ভাসানীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা হচ্ছে সমাজতন্ত্র, স্বাধীকার, গণতন্ত্র ও রবুবিয়াত

মওলানা ভাসানী বা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা (ইংরেজি: Political Thoughts of Maulana Bhasani) হচ্ছে সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাধীকার, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম, গণতন্ত্র, রবুবিয়াত ও বিশ্বশান্তি। তাঁর এসব রাজনৈতিক চিন্তাধারা তাঁর বক্তৃতা, রচিত পুস্তিকা ও গ্রন্থে বিবৃত রয়েছে।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে মওলানা মনিরুজ্জামান, মওলানা আকরাম খাঁ প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শে আসেন এবং মুসলিম লীগের আঞ্চলিক সভাপতি হন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আসাম আঞ্জুমানে ওলামার সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ভারতের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মহান রাজনীতিবিদ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের জাতীয়তাবাদী দলে কর্মী হিসেবে কাজ করেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ বিরোধী খেলাফত আন্দেলন শুরু হলে ভাসানী খেলাফত আন্দোলনের সূত্রে মওলানা শওকত আলী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা আজমল খাঁ প্রমুখ বরেণ্য নেতার সান্নিধ্যে আসেন এবং খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন।[১] এসব ঘটনায় ও আন্দোলনে অংশগ্রহণ তাঁকে একজন জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মুসলিম ব্যক্তিত্ব হিসেবে সারা জীবন প্রভাবিত করে।

ভাসানীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা ব্যক্ত হয়েছে তাঁর জ্ঞানার্জন সম্পর্কিত আকাঙ্ক্ষায়। আবদুল হামিদ খান জ্ঞান অন্বেষণ এবং মজলুমের সেবার জন্য উত্তর ও উত্তর পূর্ব দেশসমূহের বিভিন্ন স্থানে বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি আসামের দরিদ্র মানুষের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং জমিদার মহাজন ও জোতদারদের অত্যাচার ও শোষণের কবল থেকে দরিদ্র কৃষকদের মুক্তির জন্য কাজ করেন। ১৯২৪ সালে আসামের ধুবড়ি জেলার ভাসানচরে তিনি বাঙালি কৃষকদের এক বিশাল সম্মেলন করেন এবং সেই সম্মেলনের সাফল্য থেকে জনগণ তাঁকে ‘ভাসানীর মওলানা’ হিসেবে ডাকতে শুরু করেন।[২]

মওলানা ভাসানী ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তিনি রাজনৈতিক জীবনের বেশীরভাগ সময় সাম্যবাদী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর অনুসারীদের অনেকে এজন্য তাঁকে ‘লাল মওলানা’ নামেও ডাকতেন। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং পঞ্চাশের দশকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো।

১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ‘ওয়ালাকুমুস সালাম’ বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন।[৩] নিপীড়িত জাতি ও জনগণের মুক্তির জন্য তিনি সারা জীবন কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করেন। এজন্য স্বাধীনতাবিরোধী দৈনিক ইত্তেফাক ভাঙায় কোন বাহাদুরী নাই শিরোনামের এক উপসম্পাদকীয়তে মওলানার পাকিস্তান ভাঙার চেষ্টার তীব্র সমালোচনা করে। ইত্তেফাক লেখে “পাকিস্তানকে ভাঙিয়া টুকরা করার জন্য এই জীবন-সায়াহ্নেও মওলানা সাহেবের চেষ্টার কোনই ত্রুটি নাই।”[৪]

সাম্রাজ্যবাদবিরোধি জাতীয়তাবাদী কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির এই মহান নেতা ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক ও শিক্ষক। তিনি শিখিয়েছেন, চরম দুঃসময়েও মেরুদণ্ড সোজা রেখে নিপীড়কদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাতে হয়। তিনি অহিংসাকে মানবের মুক্তির পথ হিসেবে চক্রান্তকারী পিশাচ মোহনদাস গান্ধীর মতো গ্রহণ করেননি। তিনি সর্বহারা জনতার জন্য প্রবন্ধে বলেছেন,

“অহিংসার বাণী ও অহিংস কৌশল মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে ভোঁতা করে মাত্র— দেশের শতকরা পচানব্বই জন মানুষের চিরস্থায়ী কোনো কল্যাণ সাধন করতে পারে না।”[৫]

তিনি জানতেন জনগণের সাথে প্রতারণা করার জন্য অহিংসার বুলি খুবই কার্যকর। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ভণ্ড গান্ধীর সাথে এইখানেই মওলানার পার্থক্য। গান্ধী যেখানে সারাটা জীবন জমিদার আর পুঁজিপতিদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে, সেখানে ভাসানী জমিদার ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই চালিয়ে গেছেন। তিনি শুধু আগুনকে কাছ থেকে দেখেননি, জনগণের মাঝে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারতেন দ্রুত সময়ের মধ্যে।  

