রাষ্ট্রচিন্তায় রুশোর অবদান প্রকৃতির রাজ্য, সামাজিক চুক্তি, সার্বভৌমত্ব ও ইচ্ছাতত্ত্বে

রাষ্ট্রচিন্তায় জ্যাঁ জ্যাক রুশোর অবদান (ইংরেজি: Rousseau’s contribution to Political Thought) প্রকৃতির রাজ্য, সামাজিক চুক্তি, সার্বভৌমত্ব এবং সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্বে। রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) এক উজ্জল নক্ষত্র। তিনি অতি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃ-মাতৃহীন ভবঘুরে রুশো শুধুমাত্র আপন প্রতিভাবলে রাষ্ট্রদর্শনে নিজের ঠাই করে নিতে সক্ষম হয়েছিলন। ফরাসী বিপ্লবের বুদ্ধিবৃত্তিক পটভূমি সৃষ্টিকারী অন্যতম চিন্তাবিদ এ দার্শনিক তাঁর সামজিক চুক্তি মতবাদের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। মানুষের মুক্ত ও স্বাধীন জীবনের জন্য সর্বদা আকাংখী রুশো বিজ্ঞান, শিল্প ও সভ্যতার বিকাশকে মানুষের স্বাধীন সত্তার বিরুদ্ধে ‘শৃঙ্খল’ বলে মনে করতেন। আর এ শৃঙ্খল থেকে মানুষের স্বাধীনতাকে মুক্ত করতে তিনি তাঁর লেখনী পরিচালনা করেছিলেন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে অসমতার উৎপত্তি (Discourse of the orgin of inequality), রাজনৈতিক অর্থনীতি (Political Economy), সামাজিক চুক্তি (The Social Contact) ইত্যাদি প্রসিদ্ধ। 

রাজনৈতিক দর্শনে রুশোর অবদান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি যুক্তিবাদের প্রতি গভীর  বিতৃষ্ণা পোষণ করতেন। অনেকে একে যুক্তির বিরুদ্ধে রুশোর বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। এ মনোভাবই ছিল তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার মূল উৎস ও উদ্দেশ্য। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, মেধা, বুদ্ধি প্রভৃতির উপর রুশোর কোনো প্রকার আস্থা ছিল না। তিনি ভাবতেন এগুলো মানুষের জীবনের জন্য প্রতিবন্ধক। এগুলো মানুষকে অমানুষ করে তোলে বলে রুশো মনে করতেন। আর এর সমাধান হিসেবে তিনি প্রাকৃতিক রাজ্যে ফিরে যাওয়ার সুপারিশ করেছেন। তাই প্রাকৃতিক রাজ্য ও সামাজিক চুক্তি রুশোর দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব পোষণকারী রুশো নৈতিকতার প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেন। তিনি মনে করতেন মানুষের সুখী ও স্বাধীন জীবন যাপনের জন্য শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও নৈতিকতার বেশি প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী সামাজিক চুক্তি মতবাদী দার্শনিক তথা হবস এবং লক থেকে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। কারণ হবস ও লকের মতে সমাজ জীবনে মৌলিক লক্ষ্য ছিল উপযোগ তথা শান্তি ও নিরাপত্তার উপযোগ। প্রকৃতির রাজ্যে এর অভাবই রাষ্ট্র  প্রতিষ্ঠার মূল কারণ। অন্যদিকে রুশোর মতে সমাজ গঠনের একমাত্র লক্ষ্য হলো মানুষের নৈতিকতার পরিপূর্ণ বিকাশ। এ ক্ষেত্রে আমরা রুশোর চিন্তায় প্লেটোর পূর্ণাঙ্গ এবং এরিস্টটলের মনোভাবের আংশিক প্রকাশ দেখতে পাই। 

