লেনিনবাদী বিশ্বদৃষ্টিতে ধর্ম বা ধর্ম সম্পর্কে লেনিনবাদী মত হচ্ছে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে ধর্মের সদর্থক ও নঞর্থক স্বরূপ বিশ্লেষণ করে জনগণকে সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে তোলা। সাম্যবাদী বা কমিউনিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, সাম্যবাদীরা জনগণের ধর্মীয় আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। জনগণের অন্যান্য সকল স্বাধীনতার ন্যায় তারা জনগণের ধর্মকর্ম পালন বা না পালন, ধর্মীয় চিন্তা ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের বা না পালন করার স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করেন। এছাড়াও তারা সমাজের পেছনে পড়ে থাকা দরিদ্র জনগণকে শ্রেণিসংগ্রামের শিক্ষায় সংগঠিত করে তাঁদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সকল অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শামিল করেন।
ধর্ম সম্পর্কে বলা যায়, যে অর্থনীতি ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছে সেই অর্থনীতির পুনস্থাপন দরকার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দ্বারা। ধর্ম, কুপমণ্ডুকতা, ভুলশিক্ষা ও ভাববাদ কমতে পারে প্রকৃতিবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও বস্তুবাদের বিস্তারের সাপেক্ষে।
বাংলাদেশের বামপন্থিদের ভেতরের সংশোধনবাদি অংশটি ধর্ম সম্পর্কে কখনোই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে তা বুঝতে পারেনি। সেই কারণে তারা হঠকারী বাক-স্বাধীনতাপন্থি, নাস্তিক, মুক্তমনা ও মুক্তচিন্তাপন্থিদের সমর্থন দিয়েছেন। স্থুল বস্তুবাদিরা এবং পিছিয়ে থাকা দরিদ্র অসহায় জনগণের ধর্মীয় আবেগের অবমাননাকারিরা নানা সময় নানাভাবে পশ্চাৎপদ জনগণের অশিক্ষা-কুশিক্ষা-ধর্মান্ধতা নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে পশ্চাৎপদ জনগণকে খেপিয়ে তুলেছেন। একবারও ভেবে দেখেননি মুক্তচিন্তার সাথে শুভচিন্তা যুক্ত না হলে সেই চিন্তা পশ্চাতপদ ও ভাববাদী হবেই। পাশ্চাত্যের বামপন্থিরাও এইসব হঠকারী বাক-স্বাধীনতাপন্থিদের সমর্থন দিয়ে আসছেন বহু বছর আগে থেকেই। অথচ লেনিনের মন্তব্য এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ছিলো। লেনিন বলেছেন,
“ধর্মীয় কুসংস্কারের সংগে সংগ্রামে অসাধারণ সতর্ক হওয়া চাই। এ সংগ্রামে যারা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে তারা অনেক ক্ষতি করে। প্রচারের মাধ্যমে, জ্ঞানপ্রচারের মাধ্যমে লড়াই চালানো উচিত। সংগ্রামে তিক্ততা সৃষ্টি করে আমরা জনগণকে রুষ্ট করে তুলতে পারি; এ রকম সংগ্রামে ধর্মের ভিত্তিতে জনগণের বিভাগ পাকা হয়ে পড়ে, অথচ আমাদের শক্তিই হলো একতা। ধর্মীয় কুসংস্কারের গভীরতম উৎস হলো দারিদ্র ও তমসাচ্ছন্নতা; এই অভিশাপের সংগে আমাদের লড়তে হবেই”[১]।
রিচার্ড ডকিন্স, মরিয়ম নামাজ়ী, তসলিমা নাসরিন, সালমান রুশদি—এরা সবাই একেকজন বিশাল ধর্মবিশেষজ্ঞ; একেকজন বিশাল ধর্মবিষয়ক পণ্ডিত। রাজনীতি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, প্রগতিশীলতা, বস্তুবাদ, প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি না করে তারা রক্ষণশীলতা, ধর্মের সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি নিয়ে প্রচার চালিয়েছেন। তারা যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় কাজ করেছেন তাতে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা এবং ধর্ম না পালনের স্বাধীনতা সংকীর্ণ হয়েছে। তারা সকলেই কারণে অকারণে রক্ষণশীল জনগণকে কথায় ও আচরণে আক্রমণ করেছেন। এইসব জগতখ্যাত ব্যক্তিরা সবাই প্রতিক্রিয়াশীলতার চূড়ান্ত এবং রাজনৈতিকভাবে নির্বোধ। অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যাপারে নির্বুদ্ধিতা ও নিষ্ক্রিয়তাই তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদের দালালীর পক্ষে দাঁড় করিয়েছে।
