যুক্তফ্রন্ট-বিরোধীদের এর বিরুদ্ধে কি আপত্তি থাকতে পারে, আর এই আপত্তি তারা কি ভাবেই বা প্রকাশ করে?
কেউ কেউ বলে, “কমিউনিস্টদের কাছে যুক্তফ্রন্টের শ্লোগান একটি কৌশলমাত্র”। কিন্তু আমাদের উত্তর হলো যে, যদি এটি কৌশলই হয় তাহলে তোমরা সততার সঙ্গে গ্রহণ করে এই “কমিউনিস্ট কৌশলের” মুখোস খুলে দাও না কেন? আমরা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করি: আমরা শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ কর্মধারা চাই যাতে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সর্বহারাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়, যার ফলে পুঁজির আক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের আজকের স্বার্থ রক্ষা করে তারা আগামী দিনে তাদের চূড়ান্ত মুক্তি অর্জনের প্রাথমিক শর্তগুলি সৃষ্টি করার অবস্থায় উপনীত হতে পারে।
অন্যেরা বলে থাকে, “কমিউনিস্টরা আমাদের আক্রমণ করে”। কিন্তু শোনো, আমরা বারবার ঘোষণা করেছি যে আমরা কাউকে, কোনো ব্যক্তি, কোনো সংস্থা বা কোনো পার্টি, যা শ্রেণিশত্রুর বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির যুক্তফ্রন্টের পক্ষে, তাকে আমরা আক্রমণ করবো না; কিন্তু আবার সেই সঙ্গে সর্বহারা শ্রেণি ও তাদের লক্ষ্যের স্বার্থে, সেই সব ব্যক্তি, সংস্থা ও পার্টি যা শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করে, তাদের সমালোচনাও আমাদের কর্তব্য।
একটি তৃতীয় গোষ্ঠী আবার বলে যে, কমিউনিস্টদের সঙ্গে আমরা যুক্ত ফ্রন্ট গঠন করতে পারি না যেহেতু তাদের একটি স্বতন্ত্র কর্মসূচী আছে। কিন্তু তোমরা নিজেরাই বলে থাক যে, তোমাদের কর্মসূচী বুর্জোয়া পার্টিগুলির কর্মসূচী থেকে পৃথক; কিন্তু এই পার্থক্য তো বুর্জোয়া পার্টিগুলির সঙ্গে তোমাদের যুক্ত মোর্চা গঠনে আগেও বাধা সৃষ্টি করে নি, আর এখনও বাধা সৃষ্টি করে না ৷
যুক্তফ্রন্ট-বিরোধী ও বুর্জোয়াদের সঙ্গে সহযোগিতার পক্ষে তারা বলে যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের “থেকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পার্টিগুলি আরও ভাল মিত্র”। কিন্তু জার্মানির অভিজ্ঞতা আমাদের কি শিক্ষা দেয়? সেখানে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা ঐসব তথাকথিত “ভাল মিত্র”দের সঙ্গে কি সংঘবদ্ধ হয় নি? কিন্তু তার পরিণাম কি হয়েছিল?
