১৯২০ সালের ২ অক্টোবর রাশিয়ার কমিউনিস্ট যুবলীগের তৃতীয় সারা রাশিয়া কংগ্রেসে ভাষণ
(লেনিনের উদ্দেশে কংগ্রেসের তুমূল অভিনন্দনোচ্ছাস।) কমরেডগণ, আমি আজ আলোচনা করতে চাই যুব কমিউনিস্ট লীগের মূল কর্তব্য কী এবং এই প্রসঙ্গেই, সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে সাধারণভাবে যুবজনের কীরূপ সংগঠন হওয়া উচিত তাই নিয়ে।
সমস্যাটি আলোচনা করা আরও আবশ্যক এইজন্য যে, কমিউনিস্ট সমাজ সৃষ্টির সত্যিকার কর্তব্য পড়বে যুবজনেরই ওপর। কারণ একথা পরিষ্কার যে কর্মীদের যে-পুরুষ পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ হয়েছে তারা শোষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত সাবেকী পুঁজিবাদী সমাজ জীবনের বুনিয়াদটাই বড়ো জোর ধ্বংস করতে পারে। বড়ো জোর এমন একটা সমাজব্যবস্থা সৃষ্টির কর্তব্য পালন করতে পারে তারা, যা প্রলেতারিয়েত ও মেহনতী শ্রেণীগুলির হাতে ক্ষমতা বজায় রাখতে ও পাকা বুনিয়াদ গড়তে সাহায্য করবে, যার ওপর নির্মাণ করে তুলতে পারবে কেবল সেই প্রজন্ম যারা নতুন পরিস্থিতিতে, মানুষে মানুষে শোষণ যখন আর থাকছে না তেমন অবস্থায় কাজ আরম্ভ করছে।
তাই, এই দৃষ্টিকোণ থেকে যুবজনের কর্তব্য সম্পর্কে এগুলে বলতেই হবে যে, সাধারণভাবে যুবজনের এবং বিশেষ করে যুব কমিউনিস্ট লীগ ও অন্যান্য সংগঠনের কর্তব্য ব্যক্ত করা যায় একটি কথায়: শিখতে হবে।
অবশ্যই এটা মাত্র ‘একটি কথা’। প্রধান ও সর্বাধিক জরুরি প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। তাতে, যথা: কী শিখব, কী করে শিখব? এক্ষেত্রে গোটা কথাটাই হলো এই যে, সাবেকী পুঁজিবাদী সমাজের রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে যে-নতুন প্রজন্মগুলো কমিউনিস্ট সমাজ গড়ে তুলবে তাদের শেখান, মানুষ করে তোলা ও তালিম দেবার কাজটাও পুরনো ধারায় চালান যায় না। যুবজনকে শেখান, মানুষ করে তোলা ও তালিম দেবার কাজ চালাতে হবে সাবেকী সমাজ যে-মালমসলা রেখে গেছে তাই থেকেই। কমিউনিজম আমরা নির্মাণ করতে পারি কেবল সাবেকী সমাজ যে জ্ঞান, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সমাহার, মানবিক বল ও উপায়াদির ভান্ডার আমাদের জন্য রেখে গেছে তা দিয়ে। যুবজনের শিক্ষাদান, সংগঠন ও মানুষ করে তোলার কাজটাকে আমূল পুনর্গঠিত করেই কেবল আমরা এটা নিশ্চিত করতে পারি যে, তরুণ প্রজন্মের প্রচেষ্টার ফল হবে এমন সমাজের নির্মাণ যা সাবেকী সমাজের মতো হবে না, অর্থাৎ কমিউনিস্ট সমাজের নির্মাণ। সেই জন্যই কী আমরা শেখাব এবং কমিউনিস্ট যুবজন এই নাম সত্যই সার্থক করতে চাইলে কীভাবে যুবজনদের শিখতে হবে, আমরা যা শুরু করেছি তা সম্পূর্ণ ও সমাপ্ত করতে হলে কীভাবে যুবজনকে তালিম দিতে হবে, এই প্রশ্ন নিয়ে আমাদের বিশদে আলোচনা করা দরকার।
বলতে আমি বাধ্য যে, মনে হবে প্রথম ও সবচেয়ে স্বাভাবিক জবাব হলো, যুবলীগকে এবং যারা কমিউনিজমে পৌঁছতে চায় সাধারণভাবে এমন সমস্ত যুবজনকে কমিউনিজম শিখতে হবে।
কিন্তু ‘কমিউনিজম শিখতে হবে? জবাবটি খুবই ব্যাপক। কমিউনিজম শিখতে হলে আমাদের কী দরকার? কমিউনিজমের জ্ঞান অর্জন করতে হলে সাধারণ জ্ঞানের সমাহার থেকে কোন জিনিসটা বেছে নিতে হবে? এই ক্ষেত্রে একপ্রস্ত বিপদ দেখা দেয় আমাদের সামনে, কমিউনিজম শেখার কর্তব্যটা যখন বেঠিকভাবে হাজির করা হয় বা খুবই একপেশেভাবে তা বোঝা হয়, তখন প্রায়ই সর্বদাই বিপদটি বাধে।