প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে রুশো

দার্শনিক রুশো তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদ্বয়- টমাস হবস এবং জন লকের মত প্রকৃতির রাজ্যে বিশ্বাস করতেন। তবে তাঁর প্রকৃতির রাজ্যের প্রকৃতি উল্লিখিত দু’জন দার্শনিক থেকে ভিন্নতর। হবসের ন্যায় তিনি প্রকৃতির রাজ্যের মানুষকে স্বার্থপর, কলহপ্রিয় ও আত্মকেন্দ্রিক মনে করেন নি। আবার লকের ন্যায় যুক্তিবাদী বলেও ভাবেন নি। রুশোর মতে স্বার্থপরতা ও কলহবিবাদ ইত্যাদি সমাজ স্থাপনের পর দৃষ্টিভূত হয়। ক্ষমতা লিপ্সা ও সম্পত্তি জড়ো হওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে যুক্তিবোধ এবং স্বার্থপরতার জন্ম নেয়। সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধির ও তা সংরক্ষণের মানসে মানুষ অন্যের সাথে যুদ্ধ ও কলহে লিপ্ত হতে শুরু করে এমতাবস্থায় ‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মালেও সর্বত্রই শৃঙ্খলিত’ হতে থাকে। অথচ সিভিল রাষ্ট্রের জন্মের পূর্বে মানুষের জীবন ছিল সহজ ও সরল। তাদের মধ্যে কোনরূপ অহংকার বোধ ছিল না। তারা ছিল ভীরু, সংঘর্ষ-বিমুখ এমনকি এ অবস্থা ছিল নীতিপূর্বাবস্থা। ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার মতো বুদ্ধিও মানুষের মধ্যে ছিল না।

সামাজিক চুক্তি 

রুশোর ‘দি সোসাল কন্ট্রাক্ট’ পুস্তকে রাষ্ট্রীয় সংস্থার গোড়াপত্তনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থেই রুশোর সামাজিক চুক্তিতত্ত্বের অবদান চোখে পড়ে। তার মতে সামাজিক চুক্তির ফলেই উক্ত সংগঠনের জন্ম হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এবং কি ভাবে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল? এ চুক্তির ফলাফলই বা কি? রুশো বলেছেন যে, সময়ের পরিবর্তনের সাথে প্রকৃতির রাজ্যের অবস্থা বদলাতে থাকে। ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে মানুষের সাম্য, স্বাধীনতা ও সুখ শান্তি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে থাকে। আত্মরক্ষার প্রতিপক্ষ শক্তি প্রবল হওয়ার ফলে ব্যক্তি এককভাবে সে শক্তিকে মোকাবিলা করতে পারছিল না। এমতাবস্থায় মানুষ বুঝতে পারলো যে, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের জোটবদ্ধ হতে হবে। কারণ তারা বুঝতে পারলো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে নতুন কোনো শক্তি তৈরি করা সম্ভব নয়। কেবল মাত্র বিরাজমান শক্তিগুলোকে একত্রিত করা যায়। এ বোধ থেকেই অনুষ্ঠিত হয় সামাজিক চুক্তি (Social contact)। কিন্তু জোটবদ্ধ হওয়ায় তারা কারো অধীনস্থ হল না। অতীতের ন্যায় তাদের স্বাধীনতা অব্যাহত থাকলো। এই সম্মিলিত জীবন ব্যবস্থা স্বাধীনতা হননকারী হয়ে উঠলো না। কারণ তিনি বলেন, এ অবস্থায় প্রত্যেকে সমবেতভাবে নিজ নিজ জীবন ও ক্ষমতা সাধারণ ইচ্ছার চূড়ান্ত পরিচালনার কাছে সপে দেয়। তবে যুথবদ্ধ জীবন-ব্যবস্থায় প্রত্যেকে সার্বিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে যা দিল তা আবার ফিরে পেল। যৌথ শক্তি ব্যক্তিগত শক্তির চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তাই রাষ্ট্রীয় সংগঠন অবশ্যই অধিক ফলপ্রসু। এ কারণেই মানুষ বিনা দ্বিধায় রাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। 

রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তাঁর এ তত্ত্ব হবস ও লক থেকে অনেকটা স্বতন্ত্র। চুক্তির ফলেই রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল। এক্ষেত্রে তাঁরা সবাই একমত পোষণ করলেও চুক্তির ধরন ও চুক্তির উদ্ভব, ক্ষমতার ব্যবহার সম্পর্কে তাদের সকলের ধারণা একরূপ নয়। হবস জনগণকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করেছেন। রুশোর চুক্তিকারী কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ জনগণ-সরকারের হাতে চরম ক্ষমতা দেয়নি বা সরকারের সমালোচনা করা অথবা বিদ্রোহ করার অধিকার থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করেনি। রুশোর সামাজিক চুক্তি অনেকটা লকের অনুকরণে গড়া। উভয়েই জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস মনে করেছেন। উভয়েই বলেছেন জনগণ প্রয়োজনে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকারী। বলাবাহুল্য, জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব রুশো লকের নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন। তবে উভয়ের তত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। লক বুর্জেয়া বিকাশের ধারায় গণতান্ত্রিক চেতনা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। লকের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণার চেয়ে রুশোর সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্ব পৃথক ইঙ্গিতবাহী। তাছাড়া রুশো লকের মত বিপ্লবের বাণী প্রচার করেননি। সরকারের উপর আস্থাহীন হলে জনগণ লকের মতে বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারকে পরিবর্তন করতে পারবে। অন্যদিকে রুশোর জনগণ সদা সর্বদা সক্রিয়। সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে লক শর্তারোপ করলেও রুশো কোনো প্রকার শর্ত দেন নি। তাঁর মতে জনগণ কোনো প্রকার শর্তের অধীন নন। তাঁরা যখন চাইবেন তখনই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। সুতরাং দৃশ্যত লকের চেয়ে রুশোর কাছে জনগণ আরও বেশি ক্ষমতাশালী ও স্বাধীন। 

