জন স্টুয়ার্ট মিলের রাষ্ট্রচিন্তা (ইংরেজি: Political thoughts of John Stuart Mill) বা রাষ্ট্রদর্শন হচ্ছে উপযোগবাদ, উদারনীতিবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও নারীমুক্তি সম্পর্কে মিলের রাজনীতি বিষয়ক চিন্তাধারা। মিলের রাজনৈতিক দর্শন গড়ে উঠার ক্ষেত্রে ছোটবেলার শিক্ষা, বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের রচনা, সমসাময়িক তাত্ত্বিকদের সঙ্গে মত বিনিময়, এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।[১]
রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের অন্যতম প্রবক্তা হিসাবে জন স্টুয়ার্ট মিল বিশিষ্ট্য স্থান অধিকার করে আছে। তিনি তার উদারনৈতিক চিন্তাধারার মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ সংসদীয় গণতন্ত্র, নারী স্বাধীনতা এবং উপযোগবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যদিও তার আলোচনার প্রেক্ষাপট হিসাবে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দর্শনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
মিলের রাষ্ট্রদর্শনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব লক্ষ্য করা যায় জেরেমি বেনথাম ও জেমস মিলের উপযোগবাদ সম্পর্কিত ভাবনা চিন্তার। বেনথামের উপযোগবাদী তত্ত্বকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যান মিল, তবে এই উপযোগবাদের সাথে নৈতিক মূল্যবোধকে তিনি সংযুক্ত করেছিলেন। মিলের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে গড়ে উঠা ইংরেজ পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক সমাজকে এক মার্জিত রূপ দেওয়া। এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে তিনি গণতন্ত্রের পরিবর্তে অভিজাততন্ত্র বা এলিটতন্ত্র বা মুষ্টিমেয় বাছাই করা গুণীব্যক্তির শাসনকে সফলভাবে গৌরবান্বিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যাই হোক, মিল তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছেন।
জন স্টুয়ার্ট মিলের রাষ্ট্রচিন্তা
জন স্টুয়ার্ট মিল গ্রীক দর্শন বিশেষত গ্রীক দর্শনের শিক্ষার ধারণার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। এর পাশাপাশি উনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও সমাজ বিজ্ঞানীদের রাজনৈতিক চিন্তার দ্বারাও তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। আত্মজীবনীতে মিল তার রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার বিকাশ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে তার স্ত্রী হ্যারিয়েট মিলের অবদান সম্পর্কে বিশেষ উল্লেখ করেন।
ভাববাদ এবং বস্তুবাদকে দর্শনের ক্ষেত্রে দুই বিপরীত প্রান্ত হিসেবে মনে করে মিল উভয়কে স্বীকৃতি দিয়ে বলেন যে, বস্তু হচ্ছে অভিজ্ঞতাগত অনুভূতির সম্ভাবনা আর ভাব হচ্ছে মানসিক বোধের প্রকাশ। মানুষের অনুভব বা উপলব্ধির বাইরে বস্তুর কোনো অস্তিত্ব নেই। আর মানুষের অনুভব তার সেন্সেশন বা সংবেদনে সীমাবদ্ধ।
যুক্তির ক্ষেত্রে মিল অবরোহী বা ডিডাকটিভ যুক্তির চেয়ে আরোহী বা ইনডাকটিভ যুক্তির উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। আরোহী যুক্তির বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে তিনি সাদৃশ্য, বৈসাদৃশ্য, সহ-পরিবর্তন এবং অবশিষ্টাংশসূচক কয়েকটি পদ্ধতির ব্যাখ্যা করেন। এগুলি মিলের পদ্ধতি নামে বিশেষভাবে পরিচিত। ইংরেজীতে এই পদ্ধতিগুলিকে যথাক্রমে মেথড অব অ্যাগ্রিমেন্ট, মেথড অব ডিফারেন্স, মেথড অব কনকোমিট্যান্ট ভেরিয়েশন এবং মেথড অব রেসিডুস বলা হয়।
উপযোগবাদ ও জন স্টুয়ার্ট মিল
নীতিশাস্ত্রে জন স্টুয়ার্ট মিলকে উপযোগবাদী বলা হয়। তিনি তাঁর পূর্বগামী জেরেমি বেনথামের উপযোগবাদ বা ইউটিলিটারিয়ানিজম তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তি যে কারোর যে কোনো আচরণের ন্যায় অন্যায়ের মাপকাঠি হবে অধিকতর সংখ্যক মানুষের অধিকতম পরিমাণ সুখ উৎপাদনের উপযোগিতা। যে আচরণ মানুষের এরূপ সুখ উৎপাদনে উপযোগী, সে আচরণ ন্যায্য; যে আচরণ এর অনুপযোগী সে আচরণ অন্যায্য।
মূল নিবন্ধ: উপযোগবাদ
স্টুয়ার্ট মিলের মতে অবশ্য সুখের নিরিখ কেবল তার পরিমাণ দিয়েই হবে না। পরিমাণের সঙ্গে গুণের প্রশ্নও বিবেচনা করতে হবে। সুখ কেবল পরিমাণগতভাবে পৃথক নয়। সুখ গুণগতভাবেও পৃথক হতে পারে। অর্থাৎ আমরা কেবল অধিক সুখই যে কামনা করব, তা নয়। আমরা উত্তম সুখেরও বাসনা করব। এবং ‘অধিকতর’ এর চেয়ে ‘উত্তমই’ আমাদের কামনা হবে। তা ছাড়া দৈহিক সুখের চেয়ে মানসিক সুখকে উত্তম বলে মনে করব।
প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র ও জন স্টুয়ার্ট মিল
রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থার উপর শিল্প বিপ্লব ও শিল্পনীতি যে সমস্ত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, মিলের রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়ক রচনায় তার সুস্পষ্ট প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে ব্যাক্তি স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা এবং পাশাপাশি অবাধ প্রতিযোগীতার পরিবেশকে বজায় রাখা তৎকালীন সময়ে সম্ভব হচ্ছিল না। সাধারণ মানুষের জীবনে দারিদ্র দুর্দশা চরম আকার ধারণ করলে অভাবী মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা হয়ে ওঠে চূড়ান্ত সঙ্কটাপন্ন। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে নিরাপদ ও তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা সুরক্ষিত করার লক্ষ, রাষ্ট্রের সেবামূলক ও কল্যাণকর কাজ সম্পাদন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হতে থাকে। তখন থেকেই উদারনীতিবাদিরা ব্যক্তি স্বাধীনতা নির্ভর উদারনীতিবাদের সাথে মানবতার সম্বন্বয় ঘটানোর প্রয়োজন বোধ করেন। এইরূপ পরিস্থিতিতে জন স্টুয়ার্ট মিল ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের পক্ষে মত প্রচার করেন, যা পরবর্তীকালে মিলকে স্বতন্ত্র পরিচিতি দিতে সাহায্য করে।[২]
মূল নিবন্ধ: প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র
প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র সম্পর্কে মিলের ধারণা তার বিখ্যাত গ্রন্থ Considerations On Representative Government গ্রন্থে প্রকাশিত হলেও ১৮৩৮ সালে রচিত Bentham গ্রন্থে সরকার সম্পর্কিত আলোচনায় তিনটি সমস্যার উল্লেখ করেন (ক) জনগণ তাদের কল্যাণে যে সরকারকে মেনে চলবে সেই সরকারে কর্তৃত্বের প্রকৃতি কী হবে? (খ) জনগণকে কর্তৃত্ব মেনে চলার জন্য কীভাবে উদ্বুদ্ধ করা যাবে। (গ) সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। মিলের গণতন্ত্র সম্পর্কের ধারণার ভিত্তি এই প্রশ্নগুলির মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
স্বাধীনতার সমর্থক মিল
স্বাধীনতা বা আজাদী প্রসঙ্গে (ইংরেজি: Liberty) জন স্টুয়ার্ট মিলের ধারণা হচ্ছে কর্তৃত্ব এবং স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্কের সমস্যার সমাধান নির্ধারণ করা। মিলের স্বাধীনতা সংক্রান্ত ভাবনার পরিপূরক হিসাবে স্বাধীনতা সম্পর্কে (ইংরেজি: On Liberty) গ্রন্থের রচনা হয়। তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন, যাকে তিনি উচ্চতর আনন্দকে পূর্বশর্ত হিসাবে বিবেচনা করেন — যেটি উপযোগবাদ তত্ত্বের গণমঙ্গল বা সর্বহিতের দিক।
মূল নিবন্ধ: স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মিলের ধারণা
স্বাধীনতা সম্পর্কে মিলের বক্তব্য গড়ে উঠেছে পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক তাত্ত্বিকদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষত ফরাসী বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সের ঘটনাবলী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা ও ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রকৃতি পর্যালোচনার মাধ্যমে। মিলের মতে ব্যক্তি যেহেতু সমাজ বিচ্ছিন্ন জীব নয় সেই কারণে সমাজ নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা গড়ে উঠতে পারে না। গণতন্ত্রকেও তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবজ বলে মনে করেননি। গণতন্ত্রের নামে যে গণসমাজ গড়ে উঠে তা যদি রাজনীতি সচেতন না হয়ে অজ্ঞ, দরিদ্র, মাদকাসক্ত হয় তাহলে সংখ্যা গরিষ্ঠের শাসন ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খর্ব করে।
উপসংহার
ষোড়শ শতক থেকে উনবিংশ শতক পর্যন্ত ইউরোপে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা গড়ে উঠার বিকাশ ও সংকটকে কেন্দ্র করে সমাজ কাঠামো, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সংস্কৃতিও চিন্তাভাবনার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। উদারনীতিবাদ বিকাশের পর্বে উনবিংশ শতকে শিল্প বিপ্লব, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ইউরোপে উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে।
উৎপাদনের এই বিকাশ একদিকে যেমন পুঁজিপতি শ্রেণীর সৃষ্টি করে অন্যদিকে জনগোষ্ঠীর এক বৃহত্তর অংশকে শিল্পশ্রমিকে পরিণত করে। এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে মিল কোনো একটি ধারাকে মেনে নিতে পারেননি। পরিবর্তে মিলের রাষ্ট্রচিন্তা যেসব বিভিন্ন ধারা অবলম্বন করেন সেসবের মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত বর্ণবৈষম্য, দারিদ্র, বেকারত্ব, অজ্ঞতা এবং নৈতিক অবক্ষয়ের অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন।[৩]
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ২ জুলাই, ২০১৯, “জন স্টুয়ার্ট মিল উনিশ শতকের ইংল্যান্ডের দার্শনিক, যুক্তিবিদ এবং অর্থনীতিবিদ”, রোদুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/john-stuart-mill/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; পঞ্চম সংস্করণ জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৮৬-২৮৭
৩. গোবিন্দ নস্কর, Political thought, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ২৭-২৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।