স্বভাবতই, প্রথমে মনে হবে যে, কমিউনিজম শেখা মানে কমিউনিস্ট পাঠ্যপুস্তক, পুস্তিকা ও রচনায় যে-জ্ঞানভান্ডার রয়েছে তা আয়ত্ত করা। কিন্তু কমিউনিজম অধ্যয়নের এমন সংজ্ঞা খুবই স্থল ও অপ্রতুল। কমিউনিস্ট রচনা বইপত্তর, পুস্তিকায় যা আছে কেবল তাই আয়ত্ত করাই কমিউনিজম অধ্যয়ন হলে খুব সহজেই আমরা কমিউনিস্ট পুঁথিবাগীশ, বাক্যবীরদের পেতে পারি এবং তাতে প্রায়ই আমাদের ক্ষতি ও অনিষ্ট হবে, কেননা কমিউনিস্ট বইপত্তর, পুস্তিকায় যা আছে তা পড়ে মুখস্থ করার ফলে এইসব লোকেরা সেই জ্ঞানকে সম্মিলিত করতে ব্যর্থ হবে, কমিউনিজমের যা সত্যিকার দাবি সেভাবে কাজ করতে পারবে না।
সাবেকী পুঁজিবাদী সমাজ আমাদের জন্য যা রেখে গেছে তেমন একটা বৃহত্তম অকল্যাণ ও দুর্ভাগ্য হলো ব্যবহারিক জীবন থেকে পুস্তকের পরিপূর্ণ বিচ্ছেদ, কারণ এমন বই আমাদের ছিলো যাতে সবকিছুই যথাসম্ভব চমৎকার করে বর্ণিত হয়েছে, অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তেমন বই হলো অতি ন্যাক্কারজনক ভন্ডামিভরা মিথ্যা, যাতে মিথ্যে করে বর্ণনা করা হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজের।
সেইজন্যই কমিউনিজম বিষয়ে বইগুলি থেকে স্রেফ পুঁথিগত বিদ্যা আয়ত্ত করা অবশ্যই চূড়ান্ত ভুল হবে। কমিউনিজম সম্পর্কে আগে যা বলা হয়েছিলো, এখন আমাদের বক্তৃতা ও প্রবন্ধাদিতে কেবল তারই পুনরাবৃত্তি আমরা করি না, কারণ আমাদের দৈনন্দিন ও সর্বমুখী কাজের সঙ্গে আমাদের বক্তৃতা ভাষণাদি সম্পর্কিত। কাজ ছাড়া, সংগ্রাম ছাড়া কমিউনিস্ট পুস্তিকা ও বইপত্তর থেকে পাওয়া কমিউনিজমের পুঁথিগত বিদ্যা মূল্যহীন, কেননা তত্ত্ব থেকে ব্যবহারের সেই পুরনো বিচ্ছেদই তাতে চলতে থাকবে, সেই সাবেকী বিচ্ছেদ, যেটা সাবেকী বুর্জোয়া সমাজের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক বৈশিষ্ট্য।
কেবল কমিউনিস্ট স্লোগান আয়ত্ত করা শুরু করলে হয়ে পড়বে আরও বেশি বিপদ। সময় থাকতে এই বিপদ হৃদয়ঙ্গম না করলে, বিপদটি দূর করার জন্য আমাদের সব শক্তি নিয়োগ না করলে, যে পাঁচ কি দশ লাখ তরুণ-তরুণী এইভাবে কমিউনিজম শিখে নিজেদের কমিউনিস্ট বলবে, তারা কেবল কমিউনিজমের প্রভূত ক্ষতিই করবে।
এখানে প্রশ্ন ওঠে: কমিউনিজম অধ্যয়নের জন্য এইসব মেলাব কী করে ? সাবেকী স্কুল, সাবেকী বিজ্ঞান থেকে কী আমরা নেব? সাবেকী স্কুল ঘোষণা করেছিলো যে, সে সর্বাঙ্গীণ শিক্ষিত মানুষ গড়তে চায়, সাধারণভাবে বিদ্যাশিক্ষা দেওয়াই তার কাজ। আমরা জানি এটা একেবারেই মিথ্যা, কারণ শ্রেণিতে শ্রেণিতে, শোষকে শোষিতে লোকেদের ভাগাভাগির ওপরেই ছিলো গোটা সমাজের ভিত্তি, তার ওপরেই তা টিকে থাকত। স্বভাবতই, এই শ্রেণিপ্রেরণায় পুরোপুরি আচ্ছন্ন থাকায় সমগ্র সাবেকী স্কুলব্যবস্থা জ্ঞানদান করত কেবল বুর্জোয়া সন্তানদের। তার প্রতিটি কথাই ছিলো বুর্জোয়ার স্বার্থে জাল করা। এইসব স্কুলে শ্রমিক-কৃষকদের তরুণ প্রজন্মকে যতটা না মানুষ করে তোলা হতো, তার চেয়ে বেশি তাদের তালিম দেওয়া হত বুর্জোয়ার স্বার্থে। এমনভাবে তাদের গড়ে তোলা হতো যাতে তারা বুর্জোয়ার যুতসই চাকর হতে পারে, তার শান্তি ও আলস্যের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে মুনাফা তুলতে পারে তার জন্য। সেইজন্যই সাবেকী স্কুল বর্জন করার সময় আমরা তা থেকে শুধু সেইটুকু নেওয়া কর্তব্য ধরেছি যা সত্যিকার কমিউনিস্ট শিক্ষালাভের জন্য আমাদের প্রয়োজন।
