মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রাষ্ট্রচিন্তা হচ্ছে সমাজতন্ত্র, জাতীয় মুক্তি ও নবমানবতাবাদ

মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এম এন রায়ের রাষ্ট্রচিন্তা (ইংরেজি: Political Thoughts of M N Roy) হচ্ছে মার্কসবাদ, সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র, জাতীয় মুক্তি, নবমানবতাবাদ, দলবিহীন গণতন্ত্র ইত্যাদির এক সমন্বয়। ভারতের জাতীয় রাজনীতির উপর মার্কসবাদী বিশ্লেষণের সংগঠিত প্রয়োগ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের আগে বিশেষ চোখে পড়েনি, যদিও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখ অনেকেই কম-বেশি সমাজতান্ত্রিক চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্যবাদী চিন্তার প্রসারে কমরেড মানবেন্দ্রনাথ রায়ের অবদান অসামান্য। এমনকি মানবেন্দ্রনাথই হলেন প্রথম ভারতীয় যিনি আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের প্রথম সারির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ভারতে মার্কসবাদী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারাটির তিনিই স্রষ্টা। তারই উদ্যোগে গঠিত হয় প্রথম ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি।

একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে বুর্জোয়া রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাধা ও নানা প্রতিকূলতাকে সহ্য করে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ধারাটিকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যান। কোনও ধর্মীয় বা নৈতিক ভাবনা নিয়ে নয়, ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক চেতনা নিয়ে। অসাধারণ বিশ্লেষণী শক্তি দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন জাতীয় আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি, তার নেতৃত্বের বিবর্তন, ভারতীয় সমাজের শ্রেণি বিন্যাস, বিভিন্ন শ্রেণির উত্থান, অবস্থান ও বিবর্তন।

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মার্কসবাদী রাষ্ট্রচিন্তা

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মানবেন্দ্রনাথ দেখান যে, আধুনিক ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি মূলত জমিদার শ্রেণিরই রূপান্তরিত রূপ এবং ব্রিটিশ শাসনের ফলশ্রুতি। তবে এদের অর্থনেতিক অসন্তোষকেই ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামের হাতিয়ার করে গড়ে তুলতে হবে। গ্রামের শোষিত বঞ্চিত মানুষ কিভাবে একটি প্রলেতারিয়েত শ্রেণি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে তারও একটি চিত্র তুলে ধরেন এম এন রায়। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন স্বরাজ এলে এইসব গরীব মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থের উন্নতি ঘটবে। তারা আগের থেকে খুশিতে থাকবে।

মানবেন্দ্রনাথ বস্তুবাদকে একটা দর্শন হিসাবে বিচার করেছেন। কার্ল মার্কস বস্তুবাদে উৎপাদন-সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।এম এন রায় মার্কসবাদকে বিকৃত করেছেন জীবনের শেষ প্রান্তে নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে। অতীন্দ্রিয় ভাববাদ সবসময়ই তার কাছে পরিত্যাজ্য। মানবেন্দ্রনাথ মনে করেন, মার্কসবাদে মানুষের ভূমিকা ও তার চিন্তন প্রক্রিয়া উপেক্ষিত। রায় মনোজগৎকেও বস্তুর অন্তর্গত বলে মনে করেন, কারণ মানুষের আচরণ মনোবিজ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যার ভিত্তি হচ্ছে শারীরবিদ্যা ও রসায়ন। চিন্তামস্তিষ্কের ক্রিয়া যা স্বাধীন গতিতে অগ্রসর হয় এবং যা পক্ষান্তরে পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি ইতিহাসের জৈব প্রক্রিয়ার অন্তর্গত।

জীবনের শেষ প্রান্তে র‍্যাডিকাল হিউম্যানিজমের তত্ত্বে বিশ্বাসী মানবেন্দ্রনাথ মার্কসবাদকে পরিত্যাগ করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। মার্কসবাদ কোনো স্থিতিশীল তত্ত্ব নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে তাকে নতুনভাবে ব্যবহার করাই যায়। সংস্কার ও সংশোধন মানেই বিচ্যুতি নয়; বরং বলা যেতে পারে, উদারতাবাদী স্বাধীনতার পূজারী মানবেন্দ্রনাথ যত না মার্কসবাদের বিরোধী ছিলেন তার থেকেও বেশি বিরোধিতা করেছেন মার্কসবাদী আধিপত্যবাদ, গোঁড়ামি ও বিভ্রান্তিকে। ১৯৪৭ সালেও তিনি মার্কসবাদকে মানব জ্ঞানের এক উচ্চ মানের দর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার নব মানবতাবাদ তিনি উর্ধ্বে তুলে ধরতে চেয়েছেন স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবতাবাদের পতাকাকে।

মানবেন্দ্রনাথ ও তার প্রতিক্রিয়াশীল নবমানবতাবাদ

নবমানবতাবাদ বা নয়া মানবতাবাদ বা র‍্যাডিকাল মানবতাবাদ বা র‍্যাডিকাল হিউম্যানিজম (ইংরেজি: Radical or Neo-humanism) দর্শন হচ্ছে মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এম এন রায়ের আজীবনকাল অর্জিত অনন্য অভিজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্যের চূড়ান্ত পরিণতি। স্বাধীন চিন্তার নিরঙ্কুশ প্রকাশে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। মূলত এই কারণেই তার কমিউনিস্ট জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কমিন্টার্ন বা সাম্যবাদী আন্তর্জাতিকে অবস্থানকালের শেষ পর্যায়ে এই নব্য জীবনদর্শনের বীজ তার মনে অংকুরিত হয়েছিল।

