(প্রচন্ড স্বাগতধ্বনি তুলে কংগ্রেসের নারী-শ্রমিকরা লেনিনকে অভিবাদন জানায়।) কমরেডগণ, কতকগুলি দিক থেকে প্রলেতারিয় ফৌজের নারী অংশের কংগ্রেসের বিশেষ জরুরি তাৎপর্য বর্তমান, কারণ সমস্ত দেশেই নারীদের আন্দোলনে আসা কঠিনতর হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন হতে পারে না যদি মেহনতি নারীদের বৃহত অংশটা তাতে ব্যাপকভাবে যোগ না দেয়।
সমস্ত সভ্য দেশে, এমনকি সবচেয়ে অগ্রণী দেশেও মেয়েদের অবস্থা এমনই যে তাদের সাংসারিক বাঁদি বলা হয়, আর সেটা অকারণে নয়। কোনো পুঁজিবাদি রাষ্ট্রেই এমনকি সবচেয়ে মুক্ত প্রজাতন্ত্রেও নারীদের পূর্ণ সমাধিকার নেই।
সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের কর্তব্য হল সর্বপ্রথমে নারী অধিকারের সমস্ত সীমাবদ্ধতা দূর করা। বুর্জোয়া নোংরামির, দলিতাবস্থা ও লাঞ্ছনার যা উৎস, বিবাহবিচ্ছেদের সেই মামলাবিধি সোভিয়েত রাজ পুরোপুরি বিলুপ্ত করেছে।
পুরোপুরি স্বাধীন বিবাহবিচ্ছেদ আইন হয়েছে প্রায় এক বছর। আমরা ডিক্রি জারি করেছি; এতে বিবাহোদ্ভুত ও বিবাহবহির্ভূত সন্তানের অবস্থায় সবকিছু ভেদাভেদ লোপ এবং এক রাশি রাজনৈতিক বাধানিষেধ দূর করা হয়েছে। মেহনতি নারীদের এমন পরিপূর্ণ সমাধিকার ও স্বাধীনতা আর কোথাও নেই।
আমরা জানি যে অচল হয়ে আসা নিয়মের সমস্ত বোঝাটাই পড়ে শ্রমিক শ্রেণির নারীদের উপর।
যেসব কারণে নারীরা অধিকারহীন হয়ে থাকে, ইতিহাসে এই প্রথম তা সব নাকচ করে দিয়েছে আমাদের আইন। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু আইন নিয়ে নয়। আমাদের শহর ও কলকারখানা-এলাকায় বিবাহের পূর্ণ স্বাধীনতার আইনটা ভালোই চলছে, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এটা প্রায়শই থেকে যাচ্ছে কাগজে। সেখানে এখনো পর্যন্ত গির্জা-বিয়ের প্রাধান্য। পুরোহিতদের প্রভাবের জন্য তারা এতে বাধ্য হয় এবং পুরনো আইনের চেয়ে এই অভিশাপটার সংগে লড়াই করা বেশ কঠিন।
ধর্মীয় কুসংস্কারের সংগে সংগ্রামে অসাধারণ সতর্ক হওয়া চাই। এ সংগ্রামে যারা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে তারা অনেক ক্ষতি করে। প্রচারের মাধ্যমে, জ্ঞানপ্রচারের মাধ্যমে লড়াই চালানো উচিত। সংগ্রামে তিক্ততা সৃষ্টি করে আমরা জনগণকে রুষ্ট করে তুলতে পারি; এ রকম সংগ্রামে ধর্মের ভিত্তিতে জনগণের বিভাগ পাকা হয়ে পড়ে, অথচ আমাদের শক্তিই হলো একতা। ধর্মীয় কুসংস্কারের গভীরতম উৎস হলো দারিদ্র ও তমসাচ্ছন্নতা; এই অভিশাপের সংগে আমাদের লড়তে হবেই।
স্বাধীনতা প্রসঙ্গে একটি আলোচনা শুনুন
মেয়েদের অবস্থা এখনো পর্যন্ত এমন থেকে গেছে যে তাদের বাঁদি বলা হয়। মেয়েরা নিজেদের সাংসারিক ঘরকন্নার চাপে পীড়িত, এ অবস্থা থেকে তাকে ত্রাণ করতে পারে কেবল সমাজতন্ত্র। যখন আমরা খুদে জোত থেকে চলে যাব যৌথ জোত ও ভূমির যৌথ কর্ষণে, কেবল তখনই নারীদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলমোচন সম্ভব হবে। এ কাজটা কঠিন, কিন্তু এখন যখন গরিবদের কমিটি গড়ে উঠছে তখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পাকা হবার সময় আসন্ন।
কেবল এখনই গ্রামবাসীদের গরিব অংশটা সংগঠিত হচ্ছে এবং তার মধ্যে, গরিবদের সংগঠনের মধ্যে সমাজতন্ত্র পাচ্ছে পাকা বনিয়াদ।
আগে প্রায় এমন হয়েছে যে শহরগুলি আগে বিপ্লবি হয়ে উঠেছে, গ্রামাঞ্চল নেমেছে তার পরে।
বর্তমান পরিবর্তন চলেছে গ্রামের উপর ভর করে, আর এইখানেই তার তাৎপর্য ও শক্তি। সমস্ত মুক্তি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে মেয়েরা তাতে কী পরিমাণ অংশ নিচ্ছে তার উপরে বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করে। মেয়েরা যাতে স্বাধিনভাবে তাদের প্রলেতারিয় সমাজতান্ত্রিক কাজ চালাতে পারে, তার জন্য সোভিয়েত ক্ষমতা সবকিছু করছে।