এইখানটায়, সাবেকী স্কুলের বিরুদ্ধে যে-অনুযোগ ও অভিযোগ আমরা অনবরত শুনি ও যা থেকে প্রায়ই একেবারে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত এসে যায়, সেই কথায় আসছি। বলা হয় যে সাবেকী স্কুল ছিলো ঠেসে মাথা বোঝাই করার, হাবিলদারির, মুখস্থ করার স্কুল। সে-কথা ঠিক, তবে সাবেকী স্কুলের কোনটা খারাপ আর কোনটা আমাদের কাছে উপকারী তার তফাৎ করতে পারা চাই, কমিউনিজমের পক্ষে যা আবশ্যক সেটা তার মধ্য থেকে বেছে নিতে পারা চাই।
পুরনো স্কুল হলো ঠেসে মাথা বোঝাই করার স্কুল, এতে একরাশ নিম্প্রয়োজন অবান্তর প্রাণহীন জ্ঞান রপ্ত করতে বাধ্য হত ছাত্রেরা, যাতে মস্তিষ্ক বোঝাই হয়ে তরুণ প্রজন্ম পরিণত হত একটি একক ছক অনুসারে তালিম পাওয়া আমলায়। কিন্তু মানবিক জ্ঞানের যাবতীয় সঞ্চয় আত্তীকরণ ছাড়া কমিউনিস্ট হওয়া যায়, এই সিদ্ধান্ত টানার চেষ্টা করলে ভয়ানক ভুল হবে। কমিউনিজম নিজেই যে-জ্ঞানসমষ্টির পরিণাম, তাকে রপ্ত না করে কেবল কমিউনিস্ট স্লোগান রপ্ত করা, কমিউনিস্ট বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলি আয়ত্ত করাই যথেষ্ট, এ-কথা ভাবলে ভুল হবে। মানবিক জ্ঞানের সমষ্টি থেকে কীভাবে কমিউনিজমের উৎপত্তি ঘটল তারই নমুনা হলো মার্কসবাদ।
আপনারা পড়েছেন ও শুনেছেন যে কমিউনিস্ট তত্ত্ব, কমিউনিজমের বিজ্ঞান, প্রধানত মার্কসই যা সৃষ্টি করেছেন, সেই মার্কসবাদের শিক্ষামালা এখন আর উনিশ শতকের প্রতিভাধর একক একটি সমাজতন্ত্রীর সৃষ্টি হয়ে উঠেছে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তারা সেই মতবাদ ব্যবহার করছে। মার্কসের শিক্ষা কী করে সর্বাধিক বিপ্লবী শ্রেণির লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি জনের হৃদয় অধিকার করতে পারল, এই প্রশ্ন যদি করেন তবে তার একটি জবাবই পাবেন: তার কারণ পুঁজিবাদের অধীনে সঞ্চিত জ্ঞানের পাকা বুনিয়াদের ওপরেই মার্কস দাঁড়িয়েছিলেন; মানবসমাজের বিকাশের নিয়মগুলি অধ্যয়ন করার পর মার্কস কমিউনিজম অভিমুখে পুঁজিবাদী বিকাশের অনিবার্য্যতা বুঝেছিলেন, সবচেয়ে বড় কথা, সেটা তিনি প্রমাণ করেছিলেন পুঁজিবাদী সমাজের অতি যথাযথ, অতি বিশদ ও অতি গভীর অধ্যয়ন থেকেই, পূর্বতন সমস্ত বিজ্ঞানের যাবতীয় সৃষ্টি পুরোপুরি আয়ত্ত করেই। মানবসমাজ যা-কিছু, সৃষ্টি করেছিলো, তা সবই তিনি বিচার করে ঢেলে সাজান, একটি বিষয়ও উপেক্ষা করেন নি। মনুষ্যচিন্তা যা কিছু সৃষ্টি করেছিলো তাকে তিনি ঢেলে সাজান, সমালোচনা করেছেন, শ্রেণির আন্দোলন থেকে তা যাচাই করে নেন এবং এমন সব সিদ্ধান্ত টানেন যা বুর্জোয়া সীমায় সঙ্কুচিত বা বুর্জোয়া কুসংস্কারে আবদ্ধ লোকেরা টানতে পারে নি।
কথাটা আমাদের মনে রাখা উচিত যখন, ধরা যাক, প্রলেতারীয় সংস্কৃতির কথা (২০৭) আমরা বলি। আমরা যদি পরিষ্কার করে এ-কথা না বুঝি যে, মানবজাতির সমগ্র বিকাশের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সংস্কৃতির যথাযথ জ্ঞান লাভ করেই এবং সেই সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজিয়েই কেবল, আমরা প্রলেতারীয় সংস্কৃতি গড়তে পারি — এ-কথা যদি আমরা না বুঝি তাহলে সমস্যার সমাধান করতে পারব না। প্রলেতারীয় সংস্কৃতি এমন একটা কিছু নয়, যা কোত্থেকে উঠেছে কেউ জানে না, যারা নিজেদের প্রলেতারীয় সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞ বলে অভিহিত করে, তাদের স্বকপোলকল্পিত উদ্ভাবন তা নয়। ওটা একেবারে বাজে কথা। পুঁজিবাদী সমাজ, জমিদারী সমাজ, আমলাতন্ত্রী সমাজের জোয়ালের নিচে মানবজাতি যে-জ্ঞানভান্ডার জমিয়েছে, প্রলেতারীয় সংস্কৃতিকে হতে হবে তারই সুনিয়মিত বিকাশ। মার্কসের হাতে ঢেলে সাজা অর্থশাস্ত্র যেমন আমাদের দেখিয়েছে মানবসমাজকে কোথায় যেতে হবে, অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে শ্রেণিসংগ্রামে উত্তরণে, প্রলেতারীয় বিপ্লব শুরুর দিকে, ঠিক তেমনিভাবেই এই সমস্ত পথ ও রাস্তা পৌঁছাচ্ছিল, পৌছয় ও পৌছাচ্ছে প্রলেতারীয় সংস্কৃতিতে।
যুবজনের প্রতিনিধিদের এবং নতুন শিক্ষাব্যবস্থার কিছু কিছু পক্ষপাতীদের যখন আমরা সাবেকী স্কুলকে আক্রমণ করতে শুনি, বলতে শুনি যে সেটা মুখস্থ বিদ্যার স্কুল, তখন তাদের কাছে আমাদের বক্তব্য, সাবেকী স্কুলের যেটা ভাল সেটা আমাদের নিতে হবে। যার দশের নয় ভাগ নিম্প্রয়োজন ও বাকি একভাগ বিকৃত, প্রভূত পরিমাণে তেমন এক জ্ঞান দিয়ে তরুণদের স্মৃতিকে ভারাক্রান্ত করার পদ্ধতিটা আমরা সাবেকী স্কুলের কাছ থেকে নেব না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরা কেবল কমিউনিস্ট সিদ্ধান্তে, কেবল কমিউনিস্ট স্লোগান মুখস্থে সীমাবদ্ধ থাকতে পারি। সেভাবে কমিউনিজম গড়া যায় না। লোকে কমিউনিস্ট হতে পারে কেবল তখনই যখন মানবজাতির সৃষ্ট সমস্ত সম্পদের জ্ঞান দিয়ে মনটা সমৃদ্ধ করা হচ্ছে।
মুখস্থবিদ্যা আমাদের দরকার নেই, কিন্তু বুনিয়াদী তথ্যের জ্ঞান দিয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মনের বিকাশ ও পূর্ণতাসাধন আমাদের করতে হবে, কেননা অর্জিত সমস্ত জ্ঞান যদি চেতনার মধ্যে ঢেলে সাজা না হয়, তাহলে কমিউনিজম হয়ে উঠবে একটা ফাঁকা কথা, একটা সাইনবোর্ড, আর কমিউনিস্ট হয়ে দাঁড়াবে নিতান্তই এক বাক্যবাগীশ। এই জ্ঞানকে রপ্ত করতে হবে শুধু, তাই নয়, রপ্ত করতে হবে বিচার করে, মন যেন নিম্প্রয়োজন আবর্জনায় ভরে না ওঠে, বরং যা ছাড়া আধুনিক শিক্ষিত মানুষ হওয়া সম্ভব নয়, তেমন সব তথ্যে তা সমৃদ্ধ হয়। প্রচুর পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন পরিশ্রম ছাড়া, সমালোচকের মতো যা বিচার করে দেখার কথা সেইসব তথ্যে ব্যুৎপত্তি অর্জন না করে কোনো কমিউনিস্ট যদি সংগৃহীত সব তৈরি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কমিউনিজমের বড়াই করার কথা ভাবে, তবে খুবই শোচনীয় কমিউনিস্ট হবে সে। এই ধরনের পল্লবগ্রাহিতা হবে নিশ্চিতই মারাত্মক। আমি অল্প জানি — এ-কথা জানা থাকলে আমি বেশি জানার চেষ্ঠা করব; কিন্তু কেউ যদি বলে আমি কমিউনিস্ট, কোনো কিছুই গভীর করে জানার তার দরকারই নেই, তাহলে কমিউনিস্টের অনূরুপ কিছু একটা সে কদাচ হবে না।
সাহিত্য প্রসঙ্গে গ্রন্থ সম্পর্কে একটি আলোচনা দেখুন
পুঁজিপতিদের জন্য প্রয়োজনীয় চাকর তৈরি করত সাবেকী স্কুল, বিদ্বানদের তা পরিণত করত এমন লোকে যাদের লিখতে ও বলতে হত পুঁজিপতিদের মর্জি মতো। তাই, তা ঝেটিয়ে দূর করা আমাদের উচিত। কিন্তু তা দূর করা, চূর্ণ করা উচিত — এই কথার মানে কি এই যে, লোকের পক্ষে প্রয়োজনীয় যা-কিছু মানবজাতি সঞ্চিত করে তুলেছে, তা আমরা সেখান থেকে নেব না? তার মানে কি এই যে কোনটা পুঁজিবাদের পক্ষে প্রয়োজন এবং কোনটা কমিউনিজমের জন্য দরকার, তার তফাৎ টানতে আমাদের হবে না?