রুশোর মতে, সামাজিক চুক্তির ফলে জনগণ লাভবান হয়। তিনি বলতে চান চুক্তির ফলে মানুষ পায় স্বাধীনতা ও বিষয় সম্পত্তির উপর পূর্ণ মালিকানা। সর্বোপরি জনগণ নৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে। নৈতিক স্বাধীনতাকে রুশো প্রকৃত স্বাধীনতা বলে মনে করতেন। 

সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে রুশোর ধারণা 

রুশোর মতে সাধারণ ইচ্ছা এবং সার্বভৌমত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। রুশোর সার্বভৌমত্ব জনগণ ব্যতীত অন্য কারও উপর ন্যস্ত নয়। তাঁর মতে ব্যক্তি, সংস্থা বা সরকার কখনও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। রুশোর সার্বভৌম তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়:

  • রুশোর মতে সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তর যোগ্য নয়। কারণ সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তর যোগ্য হলে যারা এ ক্ষমতার মালিক অর্থাৎ জনগণ সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলবে। এ জন্য তিনি সার্বভৌমত্বকে হস্তান্তর যোগ্য করতে চান নি। 
  • রুশোর মতে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃতিই এমন যে তা কখনও ভুল করতে পারে না। অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব অভ্রান্ত প্রকৃতির, সার্বভৌম কখনও অন্যায় করতে পারে না। কারণ সাধারণ ইচ্ছা সব সময়েই মানুষের সামগ্রিক কল্যাণমুখী। 
  • সার্বভৌম ক্ষমতা অভিভাজ্য। এ ক্ষমতাকে ভাগ করা যায় না। এখানে তিনি সার্বভৌম ক্ষমতাকে জীবদেহের সাথে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ এর বিভক্তির অর্থ দাঁড়ায় একে শক্তিহীন করা। বলাবাহুল্য-এ ধারণার দ্বারা মন্টেস্কুর ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছে। 
  • সার্বভৌম ক্ষমতা চরম এবং চূড়ান্ত, সকলেই এর নির্দেশ মানতে বাধ্য। কোনটি ব্যক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও মঙ্গলময় তা কেবল সার্বভৌম শক্তিই বিচার করবে। সাধারণ ইচ্ছার নির্দেশ সকলেই মেনে চলতে বাধ্য। এ চরম ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। 
  • তবে রুশো সার্বভৌম ক্ষমতার কতিপয় সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। সার্বভৌম ক্ষমতা কল্যাণ বিরোধী কোনো নির্দেশ দিলে জনগণ তা মানতে বাধ্য হবে না। তাছাড়া সার্বভৌম ক্ষমতা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি লংঘন করবে না।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে রুশোর সার্বভৌমত্বের প্রতি উপলব্ধি করা যায়। তার প্রণীত সার্বভৌমত্ব বিমূর্ত সাধারণ ইচ্ছা নির্ভর এবং কিঞ্চিত স্ববিরোধপূর্ণ।

