে অপরিণত জনগণের কাছে এক একটি নির্দিষ্ট সময়ে সবচেয়ে লোভনীয় শ্লোগান নিয়ে হাজির হয়ে তাদের চিত্ত জয় করে। তাদের এই রকমের শ্লোগান হলো: জার্মানিতে—“ব্যাক্তিগত মঙ্গলের চেয়ে সাধারণ মঙ্গল অনেক ঊর্ধ্বে; ইতালিতে—“আমাদের রাষ্ট্র ধনতান্ত্রিক নয় বরং এক যৌথ রাষ্ট্র”; জাপানে—“শোষণহীন জাপানের জন্য”; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে— “সম্পদের ভাগ নাও” ইত্যাদি।

আরো পড়ুন

ফ্যাসিবাদ জনগণকে সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ ও ঘুষখোর লোকেদের হাতে শিকার হবার জন্য তুলে দেয় কিন্তু জনগণের সামনে হাজির হয় এক “সৎ ও নিষ্কলুষ সরকারের” দাবি নিয়ে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সরকার সম্পর্কে জনসাধারণের মোহভঙ্গের উপর বেসাতি করে ফ্যাসিবাদ দুর্নীতির কপট নিন্দা করে [উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে বারমাত এবং স্কলারেকের কাণ্ড, ফ্রান্সে স্ট্রাভিস্কির কাণ্ড এবং অনুরূপ অন্যান্য অসংখ্য ঘটনা]।

পুরনো বুর্জোয়া পার্টিগুলিতে আস্থা হারিয়ে যে জনসাধারণ তাদের পরিত্যাগ করেছে সেই জনসাধারণকে ফ্যাসিবাদ বুর্জোয়াদের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের স্বার্থেই পাকড়ায়। কিন্তু বুর্জোয়া সরকারগুলির বিরুদ্ধে তার আক্রমণের কঠোরতার দ্বারা ও পুরাতন বুর্জোয়া দলগুলির প্রতি তার আপোসহীন ভাবভঙ্গীর দ্বারাই ফ্যাসিবাদ এই জনগণকে প্রভাবিত করে। মানববিদ্বেষ ও ছলনায় বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়ার ধারাকে ছাপিয়ে ফ্যাসিবাদ তার প্রতিটি দেশের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের এমনকি একই দেশের ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক স্তরের বৈশিষ্ট্যের সংগে খাপ খাইয়ে নেয়। অভাব, বেকারত্ব এবং জীবনের অনিশ্চয়তার দরুন হতাশ পেটিবুর্জোয়া জনগণ, এমনকি শ্রমিকদেরও একটি অংশ ফ্যাসিবাদের এই সামাজিক ও জাতিদাম্ভিক বাগাড়ম্বরের শিকার হয়।

সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী আন্দোলনের বিরুদ্ধে এবং বিক্ষুব্ধ জনগণের বিরুদ্ধে আক্রমণের পার্টি হিসাবেই ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় আসে, কিন্তু তবুও সে তার ক্ষমতা লাভকে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে “সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে” এক “বিপ্লবী” আন্দোলন হিসাবে এবং সমগ্র জাতির “পরিত্রাণের” প্রতীক হিসাবে প্রতিপন্ন করে। [এখানে আমরা মুসোলিনির রোম “অভিযান”, পিলসুদস্কির ওয়ারশ “অভিযান”, জার্মানিতে হিটলারের ন্যাশনাল-সোশালিস্ট ‘‘বিপ্লব” এবং অনুরূপ ঘটনা স্মরণ করতে পারি]।

কিন্তু ফ্যাসিবাদ যে-কোনো মুখোশই ধারণ করুক, যে-কোনো রূপেই নিজকে উপস্থাপিত করুক এবং যে-কোনো পথেই ক্ষমতায় আসুক, তবুও— ফ্যাসিবাদ হলো মেহনতী জনগণের উপর পুঁজির সবচেয়ে হিংস্র আক্রমণ; — ফ্যাসিবাদ হলো বন্ধুহীন জাতিদম্ভ ও আগ্রাসী যুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ হলো প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবিপ্লব; — ফ্যাসিবাদ হলো শ্রমিক শ্রেণির এবং সমস্ত মেহনতী মনুষের সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু।

Leave a Comment

error: Content is protected !!