অধিকাংশের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বুর্জোয়া সমাজে যে-হাবিলদারী পদ্ধতি প্রযুক্ত হতো তার বদলে আমরা আনছি শ্রমিক-কৃষকের সচেতন শৃঙ্খলা; যা সাবেকী সমাজের প্রতি ঘৃণাকে মেলায় এই সংগ্রামের জন্য নিজ শক্তিকে সম্মিলিত ও সংগঠিত করার দৃঢ় সংকল্প, সামর্থ্য ও তৎপরতার সঙ্গে, যাতে একটা বিপুল দেশের ভূভাগ জড়ে ছত্রভঙ্গ, বিভক্ত, বহু বিক্ষিপ্ত কোটি কোটি লোকের ইচ্ছা পরিণত হয় একটি একক অভিপ্রায়ে, কেননা এই একক অভিপ্রায় নইলে আমাদের পরাজয় অবধারিত। এই নিবিড়তা ছাড়া, শ্রমিক-কৃষকের সচেতন শৃঙ্খলা ছাড়া আমাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। এ নইলে সারা দুনিয়ার পুঁজিপতি ও জমিদারদের আমরা হারাতে পারব না। বুনিয়াদের ওপর একটা নতুন, কমিউনিস্ট সমাজ গড়া তো দূরের কথা, বুনিয়াদটাকেই সংহত করতে পারব না আমরা। একইভাবে, সাবেকী স্কুলকে নাকচ করতে গিয়ে, সাবেকী স্কুলের প্রতি একান্ত সঙ্গত ও অত্যাবশ্যক ঘৃণা পোষণ করার সঙ্গে সঙ্গে, সাবেকী স্কুলকে ধবংস করার জন্য তৎপরতার কদর করার সাথে সাথে আমাদের বুঝতে হবে যে, সাবেকী শিক্ষাপ্রথা, সাবেকী মুখস্থবিদ্যা, সাবেকী হাবিলদারির বদলে আমাদের চাই মানবজ্ঞানের সমষ্টি অর্জনের সামর্থ্য এবং তা অর্জন করতে হবে এমনভাবে যাতে মুখস্থ করা কিছু একটা না হয়ে কমিউনিজম হয় আপনাদের নিজেদেরই ভেবে স্থির করা একটা জিনিস, হয় ঠিক সেইসব সিদ্ধান্তই যা আধুনিক শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনির্বায।
কমিউনিজম শেখার কর্তব্যের কথা বলার সময় প্রধান কর্তব্যগুলিকে আমাদের হাজির করা উচিত এইভাবে। এটা আপনাদের কাছে ব্যাখ্যার জন্য এবং সেইসঙ্গে কী করে শিখব, এই সমস্যার দিকে এগুবার ব্যাপারে একটা ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত দেব। আপনারা সবাই জানেন যে, সামরিক কর্তব্য, প্রজাতন্ত্র রক্ষার কর্তব্যের অব্যবহিত পরেই আমরা এখন অর্থনৈতিক কর্তব্যের সম্মুখীন। আমরা জানি যে শিল্প ও কৃষিকে পুনর্জীবিত না করলে কমিউনিস্ট সমাজ নির্মাণ করা যায় না, আর সাবেকী ঢঙেও তাদের পুনর্জীবিত করার প্রয়োজন নেই। তাদের পুনর্জীবিত করতে হবে সাম্প্রতিক, বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক নির্দেশ অনুসারে গড়া একটা ভিত্তিতে। আপনারা জানেন, এই ভিত্তি হলো বিদ্যুৎ এবং সমগ্র দেশ, শিল্প ও কৃষির সমস্ত শাখাকে বৈদ্যুতীকৃত করার পর, — এই কর্তব্যটা পালন করার পরই কেবল আপনারা সেই কমিউনিস্ট সমাজ নির্মাণ করতে পারবেন যা পূর্বতন প্রজন্ম করতে অক্ষম। গোটা দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পুনর্জীবিত করা, আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তিতে শিল্প ও কৃষি উভয়েরই পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধারের কর্তব্য আপনাদের সামনে — সেই ভিত্তিটা নিহিত রয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, বিদ্যুতে। বেশ বুঝতে পারছেন যে বৈদ্যুতীকরণের কাজ নিরক্ষর লোক দিয়ে চলে না, এক্ষেত্রে নিতান্ত সাক্ষরতাও যথেষ্ট নয়। বিদ্যুৎ কী জিনিস সেটা বুঝলেই এক্ষেত্রে চলবে না: শিল্প ও কৃষিতে এবং শিল্প ও কৃষির বিভিন্ন শাখায় তা কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে সেটা জানা চাই। সেটা আমাদের নিজেদের শিখতে হবে এবং মেহনতী তরুণ প্রজন্মের সবাইকে শেখাতে হবে। প্রতিটি সচেতন কমিউনিস্ট, যে-তরুণ নিজেকে কমিউনিস্ট মনে করে ও পরিষ্কার বোঝে যে যুব কমিউনিস্ট লীগে যোগ দিয়ে সে কমিউনিজম নির্মাণে পার্টিকে এবং কমিউনিস্ট সমাজ নির্মাণে সমগ্র তরুণ প্রজন্মকে সাহায্য করার দায়িত্ব নিয়েছে, এমন প্রত্যেকের সামনেই রয়েছে এই কর্তব্য। তাকে বুঝতে হবে যে এটা সে গড়তে পারে কেবল আধুনিক শিক্ষার ভিত্তিতে, এবং এই শিক্ষা যদি সে অর্জন না করে তাহলে কমিউনিজম কেবল একটা বাসনা হয়েই থেকে যাবে।
