প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বিরোধী হিসাবে নির্বাচিত ব্যক্তি চালিত

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র (ইংরেজি: Representative democracy), যা পরোক্ষ গণতন্ত্র বা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার নামেও পরিচিত, এক প্রকার গণতন্ত্র যা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বিরোধী হিসাবে একদল নির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রতিকী নীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় সমস্ত পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রগুলি একধরণের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র হিসাবে কাজ করে।

সপ্তদশ শতক থেকেই সরকারের ক্ষমতার উৎস হিসাবে ঈশ্বরের পরিবর্তে জনগণকে চিহ্নিত করণের প্রক্রিয়াটি চুক্তিবাদী দার্শনিক টমাস হবস, জন লকজ্যাঁ জ্যাক রুশোর রচনার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু জনগণের ইচ্ছার প্রকাশ কীভাবে সরকারের মধ্যে ঘটবে তা পরবর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার বিষয় হয়ে উঠে। গণতন্ত্র সম্পর্কে জন স্টুয়ার্ট মিল কোনো পূর্ব সিদ্ধান্তকে আশ্রয় না করে এক দিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার গণতন্ত্রের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেন এবং অন্য দিকে গ্রীক দার্শনিক এবং পরবর্তী সময় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের তত্ত্বের আলোকে গণতন্ত্রের বিশ্লেষণে অগ্রসর হন। 

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র সম্পর্কে মিলের ধারণা

রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থার উপর শিল্প বিপ্লব ও শিল্পনীতি যে সমস্ত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, মিলের রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়ক রচনায় তার সুস্পষ্ট প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে ব্যাক্তি স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা এবং পাশাপাশি অবাধ প্রতিযোগীতার পরিবেশকে বজায় রাখা তৎকালীন সময়ে সম্ভব হচ্ছিল না। সাধারণ মানুষের জীবনে দারিদ্র দুর্দশা চরম আকার ধারণ করলে অভাবী মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা হয়ে ওঠে চূড়ান্ত সঙ্কটাপন্ন। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে নিরাপদ ও তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা সুরক্ষিত করার লক্ষ, রাষ্ট্রের সেবামূলক ও কল্যাণকর কাজ সম্পাদন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হতে থাকে। তখন থেকেই উদারনীতিবাদিরা ব্যক্তি স্বাধীনতা নির্ভর উদারনীতিবাদের সাথে মানবতার সম্বন্বয় ঘটানোর প্রয়োজন বোধ করেন। এইরূপ পরিস্থিতিতে জন স্টুয়ার্ট মিল ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের পক্ষে মত প্রচার করেন, যা পরবর্তীকালে মিলকে স্বতন্ত্র পরিচিতি দিতে সাহায্য করে।[১]

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র সম্পর্কে মিলের ধারণা তার বিখ্যাত গ্রন্থ Considerations On Representative Government গ্রন্থে প্রকাশিত হলেও ১৮৩৮ সালে রচিত Bentham গ্রন্থে সরকার সম্পর্কিত আলোচনায় তিনটি সমস্যার উল্লেখ করেন ১) জনগণ তাদের কল্যাণে যে সরকারকে মেনে চলবে সেই সরকারে কর্তৃত্বের প্রকৃতি কী হবে? ২) জনগণকে কর্তৃত্ব মেনে চলার জন্য কীভাবে উদ্বুদ্ধ করা যাবে। ৩) সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। মিলের গণতন্ত্র সম্পর্কের ধারণার ভিত্তি এই প্রশ্নগুলির মধ্যেই লুকিয়ে আছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মিল ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপূরক বলে মনে করতেন। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মিল প্রত্যেক ব্যক্তিকে একমাত্র তাদের হাতে ভোটদানের ক্ষমতা দিতে চান যারা শিক্ষিত এবং কর প্রদানকারী ব্যক্তি। তৎকালীন ইউরোপে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ব্যাপারে অধিকাংশই ছিল বিরোধী, মিলও ব্যক্তির জন্মগত স্বাভাবিক রাজনৈতিক অধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন না। মিলের বক্তব্য ছিল কোনো ব্যক্তির কাছে ভোটাধিকারের চেয়ে গুরুত্বপূরর্ণ বিষয় হলো সুশাসিত হওয়া অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতার যাতে অপপ্রয়োগ না হয় এবং সুশাসন যাতে বজায় থাকে তা নিশ্চিত করা।

মিল বিশ্বাস করতেন ব্যক্তি যদি শিক্ষিত না হয়, তাহলে ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে বেরিয়ে সমাজ যথাযথ ও স্থায়ী উন্নতি করা সম্ভবপর হয় না। এই কারণে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনেরও পক্ষপাতিত্ব ছিলেন না। মিল গণতন্ত্রের অন্যতম সমর্থক হলেও তিনি ছিলেন সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিরোধী, তার কাছে জাতি,বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই ভোটাধিকার থাকবে যদি সেই ব্যক্তি শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হন।

মিলের মতে রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হলো ব্যক্তির জীবনের সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, ব্যক্তি জীবনে গুণগত উৎকর্ষ বিধান করা। অধিকাংশ ব্যক্তি যেহেতু জীবনের গুণগত উৎকর্ষের দিকটি সম্পর্কে সম্যকভাবে পরিচিত নয়, সেহেতু যারা গুণগত উৎকর্ষ সম্বন্ধে সচেতন তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে পরিচালনা করবে। মিল এই রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিদের সৃজনশীলতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। মিল সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থকে বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, প্রকাশ্য ভোটদান ইত্যাদির কথা বলেন, যদিও মিল সচেতনভাবেই মুষ্টিমেয় অংশের উপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এর ফলে সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ কীভাবে বজায় থাকবে বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি কীভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবে তার কোনো যথার্থ দিক নির্দেশ পাওয়া যায় না।[২]

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; পঞ্চম সংস্করণ জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৮৬-২৮৭
২. গোবিন্দ নস্কর, Political thought, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ৩০-৩১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!