ইবনে রুশদ বা আবু রুশদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা বা রাষ্ট্রচিন্তায় ইবনে রুশদের অবদান (ইংরেজি: Political thoughts of Ibn Rushd) হচ্ছে রাষ্ট্র ও দর্শনের গ্রিক কাঠামোর উপর ইসলামি প্রত্যাদেশের চুড়ান্ত সংশ্লেষণ করেন। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সঙ্গে ইসলামী আদর্শ রাষ্ট্রের সঙ্গতি বিধানের প্রশ্নটি রুশদের চিন্তায় এসেছিল। রাষ্ট্রদর্শনে তিনি ‘কনসেপ্ট অফ প্রফেসী’ বা প্রত্যাদিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী তত্ত্বকে বিবেচনায় আনেন।
ইবনে রুশদের মতে ভবিষ্যদ্বক্তা বা নবী-রাসুলদের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কে জানতে পারে। কাজেই রিসালতই শরীয়া আইনের বাহক। নবী-রাসুলগণের নেতা, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং শেষ আসমানী গ্রন্থ আল কুরআনের বাহক হওয়ায় এবং তার মাধ্যমে দ্বীন ইসলামকে পূর্ণতা দেয়ায় ও আল্লাহ মনোনীত একমাত্র জীবন বিধান হিসাবে ঘোষণা দেওয়ায় হযরত মুহাম্মদ আনীত বিধান সর্বশ্রেষ্ঠ ও একমাত্র গ্রহণযোগ্য শরীয়া বিধান। এর ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্রই কেবল আদর্শ রাষ্ট্রের চূড়ান্ত মডেল হতে পারে। ইবনে রুশদের চূড়ান্ত মত থেকে এটা একেবারেই স্বচ্ছ যে, গ্রীক দর্শনের মানবিক সসীমতায় গিয়ে ঢুকলেও তিনি আল ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো মুহাম্মদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র এবং খুলাফা-ই-রাশিদীন কর্তৃক অনুসৃত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই প্রকৃত আদর্শ রাষ্ট্ররূপে স্বীকার করে নিয়েছেন।
প্লেটোর “রিপাবলিক” হচ্ছে গ্রীক দর্শন চিন্তার কাল্পনিক আদর্শ রাষ্ট্রীয় সংগঠনের ছবি। আর হযরত মুহম্মদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং খুলাফা-ই-রাশিদীন কর্তৃক অনুসৃত শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র কাঠামো ইসলামী সভ্যতার আদর্শ রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক সংগঠনের প্রকৃষ্টতম বাস্তব নমুনা। রুশদও একথা বুঝতেন যে, প্লেটোর পলিটিয়া বা আদর্শ রাষ্ট্র এবং ইসলামের শরীয়াভিত্তিক আদর্শ রাষ্ট্র মোটেও এক নয়। একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত প্রত্যাদেশ নির্ভর শরীয়ার বিধানের উপর ‘খিলাফত’ বা ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি। বিপরীতে প্লেটোর “রিপাবলিক” “নোমোস” বা মানবীয় বিধানের উপর নির্ভরশীল। রুশদ বুঝেছিলেন যে, মানবীয় বিধান প্রত্যাদেশের স্থানে পৌঁছাতে পারবে না কখনো। প্রত্যাদেশ মর্যাদার দিক থেকে উর্ধ্বে। তিনি এরিস্টটলের “নিকোমেকিয়ান এথিকস” গ্রন্থের যে ভাষ্য রচনা করেন, সেখানে এই চিন্তার বিস্তার দেখা যায়।
ইবনে রুশদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিষয়টির মূল্যায়ন
মধ্যযুগের খ্রিস্টিয় চার্চের অচলায়তন, গীর্জা ও চার্চের দ্বন্দ্বের সীমাহীন বিভ্রান্তি ও বিড়ম্বনার মধ্যে মুসলিম চিন্তাবিদ আল কিন্দী, আল ফারাবি, ইবনে সিনা, ইবনে বাজ্জা – এসব পূর্বসুরীর অনুসরণ করে ইবনে রুশদ গ্রীক দর্শনকে বিস্মৃতির অতল থেকে তুলে এনেছেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সংরক্ষণ করেছেন। না হলে গ্রীক দর্শন হারিয়ে যেতো চিরকালের মতো।
ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও রিফর্মেশনের ভিত্তিই দাঁড়াতো না। আধুনিক ইউরোপ তথা পাশ্চাত্য জগত অন্যান্য মুসলিম চিন্তাবিদদের পাশাপাশি ইবনে রুশদের কাছেও ঋণী। কিন্তু এই ঋণ স্বীকার করলেও আধুনিক পাশ্চাত্য রুশদের দর্শন চিন্তার ভ্রান্ত ও বিকৃত ব্যাখ্যা করে এটাকে “এভেরুজবাদ” আখ্যা দিয়ে সিকিউলার বা ধর্মনিরপেক্ষ বলে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে। অথচ ইবন রুশদের ব্যাখ্যায় ইসলামী শরীয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রই আদর্শ রাষ্ট্রের মডেল এবং এমনকি তাঁর নিজের পৃষ্ঠপোষক আল মনসুরের রাষ্ট্রকেও তিনি ‘স্টেট ইন এরার’ বা আদর্শবিচ্যুত রাষ্ট্র বলে ঘোষণা দিতে বাদ রাখেন নি।
রুশদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিষয়ক সারকথা
ইবনে রুশদ মনে করেন যে, প্লেটোর “রিপাবলিক” হচ্ছে গ্রীক দর্শন চিন্তার কাল্পনিক আদর্শ রাষ্ট্রীয় সংগঠনের ছবি। আর মুহম্মদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং খুলাফা-ই-রাশিদীন কর্তৃক অনুসৃত শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র কাঠামো ইসলামী সভ্যতার আদর্শ রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক সংগঠনের প্রকৃষ্টতম নমুনা। রুশদ একথাও বুঝতেন যে, প্লেটোর পলিটিয়া বা আদর্শ রাষ্ট্র এবং ইসলামের শরীয়াভিত্তিক আদর্শ রাষ্ট্র মোটেও এক নয়। একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত প্রত্যাদেশ-নির্ভর শরীয়ার বিধানের উপর ‘খিলাফত’ বা ‘ইসলামি রাষ্ট্রে’র ভিত্তি। বিপরীতে প্লেটোর “রিপাবলিক” ‘নোমোস’ বা মানবীয় বিধানের উপর নির্ভরশীল।
তথ্যসূত্র
১. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, মো আব্দুর রশীদ, এ এমদাদুল হক ও অন্যান্য; রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় খণ্ড, রাষ্ট্রচিন্তা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ত্রয়োদশ প্রকাশ, ২০২০, পৃষ্ঠা ৯২-৯৩।
রচনাকাল ১৮ মার্চ, ২০২১, এসজিআর।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।