আরো পড়ুন
- সাহিত্য প্রসঙ্গে গ্রন্থ সম্পর্কে একটি আলোচনা
- রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রকৃতি প্রেম ও প্রকৃতিবাদ এবং বাঙলাদেশের পরিবেশ
- ছিন্নপত্র তুলে ধরে উনিশ শতকের বাঙলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন
- ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী পরিচয় ও জীবনবোধকে তুলে ধরে পত্রসাহিত্য ছিন্নপত্র
- পূর্ববঙ্গের পদ্মা তীরবর্তী প্রকৃতির চিত্র ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিন্নপত্রে
- লোকায়ত সাময়িকপত্রের চার্লস ডারউইন সংখ্যা বিবর্তন বিশ্লেষণ করেছে
- ছিন্নপত্রে কবিত্ব হচ্ছে কবি রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক গদ্যের চিঠির সংকলন
- অভিবাসন-এর মাধ্যমে মানিক সমাজের অর্থনীতিকে তুলে ধরেছেন
- সাহিত্যিক বাস্তববাদ সত্যদৃষ্টি দিয়ে বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে
- চেতনা প্রবাহ হচ্ছে সাহিত্য সমালোচনায় একটি বর্ণনামূলক উপায় বা পদ্ধতি
- অলংকার সাহিত্য ও ভাষণে বক্তব্য বলিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে বাক্যাড়ম্বরের ব্যবহার
- সাহিত্যে রস হচ্ছে সাহিত্য পাঠের ফলে বিষয়ের অনুধাবনসূত্রে বহুবিধ ভাবের সৃষ্ট
- নয়া ঐতিহাসিকতাবাদ সাহিত্যের ইতিহাসমনস্ক বিচারের একটি ধারা
কী শিখব, সাবেকী স্কুল ও সাবেকী বিদ্যা থেকে কী নেব, সেই প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। কীভাবে তা শিখতে হবে এই প্রশ্নের জবাব দেবারও চেষ্টা করব এবার। জবাব হলো: কেবল স্কুলের কাজের প্রতিটি ধাপ, তালিম দেওয়া, মানুষ করে তোলা ও শিক্ষাদানের প্রতিটি ধাপকে শোষকদের বিরুদ্ধে সমস্ত মেহনতীর সংগ্রামের সঙ্গে অচ্ছেদ্যরূপে যুক্ত করেই।
কমিউনিজমের এই তালিম কীভাবে এগুবে তা দেখাবার জন্য আমি কোনো কোনো যুব সংগঠনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু দৃষ্টান্ত দেব। সবাই নিরক্ষরতা দূর করার কথা বলছে। আপনারা জানেন, নিরক্ষর দেশে কমিউনিস্ট সমাজ গড়া যায় না। সোভিয়েত সরকারের পক্ষ থেকে একটা বিশেষ নির্দেশ জারি বা পার্টির পক্ষ থেকে একটা বিশেষ স্লোগান পেশ বা সেই কর্তব্যে সেরা কিছু কর্মীকে বরাদ্দ করাই যথেষ্ট নয়। তরুণ পরিষদের নিজেদেরই কর্তব্যটি তুলে নিতে হবে। কমিউনিজমের মানে হলো যুব জনেরা, যুবলীগের অন্তর্ভুক্ত তরুণ তরুণীরা বলবে; এটা আমাদের কাজ, ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা নিরক্ষরতা দূর করার জন্য গ্রামাঞ্চলে যাব, আমাদের উঠতি প্রজন্মের মধ্যে যেন একজনও নিরক্ষর না থাকে। এই কর্তব্যে উঠতি যুবজনের আত্মোদ্যোগ কাজে লাগাবার চেষ্টা করছি আমরা। আপনারা জানেন, অজ্ঞ নিরক্ষর রাশিয়াকে চট করে একটা সাক্ষর দেশে পরিণত করা যায় না। কিন্তু যুবলীগ যদি এই কাজে লাগে, সমস্ত যুবজন যদি সকলের উপকারের জন্য খাটে, তাহলে চার লক্ষ তরুণ-তরুণীকে সঙ্ঘবদ্ধ করা এই লীগ যুব কমিউনিস্ট লীগ নামের যোগ্য হবে। লীগের আরেকটা কর্তব্য হলো, নিজে কোনো একটা বিশেষ জ্ঞান অর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে যেসব যুবজন নিজের জোরে নিরক্ষরতার তমসা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারছে না, তাদের সাহায্য করা। যুবলীগের সদস্য হওয়া মানে সাধারণ কর্মযজ্ঞে নিজের শ্রম ও উদ্যোগ উৎসর্গ করা। এই হলো কমিউনিস্ট তালিমের অর্থ। এই ধরনের কাজের মধ্য দিয়েই কেবল একজন তরুণ বা তরুণী সাচ্চা কমিউনিস্ট হয়ে ওঠে। এই কাজে যদি তারা ব্যবহারিক সাফল্য অর্জন করে, কেবল তবেই তারা কমিউনিস্ট হবে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, শহরতলির সব্জী-চাষের কথা ধরা যাক। এটা কি কাজ নয়? যুব কমিউনিস্ট লীগের এ একটা অন্যতম কর্তব্য। লোকে অনশন দিচ্ছে; কলকারখানায় অনশন চলছে। অনশন থেকে নিজেদের বাঁচার জন্য সব্জী-ভুঁই বাড়িয়ে তোলা দরকার। কিন্তু চাষ চলছে সাবেকী পন্থায়। তাই, কাজটি নিতে হবে তাদের যারা বেশি সচেতন, তখন দেখা যাবে সব্জী-ভুঁইয়ের সংখ্যা বাড়ছে, আবাদের আয়তন বাড়ছে, ফল ভাল হচ্ছে। এই কাজে সক্রিয় অংশ নিতে হবে যুব কমিউনিস্ট লীগকে। প্রতিটি লীগ এবং লীগের প্রতিটি চক্রকে এটা নিজেদের কর্তব্য বলে গণ্য করতে হবে।
