সুভাষচন্দ্র বসুর সমাজতান্ত্রিক চিন্তা হচ্ছে সংস্কারবাদী অমার্কসবাদী ক্ষুদে-বুর্জোয়া

সুভাষচন্দ্র বসুর সমাজতান্ত্রিক চিন্তা (ইংরেজি: Socialistic thoughts of Subhas Chandra Bose) হচ্ছে সংস্কারবাদী অমার্কসবাদী ব্যক্তিস্বাধীনতা, মুনাফা ও ব্যক্তি মালিকানাপন্থী ক্ষুদে-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র। অর্থাৎ তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারার সারবস্তুতে প্রতিক্রিয়াশীল অংশ হচ্ছে তাঁর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা।

সুভাষচন্দ্র বসুর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল মূলত সমাজতন্ত্রের দিকে। তার প্রত্যাশা ছিল যে স্বাধীনতা লাভের পর স্বদেশে সমাজতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার কায়েম হবে। তবে সমাজতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রের কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেন নি। তিনি শুধু বলেছেন যে, এই সরকারের অধীনে জাতি, গোত্র, ধর্ম নির্বিশেষে সকলে অবিমিশ্র স্বাধিকার ছাড়াও আর্থনীতিক স্বাধীনতা ভোগ করবে। তার মতে আর্থনীতিক স্বাধীনতা বলতে বুঝায় সকলের শ্রমদানের সমান অধিকার এবং জীবন ধারণের জন্য উপযুক্ত শ্রমমূল্য প্রাপ্তির অধিকার।

সমাজতান্ত্রিক ভারতে পরোপজীবী শ্রেণীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে এবং অনর্জিত আয় বলে কিছু থাকবে না। তাছাড়া, সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমুক্ত ন্যায়নীতি অনুসরণ করা হবে। উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এরূপ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ণ সামাজিক সাম্য কায়েম থাকবে, সকলে সমান সুযোগসুবিধা ভোগ করবে এবং নারী-পুরুষের ব্যবধান দূর হবে। মোট কথা, জনগণের সমষ্টিগত জীবনের মূল ভিত্তি হবে ন্যায়বিচার, সাম্য, স্বাধীনতা, শৃঙ্খলা এবং প্রেম। সুভাষ বসু বিশেষ করে আর্থনীতিক ও রাজনীতিক দাসত্বকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছেন, কেননা উভয়ই মানুষের দুঃখদুর্দশা ও বিভিন্ন প্রকার অসাম্যের মূল কারণ। 

তিনি সমাজতন্ত্রের আদলে স্বদেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন বটে, কিন্তু মার্কসবাদী আদর্শ পুরোপুরিভাবে গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি বলেন, এদেশে মার্কসবাদী ভাবধারা উত্তাল তরঙ্গের মতো এসেছে সত্য এবং অনেকেই পরম উৎসাহে একে স্বাগত জানিয়েছে, তবে এদেশে মার্কসবাদী সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের পূর্বে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকে তার প্রয়োগযোগ্যতা যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন। ভারতের ক্ষেত্রে মার্কসবাদ পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য কিনা সে সম্পর্কে তিনি সন্দেহমুক্ত হতে পারেন নি।

প্রসঙ্গত তিনি রাশিয়ার বলশেভিকদের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রতি আঙ্গুলি নির্দেশ করেন। তিনি বলেন যে রাশিয়ার জনগণও মার্কসবাদী আদর্শ গ্রহণকালে তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য, জাতীয় আদর্শ, দেশের সমস্যা ও দৈনন্দিন জীবনের দাবি ইত্যাদির কথা বিস্মৃত হয় নি। আজ কার্ল মার্কস বেঁচে থাকলে আধুনিক রাশিয়ার চেহারা দেখে তিনি সম্ভবত ক্ষুব্ধ হতেন। অতএব বিদেশী ও বিজাতীয় আদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের অন্ধ অনুকরণ এদেশের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। অর্থাৎ সুভাষচন্দ্র বসুর সমাজতান্ত্রিক চিন্তা হচ্ছে সমাজতন্ত্রকে একটি অর্থনৈতিক পর্ব হিসেবে না দেখে তাকে বিদেশী রাজনীতি হিসেবে ভুল মূল্যায়ন।

সামাজিক পরিবর্তন কিভাবে আসবে – বিপ্লব না বিবর্তনের পথে, সে সম্পর্কে তিনি সুস্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত দেন নি। তার মতে বিপ্লব ও বিবর্তনের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। বিপ্লব এক ধরনের বিবর্তন যা তুলনামূলকভাবে স্বল্পকালের পরিসরে পরিবর্তন ঘটায়; অপর পক্ষে বিবর্তন এক প্রকার বিপ্লব যা ধীরে ধীরে ও দীর্ঘকাল ধরে পরিবর্তন আনে। উভয়ের মূলকথা একই ও পরিবর্তন বা একের জায়গায় অন্যের অধিষ্ঠান।

তথ্যসূত্র

১. সৈয়দ মকসুদ আলী, রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণ জানুয়ারি ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ১৮০-১৮১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!