বিজ্ঞানের এতো বিশাল অগ্রগতির পরও মানুষগুলো কেন পিছিয়ে আছে? কেন আফ্রিকা এশিয়া লাতিন আমেরিকার কোটি কোটি জনগণ এখনো ঠিকমতো খেতে পায় না। প্রযুক্তির এতো উন্নতির পরও মানুষগুলোর অবস্থা বদলাচ্ছে না কেন? কারণ অর্থনীতি বদলাচ্ছে না। সাথে এটিও মনে রাখা দরকার প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিলেও প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদিরা কখনোই যুক্তিশীলতা ও বিজ্ঞানচিন্তাকে এগোতে দিতে চায় না। কারণ জনগণকে পেছনে ফেলে রাখতে পারলে তাদের শোষণকে টিকিয়ে রাখা সহজ।
জামায়াতে ইসলামির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি অবশ্যই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা। গ্রামের কৃষক ও কারখানার শ্রমিকেরা কোনোদিনই জামায়াতের প্রচারণা, গুজব ও রটনায় বিভ্রান্ত হয়নি। রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ইসলামি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার ও ছাত্রছাত্রীদের ভেতর জামায়াত বাড়লো কিন্তু নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারের শ্রমিকদের ভেতর তারা বাড়লো না কেন এ প্রশ্নে মনোযোগ দিলে আমরা দুটো দিকের দুটো প্রশ্নের জবাব পাব।
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে একটি আলোচনা দেখুন
প্রথম জবাব হচ্ছে জামায়াতে ইসলামির বৃদ্ধির পেছনে না জানা অনেক ব্যাপার আছে এবং দ্বিতীয় জবাব হচ্ছে বামপন্থি সংশোধনবাদিরা ধর্মের ক্ষেত্রে শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে সামনে এগোননি। লেনিন বলেছেন “ধর্মীয় বিবাদের দিকে জনগণের মন টানার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া সর্বত্রই সচেষ্ট” তিনি সেই প্রবন্ধেই আরো বলেছেন “প্রলেতারিয়েত এক ব্যাপক ও প্রকাশ্য সংগ্রাম চালাবে অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য”[২]।
এই অবস্থায় বৃহত্তর অর্থে কমিউনিস্টদের করণীয় কী। তারা সর্বদাই ধর্মকর্ম পালন করবার কিংবা না পালন করবার স্বাধীনতার পক্ষে থাকবে। কমিউনিস্টরা জনগণের ধর্মীয় আবেগ, ধর্মীয় চিন্তা এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আর রাজনৈতিক দিক থেকে তারা শ্রেণিসংগ্রামকে আঁকড়ে ধরে রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ করবেন। এটিই তাদের প্রথম কাজ। শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জনগণের ভেতরের সবচেয়ে পেছনে থাকা অংশটিকে রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে সামনে এগিয়ে নেবার, তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য লড়াই চালাবেন। এক্ষেত্রেও লেনিন আমাদের পথ দেখান। তিনি লিখেছেন,
“ধর্মীয় প্রশ্নকে বিমূর্ত, আদর্শবাদি কায়দায়, শ্রেণিসংগ্রামের সংগে সম্পর্কহীন ‘বুদ্ধিবাদি’ প্রসঙ্গরূপে উপস্থাপিত করার বিভ্রান্তিতে আমরা কোনো অবস্থায়ই পা দেব না—বুর্জোয়াদের রেডিক্যাল ডেমোক্র্যাটগণ প্রায়ই যা উপস্থাপিত করে থাকে। শ্রমিক জনগণের অন্তহীন শোষণ ও কার্কশ্য যে-সমাজের ভিত্তি, সেখানে বিশুদ্ধ প্রচার মাধ্যমে ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণের প্রত্যাশা বুদ্ধিহীনতার নামান্তর। মানুষের উপর চেপে থাকা ধর্মের জোয়াল যে সমাজমধ্যস্থ অর্থনৈতিক জোয়ালেরই প্রতিফলন ও ফল, এটা বিস্মৃত হওয়া বুর্জোয়া সংকীর্ণতারই শামিল। পুঁজিবাদের তামসিক শক্তির বিরুদ্ধে স্বীয় সংগ্রামের মাধ্যমে চেতনালাভ ব্যাতীত যেকোনো সংখ্যক কেতাব, কোনো প্রচারে প্রলেতারিয়েতকে আলোকপ্রাপ্ত করা সম্ভব নয়। পরলোকে স্বর্গ সৃষ্টি সম্বন্ধে প্রলেতারিয়েতের মতৈক্য অপেক্ষা পৃথিবীতে স্বর্গ সৃষ্টির জন্য নির্যাতিত শ্রেণির এই সত্যকার বৈপ্লবিক সংগ্রামের ঐক্য আমাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।”[৩]
কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় করণীয় হচ্ছে সংশোধনবাদীদের হাত থেকে বিপ্লবী সাম্যবাদী রাজনীতিকে মুক্ত করা এবং বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদের দালাল বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠীদের মুখোশ অনবরত উন্মোচন করা। বাংলাদেশ ও ভারতের বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সমর্থক সমাজ-গণতন্ত্রীরা জনগণের উপর শোষণকে দির্ঘস্থায়ি ও বৈষম্যকে চিরস্থায়ি করার জন্যই বারবার প্রচার করেছে মৌলবাদী ও রক্ষণশীলরাই দেশের প্রধান শত্রু। কমিউনিস্টরা এই প্রচারনায় কখনোই পা দেবে না, কারণ তারা জানে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালাল মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠীই জনগণকে নিপীড়ন ও নির্যাতন করে চলছে অবিরাম। এই নিপীড়নে বুর্জোয়ারা জনগণকে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিভক্তিটাকে বড় করে দেখায় মূলত ধনী গরিবের বিভক্তিটাকে আড়াল করবার জন্য। ফলে সাম্প্রদায়িক সামন্তবাদী পশুদের অর্থনীতি বা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিকে বিলুপ্ত না করে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু না করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা চর্চা বা সাম্প্রদায়িকতাবাদ বিলুপ্ত হবে না।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশে গত চার দশকে বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যম যাদেরকে প্রগতিশীল বলে প্রচার করেছে তারাই আসলে প্রতিক্রিয়াশীলতার চূড়ান্ত এবং প্রগতিশীলতার নামে বাংলাদেশ চলছে ইতিহাসের উল্টোদিকে।
আরো পড়ুন
- ধর্ম প্রসঙ্গে গ্রন্থের রুশ সংস্করণের ভূমিকা
- লেনিনবাদী বিশ্বদৃষ্টিতে ধর্ম
- সংগ্রামী বস্তুবাদের তাৎপর্য
- যুব লীগের কর্তব্য
- রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-এর খসড়া কর্মসূচি থেকে ধর্ম প্রসঙ্গে
- নারী-শ্রমিকদের প্রথম সারা রুশ কংগ্রেসে বক্তৃতা
- মাক্সিম গোর্কির কাছে
- মাক্সিম গোর্কির কাছে
- ধর্ম এবং যাজনতন্ত্রের প্রতি মনোভাব অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণি আর পার্টি
- ধর্ম প্রসঙ্গে শ্রমিক পার্টির মনোভাব
- লেভ তলস্তয় – রুশ বিপ্লবের দর্পণ
- সমাজতন্ত্র ও ধর্ম
- লেনিন রচিত ধর্ম প্রসঙ্গে বইয়ের পূর্বকথা ও সূচিপত্র
বাংলাদেশে যেসব সংশোধনবাদী পার্টি শ্রেণিসংগ্রাম ও অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তির সংগ্রামকে পরিত্যাগ করে শ্রেণি-সমন্বয়ের কোলে আত্মসমর্পণ করেছেন তারাই মৌলবাদের জুজুর ভয় দেখিয়ে আওয়ামি ফ্যাসিবাদের স্বপক্ষে কাজ করছেন এবং আওয়ামি-বিএনপির অর্থনীতি ও রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছেন। তারা মনে রাখেননি যে বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ খৃস্টান ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো যারা মোট জনসংখ্যার ১৪%, সেই ১৪% লোকের কাছে সাম্প্রদায়িকতা একটি সমস্যা; কিন্তু দেশের জনগণ, নিদেনপক্ষে ৯৫% জনগণের কাছে পুঁজিবাদী শোষণ ও লুটপাট এবং পুঁজিবাদের প্রধান কাণ্ডারি দল আওয়ামি-বিএনপিই সমস্যা।
তথ্যসূত্র:
১. ভি. আই. লেনিন; ১৯ নভেম্বর, ১৯১৮; নারী-শ্রমিকদের প্রথম সারা রুশ কংগ্রেসে বক্তৃতা, অনুচ্ছেদ ৭; ধর্ম প্রসঙ্গে, লেনিন, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, সেপ্টেম্বর ২০০৬, পৃষ্ঠা ৫৩।
২. ভি. আই. লেনিন; ৩ ডিসেম্বর ১৯০৫; সমাজতন্ত্র ও ধর্ম, অনুচ্ছেদ ১২-১৩; ধর্ম প্রসঙ্গে, লেনিন, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, সেপ্টেম্বর ২০০৬, পৃষ্ঠা ১১-১২।
৩. ভি. আই. লেনিন; ৩ ডিসেম্বর ১৯০৫; সমাজতন্ত্র ও ধর্ম, অনুচ্ছেদ ১০; ধর্ম প্রসঙ্গে, লেনিন, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, সেপ্টেম্বর ২০০৬, পৃষ্ঠা ১০-১১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।