ব্রিটিশ পুঁজিবাদী দার্শনিক টমাস হবসের সার্বভৌম তত্ত্ব (ইংরেজি: Sovereignty Theory of Thomas Hobbes) মোতাবেক শাসক চরম, অবিভাজ্য ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর মতে, সার্বভৌম শাসক হচ্ছে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি যার যাদের নিকট জনগণ তাদের যাবতীয় অধিকার ও ক্ষমতা বিনা শর্তে সমর্পণ করে। জনগণ সার্বভৌম শাসকের নিকট তাদের সকল ক্ষমতা অর্পণ করে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে। হবসের সার্বভৌমত্বের ধারণা তার সামাজিক চুক্তি মতবাদ থেকে প্রত্যক্ষভাবে উদ্ভূত। মানুষ প্রকৃতির রাজ্যের অসহনীয় ও কদর্য পরিবেশ থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে নিজেদের মধ্যে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, যার মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তি তাদের নিজ নিজ অধিকার সম্মিলিতভাবে সার্বভৌমের নিকট সমর্পণ করে। এ চুক্তিতে কিন্তু সার্বভৌম কোনো অংশগ্রহণ করেন নি। সার্বভৌম চুক্তির বাইরে অবস্থান করেন। সুতরাং এটা একতরফা চুক্তিতে পরিণত হয়েছে। চুক্তির ফলে সার্বভৌম আর জনগণের নিকট দায়ী থাকলেন না। তিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেন। এর ফলে সার্বভৌম শাসক স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেন। এভাবে হবস তার সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে তৎকালীন ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট রাজাদের স্বৈরাচারী শাসনের সমর্থন করেছেন।
টমাস হবস সার্বভৌম শাসককে চরম ক্ষমতার আধার বলে চিত্রিত করেছেন। সার্বভৌমের ইচ্ছাকে অপর কোনো ঊর্ধ্বতন কিংবা অধস্তন কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। রাষ্ট্রের সার্বভৌম শাসকের সমকক্ষ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ থাকতে পারে না। সার্বভৌম শাসকই সকল প্রকার আইনের উৎস এবং তাদের ব্যাখ্যাদাতা। সার্বভৌম শাসক যাবতীয় আইনের উর্ধ্বে অবস্থান করেন। হবসের মতে, কেউ সার্বভৌম শাসকের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারবে না। কারণ সমগ্র জনগণ স্বেচ্ছায় সার্বভৌমের হাতে তাদের সমস্ত অধিকার ও ক্ষমতা বিনা শর্তে হস্তান্তর করেছে। এভাবে হবস সার্বভৌম শাসককে চরম, অবিভাজ্য ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী বলে বর্ণনা করে তাঁর সার্বভৌম তত্ত্ব প্রদান করেছেন।
সার্বভৌমত্বের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক বিষয়ে হবসের অভিমত
টমাস হবস কেবল চুক্তির উপর আস্থা স্থাপন করতে পারেন নি। শুধু কথা বা চুক্তির শর্ত দিয়ে ব্যক্তির বা মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ক্রোধ, লোভ, কলহপ্রিয়তা সংযত করা যায় না। দেশ শাসন করার জন্য একদিকে যেমন আইন দরকার, অন্যদিকে তেমনি তরবারিও থাকা প্রয়োজন। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, প্রকৃত আইনের প্রভাবে মানুষের মধ্যে যদি যৌক্তিকতার উন্মেষ ঘটে তাহলে তরবারির প্রয়োজনীয়তা কেন? মনে হয় হবসের ধারণা হয়েছিল যে, সমাজের সবাই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে পড়বে এমন কোনো কথা নেই। বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তি যাতে ঐক্য ও সংহতি নষ্ট করতে না পারে তার জন্য আইন ও তরবারির সাহায্যে এর কঠোর প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়। হবস মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা পূর্ণাঙ্গরূপে সুনিশ্চিত করতে হলে প্রচণ্ড ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তি স্থাপন করা দরকার। বিদেশী শক্তির আক্রমণ পর্যুদস্ত করাই এ শক্তির লক্ষ্য। ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন সরকার ছাড়া কেউ নিরাপত্ত নিশ্চয়তা দিতে পারে না। হবস এ শক্তিকে সার্বভৌম শক্তি বলেছেন। হবস এর ভাষায়, “The only way to create such a common power as may be able to element them from the invasion of foreigner and the injuries of one another.”
টমাস হবস সার্বভৌম শাসককে Mortal God বলে অভিহিত করেন এবং তাঁর হাতে তরবারি প্রদান করে তাঁর হাতকে সুদৃঢ় করেছেন। হবস বলেছেন, “Covenants without sword are but words and of no strength to secure a man at all.”
তথ্যসূত্র
১. ড. রবিউল ইসলাম, মীর মোশাররফ হোসেন ও অন্যান্য, রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি, গ্রন্থ কুটির ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ৩৯০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।