আমরা প্রায়ই বলতে শুনি যে, আমরা যদি কমিউনিস্টদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করি তাহলে পেটি বুর্জোয়ারা ‘লাল জুজুর’ দ্বারা ভীত হবে এবং ফ্যাসিবাদের শিবিরে যোগ দেবে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট কি কৃষক, ছোট ছোট ব্যবসায়ী, কারিগর ও মেহনতি বুদ্ধিজীবীদের কাছে ভীতির প্রতীক? না, যুক্তফ্রন্ট কেবল বৃহৎ বুর্জোয়া ধনকুবের, ইউঙ্কার (junkers) ও অন্যান্য শোষক শ্রেণির কাছেই ভীতির বস্তু, কারণ যুক্তফ্রন্টের শাসন এই সব স্তরের পরিপূর্ণ বিনাশ সাধন করে ৷
কোনো কোনো সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট নেতা বলে থাকেন, “সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি গণতন্ত্রের আর কমিউনিস্টরা একনায়কত্বের পক্ষে, আর তাই আমরা কমিউনিস্টদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে পারি না”। কিন্তু এখন কি আমরা সর্বহারার একনায়কত্ব ঘোষণা করার জন্য তোমাদের কাছে যুক্তফ্রন্টের প্রস্তাব করেছি? এখনকার মতো আমাদের কোনো প্রস্তাব নেই।
‘’কমিউনিস্টরা গণতন্ত্রকে স্বীকার করুক, গণতন্ত্র রক্ষায় এগিয়ে আসুক তবেই আমরা যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রস্তুত হবো” —আমরা উত্তরে বলি, আমরা মেহনতি মানুষের গণতন্ত্র, সোভিয়েত গণতন্ত্রের অনুগামী—যা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সংগতিপূর্ণ গণতন্ত্র । কিন্তু পুঁজিবাদী দেশগুলিতে ফ্যাসিবাদ ও প্রতিক্রিয়ার দ্বারা আক্রান্ত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার প্রতিটি কণা আমরা রক্ষা করি এবং ভবিষ্যতেও রক্ষা করতে থাকবো, কারণ সব হারাদের শ্রেণিসংগ্রামের স্বার্থ আমাদের সেই নির্দেশ দেয় ।
আর একটা দৃষ্টান্ত দিতে পারি। গ্রেট ব্রিটেনের শ্রমিক নেতারা বলেন, “লেবার পার্টির দ্বারা গঠিত যুক্তফ্রন্টে অংশ নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কমিউনিস্ট পার্টিগুলি কোন সাহায্যই করতে পারে না”। এখানে স্মরণ করো অস্ট্রিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতারা অস্ট্রিয়ার ছোট্ট কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে ঐ একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু ঘটনাবলী কি দেখিয়েছে? অটো বাউয়ার ও কার্ল রেনের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কিন্তু সঠিক বলে প্রমাণিত হয় নি, কিন্তু অপর দিকে, অস্ট্রিয়ার ছোট্ট কমিউনিস্ট পার্টিই যথাসময়ে অস্ট্রিয়াতে ফ্যাসিবাদের বিপদের সংকেত দিয়েছিল এবং শ্রমিকদের এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে আহ্বান জানিয়েছিল। শ্রমিক আন্দোলনের সমগ্র অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যে, সংখ্যার দিক থেকে অকিঞ্চিৎকর হলেও সর্বহারার জঙ্গী আন্দোলনে কমিউনিস্টরাই চালিকাশক্তি, তাছাড়া একথা বিস্মৃত হলে চলবে না যে, অস্ট্রিয়া বা গ্রেট বিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি বলতে শুধু পার্টির সমর্থক সহস্র সহস্র শ্রমজীবি মানুষকে বোঝায় না; এই পার্টিগুলি বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অংশ, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকেরই এক বিভাগ, যে আন্তর্জাতিক আন্দোলনেরই অগ্রণী পার্টি, সর্বহারাদের একটি পার্টি, ইতিমধ্যেই জয়লাভ করেছে এবং বিশ্বের এক-ষষ্ঠাংশের ওপর তার শাসন কায়েম করেছে।
যুক্তফ্রন্ট-বিরোধীরা আর একটি অভিযোগের অবতারণা করে এই বলে, “যুক্তফ্রন্ট স্বার অঞ্চলে (Saar basin) ফ্যাসিবাদের সাফল্যকে প্রতিহত করতে পারে নি”। এই ভদ্রলোকদের কি বিচিত্র যুক্তি! প্রথমে তাঁরা ফ্যাসিবাদের সাফল্যকে সুনিশ্চিত করার জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেন নি, আর তারপর তাঁরা এক বিদ্বেষপূর্ণ আনন্দে উল্লাস করেন এই কারণে যে যুক্তফ্রন্ট, যাতে তাঁরা একেবারে শেষ মুহূর্তে যোগ দিয়েছেন, তা শ্রমজীবী মানুষকে সাফল্যের পথে নিয়ে যেতে পারে নি।
আরো পড়ুন
- যুক্তফ্রন্ট ও যুবসমাজ
- ট্রেড ইউনিয়ন ঐক্যের জন্য সংগ্রাম
- ময়মনসিংহে সাম্প্রতিক বর্ণবাদচর্চা
- ফ্যাসিবাদ-বিরোধী গণফ্রন্ট
- যুক্তফ্রন্টের সারবস্তু ও রূপ
- যুক্তফ্রন্ট-বিরোধীদের প্রধান যুক্তি
- যুক্তফ্রন্টের গুরুত্ব
- ফ্যাসিবাদ একটি হিংস্র কিন্তু অস্থিতিশীল শক্তি
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উৎস ও চরিত্র
- ফ্যাসিবাদের জয় কি অনিবার্য?