সাধারণ ইচ্ছা 

রুশোর রাজনৈতিক দর্শনে অবদান বিষয়ে সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রুশোর সাধারণ ইচ্ছার ধারণাটি জটিল প্রকৃতির। এ তত্ত্বটি রুশোর চিন্তাধারাকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলেছে। রুশোর মতে সাধারণ ইচ্ছা এবং সকলের বা অধিকাংশের ইচ্ছা এক নয়। সাধারণ ইচ্ছা হলো রাষ্ট্রের সেই ইচ্ছা যা জনগণের কল্যাণের জন্য পরিচালিত হয়। তাই সকলের ইচ্ছা (Will of all) এবং সাধারণ ইচ্ছা (General will) এক নাও হতে পারে। সকলের ইচ্ছার মধ্যে যদি সাধারণ ও অভিন্ন স্বার্থ না থাকে এবং তা যদি বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত হয় তবে সে ইচ্ছা সাধারণ ইচ্ছা হতে পারে না। সুতরাং কোনো ইচ্ছাকে সাধারণ ইচ্ছা হতে হলে তাকে অবশ্যই মানুষের অভিন্ন স্বার্থে ও সামগ্রীক কল্যাণের মনোভাব ধারণ করতে হয়। সকলের ইচ্ছা অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা উপরোক্ত গুণ সম্পন্ন নাও হতে পারে। রুশোর মতে সাধারণ ইচ্ছা বৃহত্তর ব্যক্তিস্বার্থ বিদ্বেষী নয়। কার্যত সংকীর্ণ ব্যক্তি স্বার্থের বশবর্তী হয়ে কাজ করলে তা ঐ ব্যক্তির স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যায়। অন্যদিকে সাধারণ ইচ্ছায় বশবর্তী হয়ে কাজ করলে ঐ কাজ তার স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। তাই মানুষকে দিয়ে সাধারণ ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে কাজ করিয়ে নিতে হয় বস্তুত তার নিজের ভালোর জন্যেই। এই অবস্থাকে রুশো যথার্থ ‘স্বাধীন হতে বাধ্য করা’কে বুঝিয়েছেন (To force man to be free)। 

রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদ নানা দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। তাঁর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বটি বিমূর্ত। এটি কি ভাবে বাস্তবে প্রয়োগ হতে পারে যে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায় নি। মানুষকে স্বাধীন করতে বাধ্য করার অভিলাস স্বৈরশাসক ও স্বেচ্ছাচারিতা ও সর্বাত্মকবাদী ব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে। তাই অনেকে মনে করেন রুশোর এ তত্ত্বটি অসংগতি ও স্ববিরোধিতাপূর্ণ। 

রুশোর দর্শনের সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন 

বিখ্যাত দার্শনিক টি. এইচ. গ্রীনের মতে রুশোর প্রভাব আমেরিকার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠাকারীদের উপর পড়েছিল। তাছাড়া ফরাসী বিপ্লবের প্রেরণাদাতাদের অন্যতম হিসেবে রুশোর নাম উচ্চস্বরে উচ্চারিত হয়ে থাকে। স্বাধীনতা সম্পর্কে রুশের ধারণা তুলনাহীন। রুশো প্রকৃতপক্ষে মানুষকে নৈতিক গুণসম্পন্ন ও দায়িত্বশীল করতে চেয়েছিলেন। সামগ্রিক কল্যাণই রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য এ সত্যটি তিনি বার বার উচ্চারণ করতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজ কর্মের সাথে জনগণকে সম্পৃক্ত করার স্পৃহা রুশোকে প্রচলিত গণতন্ত্রপন্থী দার্শনিকদের চেয়েও এক ধাপ উপরে ঠাই করে দিয়েছে। তবে রুশোর বিরুদ্ধে স্ববিরোধিতার অভিযোগ পুরোপুরি খন্ডন করা যায় না। সাধারণ ইচ্ছার তত্ত্ব ও সার্বভৌমত্বের ধারণাকে তিনি বাস্তবমুখী এবং সুস্পষ্ট করতে পারেন নি। সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রুশোর অবদান মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্খার ইতিহাসে অনবদ্য।

সারকথা 

সামাজিক চুক্তি মতবাদী ফরাসি দার্শনিক রুশো সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্বের বানীর জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। রুশোর রাষ্ট্রদর্শনে প্রধান অবদান হয়েছে মানুষের স্বাধীনতাকে সত্যিকার ও পরিপূর্ণভাবে অর্থবহ করা। সকল মানুষের স্বার্থে রাজনৈতিক সংগঠনকে পরিচালনার জন্য তিনি সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব প্রচার করেছেন। তবে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন স্ববিরোধী ও তা স্বৈরশাসকের জন্ম দিতে পারে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।

তথ্যসূত্র

১. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, মো আব্দুর রশীদ, এ এমদাদুল হক ও অন্যান্য; রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় খণ্ড, রাষ্ট্রচিন্তা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ত্রয়োদশ প্রকাশ, ২০২০, পৃষ্ঠা ১৩৮-১৪১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!