সোভিয়েত রাজের পরিস্থিতি সেই পরিমাণেই দুরূহ যে পরিমাণে সমস্ত দেশের সাম্রাজ্যবাদীরা সোভিয়েত রাশিয়াকে ঘৃণা করছে ও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করছে এইজন্য যে সোভিয়েত রাশিয়া বেশ কয়েকটি দেশে বিপ্লবের আগুন জালিয়ে তুলেছে ও সমাজতন্ত্রের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপ করেছে।
এখন যখন তারা বিপ্লবি রাশিয়াকে চূর্ণ করতে চায় তখন তাদেরই পায়ের তলায় আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। আপনারা জানেন কীভাবে জার্মানিতে বিপ্লবি আন্দোলন ছড়াচ্ছে, ডেনমার্কে সরকারের সংগে সংগ্রাম চলছে শ্রমিকদের। সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ডে জোরদার হচ্ছে বিপ্লবি আন্দোলন। এই সব দেশের ছোট ছোট দেশের বিপ্লবি আন্দোলনের কোনো স্বাধিন গুরুত্ব নেই, কিন্তু তা বিশেষ রকমের অর্থবহ এইজন্য যে এসব দেশে যুদ্ধ হয়নি এবং সবচেয়ে ‘ন্যায়সঙ্গত’ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই সেখানে বর্তমান ছিল। এ রকম দেশও যখন আন্দোলনে আসে, তখন এই আস্থাই জাগে যে বিপ্লবি আন্দোলন সারা বিশ্বকে গ্রাস করছে।
এ পর্যন্ত কোনো প্রজাতন্ত্রই নারীদের মুক্ত করতে পারেনি। সোভিয়েত রাজ সহায়তা করছে তাদের। আমাদের আদর্শ অপরাজেয়। কেননা সব দেশেই উত্থিত হচ্ছে অপরাজেয় শ্রমিক শ্রেণি। অপরাজেয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বৃদ্ধিই সূচিত করছে এ আন্দোলন। (দীর্ঘ করতালি। আন্তর্জাতিক সংগীত।)
আরো পড়ুন
- নারী-শ্রমিকদের প্রথম সারা রুশ কংগ্রেসে বক্তৃতা
- সিমন দ্য বোভেয়া: ব্রিজিত বার্দো এবং ললিতা সিনড্রোম ও অন্ধ হয়ে আসা চোখ গ্রন্থের আলোচনা
- মুক্তি প্রসঙ্গে মার্কসবাদ
- নারী বই দুই বাংলার লেখকদের নারী মুক্তি বিষয়ক বিভিন্ন রচনার সংকলন
- নারীমুক্তির প্রশ্নে লেনিনবাদ শোষণ ও অধীনতা থেকে মুক্তির কথা বলে
- সাম্যের নারীবাদী ভাবনা হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মালিকানা অর্জনে সমতা
- নারীমুক্তি প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাক্ষাৎকার
- সেলিনা হোসেনের সাক্ষাৎকার — আদর্শবিহীন রাজনীতি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়
- হাসনা বেগমের সাক্ষাৎকার — আমাদের শত্রু হলো রাষ্ট্র ব্যবস্থা
- নারীবাদ পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট একটি পুরুষতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন
- নারীমুক্তি হচ্ছে সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন
- ধর্ম প্রসঙ্গে গ্রন্থের রুশ সংস্করণের ভূমিকা
- লেনিনবাদী বিশ্বদৃষ্টিতে ধর্ম
- সংগ্রামী বস্তুবাদের তাৎপর্য
- যুব লীগের কর্তব্য
- রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-এর খসড়া কর্মসূচি থেকে ধর্ম প্রসঙ্গে
- নারী-শ্রমিকদের প্রথম সারা রুশ কংগ্রেসে বক্তৃতা
- মাক্সিম গোর্কির কাছে
- মাক্সিম গোর্কির কাছে
- ধর্ম এবং যাজনতন্ত্রের প্রতি মনোভাব অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণি আর পার্টি
- ধর্ম প্রসঙ্গে শ্রমিক পার্টির মনোভাব
- লেভ তলস্তয় – রুশ বিপ্লবের দর্পণ
- সমাজতন্ত্র ও ধর্ম
- লেনিন রচিত ধর্ম প্রসঙ্গে বইয়ের পূর্বকথা ও সূচিপত্র
টীকাঃ
১. নারী-শ্রমিকদের প্রথম সারা রুশ কংগ্রেস মস্কোয় অনুষ্ঠিত হয় ১৯১৮ সালের ১৬-২১ নভেম্বর; এই কংগ্রেস ডেকেছিল রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি। কলকারখানা শ্রমিক এবং গরীব কৃষকদের মধ্য থেকে ১১৪৭ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন এই কংগ্রেসে।
২. এখানে লিখিত প্রবন্ধটি ভ. ই. লেনিন-এর ধর্ম প্রসঙ্গে নামে প্রকাশিত গ্রন্থের সপ্তম প্রবন্ধ যা ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা. লি. কলকাতা থেকে প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২০০৬ মুদ্রণ থেকে নেয়া হয়েছে।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (২২ এপ্রিল, ১৮৭০ – ২১ জানুয়ারি, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।