অরবিন্দ ঘোষ বা শ্রী অরবিন্দ ঘোষ বা ঋষি অরবিন্দ (ইংরেজি: Sri Aurobindo ১৫ আগস্ট, ১৮৭২ – ৫ ডিসেম্বর, ১৯৫০) ঘোষের রাষ্ট্রচিন্তা হচ্ছে সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, স্বরাজ, স্বাধীনতা, ঐক্য ও নিস্ক্রিয় প্রতিরোধ। তিনি ছিলেন ভাববাদী চিন্তাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, কবি, শিল্পশাস্ত্রী এবং এককালের রাজনৈতিক নেতা ও সিদ্ধযোগী একজন গুরু।[১]
অরবিন্দ ঘোষ ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন কিছু সময়ের জন্য এবং এই আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি আধ্যাত্মিক সংস্কারক হয়ে মানব প্রগতি এবং আধ্যাত্মিক বিবর্তন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রবর্তন করেছিলেন।
তিনি বৈদান্তিক ভাবধারার সঙ্গে পাশ্চাত্যের আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রদর্শনের সংমিশ্রণে এক নতুন দিকের সুচনা করেছেন। ইংল্যান্ডে ছাত্রজীবনে তিনি গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হন। দেশে ফিরে বরোদায় অধ্যাপনার সঙ্গে বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার প্রচার থেকে ক্রমে প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরপর কলকাতায় এসে অধ্যাপনা, ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকা সম্পাদনা এবং গোপনে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রয়াসী হন।[২]
অরবিন্দ ঘোষের দর্শনচিন্তা
অরবিন্দ বেদান্ত দর্শনের নতুন ব্যাখ্যাদানের চেষ্টা করেন। তাঁর ব্যাখ্যাকে সমন্বিত বেদান্ত দর্শন বলা হয়। তাঁর এই ব্যাখ্যার প্রাচীন ভারতের বেদান্ত দর্শন এবং ইউরোপীয় আধুনিক দর্শন, বিশেষ করে হেগেল, ব্রাডলে, আলেকজাণ্ডার প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকদের ভাবসমূহের মিশ্রণ দেখা যায়। অরবিন্দ মানুষের ইতিহাসকে চেতনার স্তর-ক্রমিক বিকাশ বলে বর্ণনা করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে অর্ধ-চেতন, এবং অতি-চেতন মানুষের চেতনা এইরূপ বিভিন্ন পর্যায়ের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করেছে।[৩]
দর্শনচিন্তায় শ্রী অরবিন্দের প্রধান অবদান হলো তাঁর অতিমানস (Supermind) তত্ত্ব। সচ্চিদানন্দের সঠিক জ্ঞান ও পূর্ণশক্তির উপলব্ধিকেই অতিমানস বলা চলে; যোগসাধনার মাধ্যমে সেই উপলব্ধির সাহায্যে জগৎ ও জীবনের ঈপ্সিত পরিবর্তন সাধিত হয়। তাঁর ‘দিবা জীবন’ প্রত্যয়ের তাৎপর্য হলো হলো মানবমনের স্বভাবগত অহংবোধ ও ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে অর্থাৎ মানসস্তর থেকে অতিমানস স্তরে উঠে চরম সত্য ব্রহ্মকে জানা। সেজন্য ধর্মীয় অনুশাসন ও আচার অনুষ্ঠান নিষ্প্রয়োজন।
তিনি অধ্যাত্মভাবে পরিমণ্ডিত এমন এক আদর্শ সমাজের কথা ভেবেছেন যা সকলের জীবনকেই করে তুলবে সুন্দর ও সমৃদ্ধ। আধ্যাত্মিক প্রেরণাই হবে তার সঞ্চালক। সেই সঙ্গে তিনি চেয়েছেন বিশ্বের রূপান্তরের জন্য সর্বজ্ঞ ও বিশ্বচেতনাসম্পন্ন দিব্য অতিমানসের অবতরণ। মানুষকে সেজন্য মন অতিক্রম করে অতিমানস অভিমুখে বিবর্তিত হতে হবে। তখন অতিমানসিক গুণসমন্বিত একটি জাত বা গোষ্ঠী গড়ে উঠবে। তাঁর মতে অন্তর্মুখী সমচেতনার বিকাশের মাধ্যমে যাবতীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে সম্প্রীতি, সমন্বয় ও এক্য অর্জন করা যায়।[৪]