যুব কমিউনিস্ট লীগের হওয়া চাই একটা ঝটিতি বাহিনী, সব কাজে যারা সাহায্য করবে, উদ্যোগ দেখাবে। লীগ এমন হওয়া চাই যাতে যে-কোনো শ্রমিকই দেখে যে তা এমন সব লোক নিয়ে গড়া, যাদের মতবাদ সে নাও বুঝতে পারে, যাদের মতবাদ সে সম্ভবত এক্ষুণি বিশ্বাসও না করতে পারে, কিন্তু যাদের জীবন্ত কাজকর্ম থেকে সে যেন দেখতে পায় যে সত্যসত্যই এই লোকেরাই তাকে সঠিক রাস্তা দেখাচ্ছে।
এইভাবে সর্বক্ষেত্রে যদি যুব কমিউনিস্ট লীগ তার কাজ সংগঠিত করতে না পারে, তবে তার অর্থ হবে সাবেকী বুর্জোয়া পথে নেমে যাওয়া। সংগ্রামের সঙ্গে, যাতে কমিউনিজমের শিক্ষাপ্রসূতে কর্তব্য পালন করতে সাহায্য হয় মেহনতীদের।
সব্জী-ভুঁই উন্নয়নের জন্য, বা কোনো কলকারখানায় যুবজনের শিক্ষাসংগঠন, ইত্যাদির জন্য অবকাশের প্রতিটি ঘণ্টা ব্যয় করতে হবে লীগের সদস্যদের। দীনহীন অভাগা দেশ থেকে রাশিয়াকে আমরা রূপান্তরিত করতে চাই সমৃদ্ধ দেশে এবং যুব কমিউনিস্ট লীগ যেন তার শিক্ষা, বিদ্যার্জন ও তালিমকে মেলায় শ্রমিক-কৃষকদের মেহনতের সঙ্গে, বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যেন না থাকে এবং কেবল কমিউনিস্ট গ্রন্থ ও পুস্তিকা পাঠেই সীমাবদ্ধ না হয়। শ্রমিক-কৃষকদের সঙ্গে একত্রে কাজ করেই কেবল খাঁটি কমিউনিস্ট হওয়া সম্ভব। সকলেই যেন দেখতে পায় যে যুবলীগের প্রতিটি সভ্য শিক্ষিত এবং সেইসঙ্গে কর্মদক্ষও। সবাই যখন দেখবে যে, আমরা সাবেকী স্কুল থেকে সাবেকী হাবিলদারী পদ্ধতি বিতাড়িত করে সচেতন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছি, সমস্ত তরুণ-তরুণী সুবোৎনিকে[৩] অংশ নিচ্ছে, শহরতলির প্রতিটি খামারকে তারা ব্যবহার করছে অধিবাসীদের সাহায্যের জন্য, তখন লোকে আগে যে-ভাবে শ্রমকে দেখত, সেভাবে দেখবে না।
যুব কমিউনিস্ট লীগের কর্তব্য হলো গ্রামে অথবা শহরের নিজের মহল্লায় এই ধরনের ব্যাপারে সাহায্য করা: যেমন, ছোটো একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা বা খাদ্যের বিতরণ। সাবেকী পুঁজিবাদী সমাজে তা করা হত কীভাবে? প্রত্যেকেই খাটত কেবল নিজের জন্য, বুড়ো বা রুগ্ন কেউ আছে কিনা, সংসারের সব কাজ মেয়েদের ঘাড়ে পড়ছে কিনা, যার ফলে তারা পীড়ন ও দাসত্বের অবস্থায় থাকছে, এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। এ নিয়ে লড়াই করার দায় কার? এটা যুব কমিউনিস্ট লীগের দায়, তাদের বলতে হবে: এসব আমরা বদলে দেব, আমরা যুবদল সংগঠন করব, যারা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে বা খাদ্য বিতরণ করতে সাহায্য করবে, নিয়মিত বাড়ি পরিদর্শন করবে তারা, গোটা সমাজের হিতের জন্য তারা সংগঠিতভাবে কাজ করবে, যথাযুক্তরূপে নিজেদের লোকবল বণ্টন করবে, দেখিয়ে দেবে যে শ্রম হওয়া চাই সংগঠিত শ্রম।
আজ যাদের বয়স প্রায় পঞ্চাশ সেই প্রজন্ম কমিউনিজম দেখে যাবার আশা করতে পারে না। তার আগেই এই প্রজন্মের মৃত্যু হবে। কিন্তু আজ যাদের বয়স পনের, সে প্রজন্ম কমিউনিস্ট সমাজ দেখবে এবং নিজেরাই তারা এই সমাজ গড়বে। তাদের জানতে হবে যে তাদের জীবনের সমগ্র উদ্দেশ্যই হলো সে সমাজ গড়া। সাবেকী সমাজে লোকে খাটত আলাদা আলাদা পরিবার হিসেবে, জনগণকে যারা পীড়ন করত সেই জমিদার ও পুঁজিপতি ছাড়া কেউ তাদের শ্রমকে ঐক্যবদ্ধ করত না। শ্রম যত নোংরা বা কঠিনই হোক, তেমন সমস্ত শ্রমকেই আমাদের এমনভাবে সংগঠিত করতে হবে যাতে প্রতিটি শ্রমিক ও কৃষক ভাবতে পারে: মুক্তশ্রমের মহাবাহিনীর আমি একটা অংশ, জমিদার ও পুঁজিপতি ছাড়াই আমি আমার জীবন গড়ে তুলতে