- বিজয়ী ফ্যাসিবাদ জনগণের জন্য কী বহন করে আনে?
- ফ্যাসিবাদের শ্রেণি চরিত্র
- সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদী চিন্তা হচ্ছে আগ্রাসনবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী
- সুভাষচন্দ্র বসুর রাষ্ট্রচিন্তা হচ্ছে স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ও জাতীয় মুক্তি
বিভিন্ন দেশের মন্ত্রিসভায় অধিষ্ঠিত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক নেতারা বলেন: যদি আমরা কমিউনিস্টদের সংগে যুক্তফ্রন্ট গঠন করি তাহলে আমাদের কোয়ালিশন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং প্রতিক্রিয়াশীল ও ফ্যাসিবাদী পার্টিগুলি সরকার গঠন করবে”। খুব ভাল কথা। কিন্তু জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কি কোয়ালিশন সরকারে ছিল না? হ্যাঁ, ছিল। অস্ট্রিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কি সরকার গঠন করে নি? হ্যাঁ, করেছিল। স্পেনের সমাজতান্ত্রিকেরা কি বুর্জোয়াদের সঙ্গে একই সরকারে থাকে নি? তারাও তাই ছিল। এইসব দেশে কি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলির দ্বারা বুর্জোয়াদের কোয়ালিশন সরকারে অংশগ্রহণ সর্বহারাদের ওপর ফ্যাসিবাদী আক্রমণ প্রতিহত করতে পেরেছিল? না, তা পারে নি। কাজেই এই কথা দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে, বুর্জোয়া সরকারে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট মন্ত্রিদের অংশগ্রহণ ফ্যাসিবাদের পথে কোনোই প্রতিবন্ধক রচনা করে না।
‘কমিউনিস্টরা একনায়কের মত কাজ করে, তারা সব ব্যাপারেই আমাদের নির্দেশ দিতে ও হুকুম করতে চায়’। না আমরা কোনো কিছুই নির্দেশ দিই না, বা হুকুম করি না। যা মেহনতি জনগণের স্বার্থসিদ্ধ করবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বস করি, আমরা কেবল সেই বিষয়ে প্রস্তাব করি। যারা শ্রমজীবী মানুষের নামে কাজ করে এটি তাদের সকলের শুধু অধিকার নয়, কর্তব্যও। আপনারা কমিউনিস্টদের একনায়কত্ব সম্পর্কে ভীত? আসুন আমরা মিলিতভাবে আপনাদের আর আমাদের প্রস্তাবগুলি শ্রমিকদের কাছে পেশ করি, মিলিতভাবে সেগুলি আলোচনা করি এবং শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তাবগুলিকে, সব শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে একযোগে, বাছাই করি ৷
কাজেই যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে উত্থাপিত যুক্তিগুলি প্রকৃতপক্ষে কোনো সমালোচনাই নয়, বরং এগুলি হলো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের, যারা সর্বহারাদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন অপেক্ষা বুর্জোয়াদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষপাতী, তাদেরই তুচ্ছ ওজর মাত্র। না, এই ওজরগুলিও পরিণামে টিকবে না। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিভেদ যে দুঃসহ দুর্দশার সৃষ্টি করে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক সর্বহারার জানা আছে। তাই তারা আরও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, যুক্তফ্রন্ট, হলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বহারাদের ঐক্যবদ্ধ কর্মধারা, একদিকে যেমন প্রয়োজন, তেমনি সম্পূর্ণ সম্ভবও।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।