অরবিন্দ ঘোষের রাষ্ট্রচিন্তা
সাম্যবাদ
অরবিন্দ ঘোষের রাষ্ট্রচিন্তা প্রভাবিত হয়েছে সাম্যবাদ ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার মাধ্যমে। তার যুক্তি ছিল এমন যে, প্রকৃতিগতভাবে মানুষ চায় চিন্তার স্বাধীনতা, নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী জীবনের বিকাশ ও সৃজনকর্মের অবকাশ। কিন্তু রাষ্ট্র তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সৃজনশীল মানুষের অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দানা বাঁধে নৈরাজ্যবাদ ভিত্তিক চিন্তায়। তাঁর মতে মানবিক বিকাশের পরিপন্থী প্রচলিত ব্যবস্থায় ব্যক্তিমানুষের সত্তা যখন অবদমিত হয়, তখন তার সামাজিক চাপ ও চাহিদা নৈরাজ্যবাদে বিকল্প পথের সন্ধান করে। নৈরাজ্যবাদের হিংসাত্মক দিকটিকে বাদ দিয়ে তিনি তার মানব অধিকারের আদর্শকে প্রাধান্য দেন। নৈরাজ্যবাদকে তিনি নতুন এক নামে ‘কো-অপারেটিভ কমিউনিজম’ বলে চিহ্নিত করেন। তাতে সমবায়ী সম্পর্কের ভিত্তিতে সকলের শ্রম ও সম্পদ সাধারণভাবে সারা সমাজের বলে গণ্য হবে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন হবে না।
তিনি অনুভব করেন যে মানবসমাজের যথার্থ বিকাশ ও অগ্রগতির জন্য মানবপ্রকৃতির পরিবর্তন হওয়া কাম্য, পরিবর্তনটা তাঁর দৃষ্টিতে স্পষ্টতই আধ্যাত্মিক। তিনি চাইতেন বস্তুগত বিষয় থেকে আত্মিক স্তরে উত্তরণ। অধ্যাত্মবাদে মণ্ডিত সমাজ সর্বস্তরের মানুষকে যান্ত্রিক প্রশাসনে তাড়না বা পীড়ন না করে ছােটবড় সকলের অন্তরাত্মাকে উত্তোলন করবে, অতিমানসের স্তরে মানুষের উত্তরণ হলে আধ্যাত্মিক বিবর্তনধারায় গড়ে উঠবে এক নতুন মানব সমাজ, তাতে আর্থ-সামাজিক অসাম্য দূরীভূত হবে। তার দার্শনিক বুনিয়াদকে তিনি আধ্যাত্মিক কমিউনিজম নামে অভিহিত করেন।[৪]
সামাজিক বিকাশে পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র কোনোটাকে শ্রেয় মনে করতে না পেরে অরবিন্দ বিকাশের এক তৃতীয় পথের কল্পনা করেন। অরবিন্দের দর্শন প্রধানত ভাববাদী। দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের সময়ে তিনি ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণের পক্ষপাতী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধপ্রচেষ্টার সমর্থক ছিলেন।
স্বরাজ ও স্বাধীনতা
স্বদেশী আন্দোলনের সময় কালে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চলেছে প্রচন্ড আলোড়ন। অরবিন্দ বোম্বাইয়ের ইন্দুপ্রকাশ পত্রিকায় এ বিষয়ে কয়েকটি সুচিন্তিত প্রবন্ধ লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কংগ্রেসের আবেদন নিবেদনের রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ছিল এই প্রবন্ধগুলির প্রতিপাদ্য।
সেই সময় কার্জন-ফুলারের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার চলেছে বাংলায়। ইংরাজ রাজশক্তির রক্তমাখা রাজনীতিতে নির্যাতিত ও পর্যুদস্ত হচ্ছেন বাংলার জনগণ।
তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় কলকাতায় আসার পরে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে। প্রকাশ করেন বন্দে মাতরম পত্রিকা।