ভাসানী নির্বাচনকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। নির্বাচনকেও তিনি প্রতারণার মাধ্যমই মনে করতেন। তিনি ভোটের আগে ভাত চাই প্রবন্ধে লিখেছেন

“নির্বাচনের নামে দেশময় তোলপাড় করিয়া তুফান তুলিয়া যাহারা উপরের তলায় আরোহণ করে; তাহাদের নির্বাচন, চাতুরি ও অপকৌশল জনজীবনকে দুর্বিষহ করিয়া তোলে”। [৬]

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বাঙলার দুরবস্থা দেখে এবং এজন্য সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকার বিরুদ্ধে সমাধানের পথ বাতলাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন,

“আমাদের দুয়ারে আজও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অভিশাপ বর্তমান। আজও নীলকর সাহেবদের দৌরাত্ম্য বিরাজমান। আজ তাই দরকার তিতুমীরের বিদ্রোহ, শরীয়তুল্লাহর সংস্কার আর ক্ষুদিরামের ত্যাগ”।

এই পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা ভাসানীকে এককথায় বা দুকথায় বা দুটি-চারটি বই লিখে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তিনি এক জীবনে একের পর এক করেছেন জমিদার জোতদার মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, আসামে লাইনপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম, পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামি লিগ ও ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টির প্রতিষ্ঠা, কৃষক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠন গড়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনে, লড়াই করেছেন সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, নয়া-সাম্রাজ্যবাদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে, করেছেন পাকিস্তানি আধিপত্যবাদি অবস্থা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, করেছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, বিশ্বশান্তির জন্য করেছেন যথাসাধ্য চেষ্টা, রেখেছেন শিক্ষাবিস্তারে ভূমিকা, করেছেন আধিপত্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, যুগপৎ করেছেন ধর্মান্ধতা ও ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন।

পিকিং-এর হাস পাতালের এক নার্স তাকে বলেছিলেন “মওলানা, তুমি এশিয়ার সকল মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। আমরা তোমাকে দেখতে পাওয়াকে পুণ্য মনে করি”। এই মহান নেতার প্রতি মাও সেতুং সবসময় শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। তাঁকে নিয়ে শামসুর রাহমানের লেখা সফেদ পাঞ্জাবি নামে এক বিখ্যাত কবিতা রয়েছে।

মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিষয়ক সীমাবদ্ধতার ভেতরে প্রধান সীমাবদ্ধতাটি হলো তিনি বিপ্লবী ছিলেন না। তাঁকে নিতান্ত অনিচ্ছায় হলেও মার্কসবাদের অনুসারীদের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। বাস্তব রাজনৈতিক প্রয়োজনে কমিউনিস্ট পার্টিসহ নানা বিপ্লবী দলের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে বটে, কখনো প্রাণের ভেতর থেকে ঐ বিপ্লবী মতবাদ গ্রহণ করতে পারেননি। ‘রাজনৈতিক দোলাচল বৃত্তির মধ্যে মওলানার সারাজীবন কেটেছে। ইসলামকে তিনি বিশ্বাস করতেন কিন্তু মার্কসবাদকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করতেন। এ দু’য়ের মধ্যে একটা সার্থক মেলবন্ধন তিনি ঘটাতে পারেননি। তাঁর সেই মনীষা এবং প্রজ্ঞা ছিলো না। আর মানুষ হিসেবেও তিনি আধুনিক ছিলেন না। দেশ সমাজ রাষ্ট্র সম্পর্কিত সুগঠিত কোনো রাজনৈতিক চিন্তা তাঁর ছিলো না’[৭]।

তথ্যসূত্র ও টিকা:

১. অধ্যাপক একেএম শহীদুল্লাহ ও এম রফিকুল ইসলাম, প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা, গ্রন্থকুটির ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৮/১৯, পৃষ্ঠা ২৬৪-২৬৫।
২. অধ্যাপক একেএম শহীদুল্লাহ ও এম রফিকুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬৮।
৩. মোহাম্মদ হোসেন সংকলিত ‘ভাসানীর বাণী’ ১৯৭৫, সন্তোষ, পৃষ্ঠা-৬।
৪. উপসম্পাদকীয়, দৈনিক ইত্তেফাক, বুধবার, ২০শে মাঘ, ১৩৭৭ (৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১)
৫. সৈয়দ আবুল মকসুদ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী; বাংলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ, মে ১৯৯৪ ঢাকা পৃষ্ঠা-৬২১।
৬. সৈয়দ আবুল মকসুদ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৬২১
৭. আহমদ ছফা, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা, মার্চ, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৪১-৪২

রচনাকাল: ১৬ নভেম্বর, ২০১২, চৌরঙ্গী মোড়, আকুয়া ময়মনসিংহ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!