পারি, কমিউনিস্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি। কৈশোর থেকেই সচেতন ও সুশৃংখল শ্রমে সবাইকেই তালিম দিতে হবে যুব কমিউনিস্ট লীগকে। যেসব সমস্যা আমাদের সম্মুখীন তার সমাধান হবে, এই ভরসা আমরা পেতে পারি কেবল এইভাবেই। আমাদের ধরে নেওয়া উচিত যে, অন্তত দশ বছর লাগবে দেশের বৈদ্যুতীকরণের জন্য, যার ফলে প্রযুক্তির সর্বাধুনিক সুকৃতি দিয়ে আমাদের নিঃস্বীভূত মাটির সেবা করা যাবে। তাই যাদের এখন পনের বছর বয়স, দশ কি কুড়ি বছর কালের মধ্যে যারা কমিউনিস্ট সমাজে বাস করবে, সেই প্রজন্মের শিক্ষার সমস্ত কর্তব্য এমনভাবে দাঁড় করাতে হবে যাতে প্রতিটি শহর ও প্রতিটি গ্রামের যুবজনেরা প্রতিদিন যত ছোটো হোক, যত সহজ হোক, সাধারণ শ্রমের কোনো-না-কোনো একটা সমস্যা নিয়ে ব্যবহারিকভাবে তার সমাধান করে। প্রতিটি গ্রামে তা যে-পরিমাণে ঘটবে, কমিউনিস্ট প্রতিযোগিতা যে-পরিমাণে বাড়বে, যে-পরিমাণে যুবজনেরা প্রমাণ দেবে যে তারা তাদের শ্রম ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, সেই পরিমাণেই কমিউনিস্ট নির্মাণের সাফল্য হবে নিশ্চিত। এই নির্মাণের সাফল্যের দিক থেকেই কেবল আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে বিচার করেই, ঐক্যবদ্ধ সচেতন মেহনতী হবার জন্য আমাদের যা সাধ্য তা সব করেছি কিনা নিজেদের এই প্রশ্ন করেই কেবল যুব কমিউনিস্ট লীগ তার পাঁচ লক্ষ সদস্যকে শ্রমের একক বাহিনীতে পরিণত করতে পারবে ও সকলের শ্রদ্ধার্জন করবে। (তুমুল করতালি।)
৪১ খন্ড, ২৯৮-৩১৮ পৃঃ
আরো পড়ুন
- ধর্ম প্রসঙ্গে গ্রন্থের রুশ সংস্করণের ভূমিকা
- লেনিনবাদী বিশ্বদৃষ্টিতে ধর্ম
- সংগ্রামী বস্তুবাদের তাৎপর্য
- যুব লীগের কর্তব্য
- রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-এর খসড়া কর্মসূচি থেকে ধর্ম প্রসঙ্গে
- নারী-শ্রমিকদের প্রথম সারা রুশ কংগ্রেসে বক্তৃতা
- মাক্সিম গোর্কির কাছে
- মাক্সিম গোর্কির কাছে
- ধর্ম এবং যাজনতন্ত্রের প্রতি মনোভাব অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণি আর পার্টি
- ধর্ম প্রসঙ্গে শ্রমিক পার্টির মনোভাব
- লেভ তলস্তয় – রুশ বিপ্লবের দর্পণ
- সমাজতন্ত্র ও ধর্ম
- লেনিন রচিত ধর্ম প্রসঙ্গে বইয়ের পূর্বকথা ও সূচিপত্র
টিকা:
১. কলচাক, আলেক্সান্দর ভাসিলিয়েভিচ (১৮৭৩ – ১৯২০) – জার সৈন্যবাহিনীর অ্যাডমিরাল, রাজতন্ত্রী। অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর নিজেকে রাশিয়ার সর্বোচ্চ শাসক ঘোষণা করে উরাল, সাইবেরিয়া ও দূর প্রাচ্যে সামরিক বুর্জোয়া-জমিদার একনায়কত্বের নেতৃত্ব করেন। ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ কলচাকের সৈন্যবাহিনী লাল ফৌজের হাতে বিধ্বস্ত হয়।
২. দেনিকিন, আন্তন ইভানভিচ (১৮৭২ – ১৯৪৭) – জার সৈন্যবাহিনীর জেনারেল; গৃহযুদ্ধের সময় শ্বেতরক্ষী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান। ১৯১৯ সালে দক্ষিণ রাশিয়ার শ্বেতরক্ষী বাহিনী নিয়ে মস্কো আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১৯২০ সালের শুরুতে লাল ফৌজ তার বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে।
৩. কমিউনিস্ট সুবোৎনিক হলো ‘সমাজের কল্যাণে পৃথক-পৃথক লোকের ব্যাপক পরিসরে শ্রম, যা রাষ্ট্র থেকে নির্দিষ্ট নয় এবং করা হয় বিনা পারিশ্রমিকে’ (ভ ই লেনিন)। প্রথম সুবোৎনিকগুলোর আয়োজন হয় গৃহযুদ্ধের সময়, যখন নবীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে নিয়মিত কাজের পর শনিবারে শনিবারে (রুশ ভাষায় শনিবার – সুবোতা) মেহনতিরা বিনা বেতনে কাজ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক জাতীয় অর্থনীতির পুনঃস্থাপন ও বিকাশের পর্বে কমিউনিস্ট সুবোৎনিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (২২ এপ্রিল, ১৮৭০ – ২১ জানুয়ারি, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।