এরপরেই অরবিন্দ প্রকাশ করেন বন্দে মাতরম পত্রিকা। সেই সময় তার অগ্নিবর্ষী লেখাগুলো ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের নব দিশারী। কিছুদিনের মধ্যেই বন্দেমাতরম পত্রিকায় যোগ দিলেন শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, বিপিনচন্দ্র পাল ও হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ প্রমুখ। এভাবেই অরবিন্দর যোগাযোগ ঘটল ভারতের বিপ্লববাদীদের সঙ্গে। অরবিন্দ দেশাত্মবোধের জাগরণে ভগবদসত্তার প্রেরণা অনুভব করতেন। তাই মুরারীপুকুরের গুপ্ত সমিতিতে প্রত্যহ গীতাপাঠ ও চন্ডীপাঠ হতো। পরবর্তীকালে গীতা বুকে নিয়ে শহীদরা হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে উঠেছেন।
মেদিনীপুর কংগ্রেস অধিবেশনে ও সুরাট কংগ্রেসে নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের বিসম্বাদে অরবিন্দ ব্যথিত হন। বালগঙ্গাধর তিলকের ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে মান্দালয় জেলে কারাবাস ও চাপেকরের আত্মত্যাগ তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল।
পাঞ্জাবও জেগে উঠেছে সেই সময়। সর্দার অজিত সিংহের পাশে তার দুই ভাই কিষেণ সিং ও সরণ সিং, অন্যদিকে লালা, পিত্তিদাস, সুফী অম্বা প্রসাদ, লালা বাঁকে দয়াল ও ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ। সর্দার অজিত সিং ও অস্থাপ্রসাদ গেলেন ইরানে মুক্তি সংগ্রামের ব্রত নিয়ে। ইংরাজ রাজশক্তি ভারতের এই নবজাগরণকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য চরম দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করল।
অরবিন্দর মাতামহ মনীষী রাজনারায়ণ বসু ঠাকুর বাড়িতে যুবকদের সংগঠিত করে গঠন করেছিলেন গুপ্ত সমিতি। ঋকবেদের পুঁথি, মড়ার মাথার খুলি ও মুক্ত তলোয়ার সাক্ষী রেখে ভারত উদ্ধারের শপথ নিতেন তারা।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সিস্টার নিবেদিতা গোপনে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। দেওঘরের উপকণ্ঠে রোহিনী পাহাড়ে বিপ্লবী যুবকগণ বোমা তৈরি করে কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে গিয়ে সহকর্মী প্রফুল্ল চক্রবর্তীকে হারালেন। তিনিই বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম শহীদ। অরবিন্দ তাঁরর বন্দেমাতরম পত্রিকায় লিখলেন “The bureaucracy has thrown the gauntlet, we take it up.”
ইতিমধ্যে প্রফুল্ল চাকী ও যতীন বসু দার্জিলিঙে ঘুরে এলেন। তারপর প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম গেলেন মজঃফরপুর—কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে। শহীদ হন প্রফুল্ল, ধরা পড়ে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ে আত্মবলিদান করলেন ক্ষুদিরাম।[৫]
১৯০৮ সালের ৫ মে তিনি বৈপ্লবিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার এবং বে-আইনিভাবে বোমা তৈরির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। ফলে বছরকাল কারারুদ্ধ থাকেন। অরবিন্দ এবং অন্যান্য গোপন বিপ্লবীর বিরুদ্ধে, ‘আলীপুর বোমার মামলা’ বলে বিখ্যাত মামলা দায়ের করা হয়। বোমার মামলা থেকে মুক্ত হয়ে অরবিন্দ রাজনীতি পরিত্যাগ করে ধর্ম-সাধনায় মনোনিবেশ করেন এবং পণ্ডিচেরিতে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে যোগসাধনা এবং দার্শনিক সৃজন কর্মে জীবন অতিবাহিত করেন।
অরবিন্দ ঘোষের বিপ্লববাদ