মূল নিবন্ধ: নবমানবতাবাদ

মানবতা কথাটি নতুন নয়। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এবং এদেশের বৈষ্ণব ও সন্ত দার্শনিকদের চিন্তায় এ-আদর্শের প্রভূত পরিচয় পাওয়া যায়। তার আলোচনা অন্য পরিচ্ছেদে ইতিপূর্বে করা হয়েছে। একমাত্র মানবেন্দ্রনাথই এদেশে আধুনিককালে মানবতাবাদকে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে দেখেছেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষের ব্যক্তিত্বের ও সৃজনশীলতার প্রতিকূল সমুদয় বাধা আপসারিত করেছে। বিজ্ঞানের কল্যাণেই মাষের সৃষ্টি সত্তা মুক্তি পেয়েছে, বিদূরিত হয়েছে যাবতীয় কুসংস্কারমূলক ভ্রান্তি ও ভীতি। অতীন্দ্রিয় চিন্তার আধিপত্য ও আধ্যাত্মিকতার শৃঙ্খল থেকেও মানুষ মুক্তি পেয়েছে।

দলহীন গণতন্ত্র

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো দলীয় রাজনীতি বর্জন। নিজের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখলেন, কি সংসদীয় গণতন্ত্র কি সমাজতন্ত্র সর্বত্রই ব্যক্তিস্বাধীনতা আজ তুচ্ছ ও গৌণ হয়ে পড়েছে। মানবেন্দ্রনাথ মনে করেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে যে নির্বাচন হয় তার ফলে ক্ষমতার কাছে জনপ্রতিনিধিরা আত্মসমর্পণ করায় শাসনের উপর জনগণের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। প্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা এক ধরনের প্রতারণা মাত্র। দলের কাছেই তাদের যাবতীয় দায়বদ্ধতা, মানুষের কাছে নয়। এর থেকেই উৎপত্তি যাবতীয় অনৈতিকতার।

মানবেন্দ্রনাথের মতে, একনায়কতন্ত্র যে ধরনেরই হোক না কেন, তা গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে না; কারণ তা ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী। তাই মানবেন্দ্রনাথের আহ্বান দল ব্যবস্থার অবসানের মধ্যে দিয়ে এক সক্রিয় সচেতন স্বশাসিত নাগরিক রাজনীতি গড়ে তোলার। তিনি চেয়েছিলেন, সারা দেশ জুড়ে গণ কমিটির ভিত্তির উপর গড়ে উঠবে পিরামিড আকৃতির রাষ্ট্রকাঠামো, সংসদ হবে তারই চূড়া। প্রতিটি নাগরিক দল-নিরপেক্ষ শিক্ষা ও প্রকৃত সমাজকল্যাণের চেতনা নিয়ে স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে গড়ে তুলবে তাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। তার ফলে রাষ্ট্রের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের স্থায়ী কর্তৃত্ব। এইভাবে গড়ে উঠবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ। অবশ্য এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায় যে, এভাবেই। শক্তিশালী ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের প্রভাব বিস্তার ও আধিপত্য বজায় রাখার সম্ভাবনা নির্মূল হবে কি?

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়টির সারাংশ 

পান্ডিত্য ও মননধারায়, রাজনৈতিক কর্ম ও বিপ্লবী সংগঠনে মানবেন্দ্রনাথ এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। দেশ, কাল বা যুগের সীমানায় তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তার মতো ব্যাপক কর্মক্ষেত্র খুব কম মনীষীর জীবনেই দেখা যায়। স্বাধীনতা বা মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কৈশোরে জাতীয়তাবাদ থেকে যৌবনে মার্কসবাদের মধ্যে দিয়ে অবশেষে নবমানবতাবাদে এসে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রাষ্ট্রচিন্তা পরিণত রূপ লাভ করে। ভারতীয় রাজনীতিকে তিনিই প্রথম বৈজ্ঞানিক, যুক্তিবাদী ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্লেষণ করেন। কোনও বাঁধাধরা ছকের গন্ডিতে আত্মসমর্পণ না করে দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যাকে ইউরোপীয় ভাবধারায় প্রভাবিত আন্তর্জতিক মঞ্চে জোরের সঙ্গে উপস্থাপিত করার কৃতিত্ব তার।

তবুও ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি একজন বিতর্কিত পুরুষ। বলা হয়, চিন্তাধারার চাঞ্চল্যকর বিবর্তন সত্ত্বেও তিনি কোনও নতুন পথের সন্ধান দিতে পারেননি। তার নবমানবতাবাদী চিন্তাধারাটি ভারতীয় ঐতিহ্যেরই অঙ্গ যা প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, মোহনদাস গান্ধী, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখের ভাবনায়। আরও বলা হয়, মানবেন্দ্রনাথ রাজনৈতিক ও সামাজিক গতি-প্রকৃতির যতই নির্ভুল বিশ্লেষণ করে থাকুন না কেন সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় তিনি সফল হতে পারেন নি। ফলে, তার রাজনৈতিক জীবনে এসেছ একের পর এক ব্যর্থতা। সেই কারণে ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি নিঃসঙ্গ নায়ক। তবুও মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রাষ্ট্রচিন্তা সংক্রান্ত অবদানকে স্বীকৃতি দিতেই হবে। বর্তমান বিশ্বের প্রধান সংকট হচ্ছে মুক্তি আর মানবতার সংকট। আর সেখানে যুক্তি, নীতি ও মুক্তির আদর্শে রচিত মানবেন্দ্রনাথের, সমাজ দর্শন যে সে পথে আলো দেখাবেই সে বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ।

তথ্যসূত্র

১. ড. চিত্রিতা চৌধুরী, “মানবেন্দ্রনাথ রায়”, ঐচ্ছিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নেতাজী সুভাষ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, সপ্তম পুনর্মুদ্রণ, আগস্ট ২০১৯, পৃষ্ঠা ২৫২-২৫৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!