ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি হচ্ছে মন্টেস্কুর আইন, শাসন ও বিচার ক্ষমতার পৃথকীকরণ

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বা ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতি ( ইংরেজি: Separation of Powers) হচ্ছে চার্লস লুই দ্য মন্টেস্কু সৃষ্ট আইন, শাসন ও বিচার ক্ষমতার পৃথকীকরণ সংক্রান্ত নীতি। মন্টেস্কু কিভাবে জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় তা নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করেন এবং তাঁর এই চিন্তাভাবনা থেকেই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবর্তন করেন।

মন্টেস্কুর জন্মের পর ফরাসি দেশে স্বৈরশাসক জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার্থে মোটেও উৎসাহ দেখাত না। বরং নানা রকম পীড়নমূলক উপায় অবলম্বন করে জনগণের স্বাধীনতা হরণ করতো। মন্টেস্কু ছিলেন স্বাধীনতার একনিষ্ঠ ভক্ত এবং স্বাধীনতা রক্ষার চিন্তা থেকে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবর্তন করেন।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কাকে বলে?

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বলতে বুঝায় রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন, শাসন ও বিচার ক্ষমতা পৃথক ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির হাতে অর্পণ করা যাতে এক বিভাগ অন্য বিভাগের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের এই ধারণা প্রাচীনকালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নিকটও পরিচিত ছিল। এরিস্টটল, পলিবিয়াস, সিসেরো প্রমুখ চিন্তাবিদগণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগেও এই মতবাদের সমর্থন মিলে। মধ্যযুগে মার্সিলিও অব পাদুয়া ও জিন বডিন এবং আধুনিক যুগে হবস, লক প্রভৃতি দার্শনিকগণও এই মতবাদ সমর্থন করেন। রাষ্ট্র বিজ্ঞানী মন্টেস্কু সুনির্দিষ্ট নীতি হিসেবে স্বতন্ত্রীকরণকে সমর্থন করেন। কিন্তু পরিপূর্ণ ক্ষমতা ̄স্বতন্ত্রীকরণ বাস্তবে দেখা যায় না। এটি কাম্যও নয়। তাই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের সাথে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ ও ভারসাম্যের নীতির কাম্যতা অনেকেই স্বীকার করেন।

মন্টেস্কু ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্থ “The spirit of laws” গ্রন্থে। আমাদের আলোচ্য নিবন্ধে মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রকৃতি আলোচনা করা হলো।

মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রকৃতি

মন্টেস্কু উক্ত গ্রন্থে বলেন যে, “যখন একই ব্যক্তি বা শাসকবর্গের হাতে আইন রচনা করার ও শাসন করার ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়, তখন স্বাধীনতা থাকতে পারে না, অথবা প্রণয়নের ক্ষমতা ও শাসন ক্ষমতা যদি বিচার বিভাগ হতে স্বতন্ত্র না হয়, তাহলেও স্বাধীনতা থাকতে পারে না। (“When legislative and executive powers are united in the same person of the governing body. there can be no freedom. Nor is there freedom where the power to adiudicate is not seperated from legislative power and the executive power”)। তাহলে স্বেচ্ছামূলক নিয়ন্ত্রণের কবলে পড়ে ব্যক্তিজীবন ছটফট করতে থাকবে। শাসন ক্ষমতার সাথে বিচার ক্ষমতা যুক্ত হলে ন্যায় বিচারের নামে প্রহসন হতে পারে এবং শাসকদের খেয়াল চরিতার্থ করবার সুযোগ ঘটে। সুতরাং এই তিন প্রকার ক্ষমতা অবশ্যই পৃথক হবে এবং বিভিন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা এমনভাবে ব্যবহৃত হতে হবে যেন একটি অপরটির সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে (“The three powers then must be seperated, exercised by different individuals is such a way as to act as checks and balances against one another.”)।

তিনি তাঁর ব্যাখ্যায় বলেন, ক্ষমতালব্ধ প্রতিটি মানুষের ঝোঁক থাকে ক্ষমতা অপব্যবহারের দিকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কর্তৃত্বকে সীমিত করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সে তার কর্তৃত্ব চালিয়ে যেতে থাকবে। তাই সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা আলাদাভাবে বণ্টন করতে হবে।

মন্টেস্কুর মতে, কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের একচেটিয়া সরকারি ক্ষমতা দিয়ে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে ব্যক্তি স্বাধীনতার অপরিহার্য শর্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। একই বিভাগের হাতে ক্ষমতা নিয়োজিত থাকলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হতে বাধ্য বলে মন্টেস্কু উল্লেখ করেন। কাজেই স্বাধীনতার স্বার্থেই সরকারের ক্ষমতা পৃথকীকরণ করা একান্ত প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ২ মার্চ, ২০১৯, “মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রসঙ্গে”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/philosophy/montesquieus-seperation-of-power/
২. মো. আবদুল ওদুদ, “চার্লস দ্য মন্টেস্কু”, রাষ্ট্রদর্শন, মনন পাবলিকেশন, ঢাকা, দ্বিতীয় প্রকাশ; ১৪ এপ্রিল ২০১৪; পৃষ্ঠা ৩২২-৩২৬।

রচনাকাল: ২ মার্চ ২০১৯, নেত্রকোনা, বাংলাদেশ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!