সুরাট কংগ্রেস অধিবেশনে যখন লোকমান তিলক ও অরবিন্দের নেতৃত্বের জন্য সকলে আকুল তখন অনুনয়-বিনয়ের নরম-পন্থী গোষ্ঠী সেই সভা ভণ্ডুল করে দিয়েছিলেন। অরবিন্দ বললেন, “আমাদের এই জাতীয়তার আন্দোলন …. এ হচ্ছে একটি ধর্ম, যাকে আশ্রয় করে আমরা বাঁচতে চেষ্টা করব। এ একটা ধৃতি, যার সাহায্যে আমরা জাতির মধ্যে দেশবাসীর মধ্যে ভগবানকে প্রত্যক্ষ করতে চাই”। মুক্তিযজ্ঞের ঋত্বিক দেশকে দিলেন নতুন পথ।
রানাডেকে অরবিন্দ লিখেছিলেন, “যে যোগাবস্থা প্রার্থী তাহার পক্ষে জনতা নির্জন সমান হওয়া উচিত। শ্রদ্ধা ও আত্মসমর্পণই সিদ্ধিলাভের পন্থা— প্রাণপণে ভগবানকে ডাকিলাম—সমস্ত অন্তঃকরণে শান্তি আসিল।” অরবিন্দের ভাবান্তর দেখে জেলের ডাক্তার ডাঃ ভেলি সকালে ও বিকালে তার বেড়াবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
অরবিন্দ জেল থেকে মুক্ত হয়ে দেখলেন চিদাম্বরম পিলে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে সাত বছরের জন্য কারারুদ্ধ, কৃষকুমার মিত্র, অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রভৃতি নয় জন নেতা নির্বাসনে। লোকমান্য তিলক মান্দালয়ের কারাগারে, বিপিনচন্দ্র পাল ইংলন্ডের প্রবাসী। কিন্তু কংগ্রেসের মধ্যপন্থীরা স্যার রাসবিহারী ঘোষকে সভাপতি করে ইংরাজদের করুণা লাভের প্রত্যাশায় দিন গুণছেন।
অরবিন্দ ইংরাজিতে কর্মযোগীন ও বাংলায় ধর্ম নামে পত্রিকা প্রকাশ করলেন। তিনি ধর্ম পত্রিকায় লিখলেন, “যাহারা দেশের জন্য সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত, যাহারা ভয়ের পরিচয় রাখেন না, ভগবান ও বঙ্গ জননী ভিন্ন কাহাকেও জানেন না ও মানেন না, তাহারা অগ্রসর না হইলে বঙ্গের ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হইবে।” কিন্তু ফল কিছুই হলো না। মধ্যপন্থীগণের এমনই অবস্থা যে তারা সভা সমিতি পর্যন্ত সাহস করে করতে পারেন না।
৩০ শে আশ্বিন রাখীবন্ধন উৎসবে নেতারা জাতীয় ঘোষণাপত্র পাঠ ও বিদেশী বস্ত্র বর্জন করলেন। এদিকে ব্রিটিশ রাজশক্তি দমননীতি এমনই দৃঢ় করল যে দেশবাসীর মনোবল ভেঙ্গে পড়বার মত অবস্থা। দেশের এই অবস্থা দেখে অরবিন্দ ধর্ম পত্রিকায় লিখলেন,
“নিজের মধ্যে আত্মার বিশাল নীরবতায় ভগবান ও জীবের সংযোগ যে গভীর, অবিচলিত, অভ্রান্ত, শুদ্ধ, সুখ-দুঃখ জয়ী, পাপ-পুণ্যবর্জিত শক্তি সম্ভূত হয়, সেই মহাসৃষ্টিকারিণী, মহাপ্রলয়কারী, মহাস্থিতিশালিনী, জ্ঞানদায়িনী মহাসরস্বতী, ঐশ্বর্যদায়িনী, মহালক্ষ্মী শক্তিদায়িনী মহাকালী, সেই তেজের সংযোজনে একীভূতা চন্ডী প্রকটিত হইয়া ভারতের কল্যাণে ও জগতের কল্যাণে কৃতোদ্যম হইবেন।”
অরবিন্দ ঘোষের রাষ্ট্রচিন্তা বিবর্তিত হয়েছে মানবমুক্তির প্রেরণায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিকারের জন্য বিপ্লববাদের অভিমুখে। যে ব্রত নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল সেই ব্রত নিয়েই অরবিন্দ বাণীর কমল বন থেকে কঙ্করময়-রক্তঝরা বিপ্লবের পথে নেমেছিলেন। ভারতের তারুণ্য শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে মহামন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। অরবিন্দ তার দিব্য জীবন গ্রন্থে লিখেছেন
“একটি অখন্ড সোমধারা শুধু ব্যক্তি জীবন নহে, সমগ্র বিশ্ব-জীবনের মধ্যে নিরন্তর প্রবাহিত হইতেছে। সেই ধারা হইল দিব্য জ্যোতি ও দিব্য আনন্দধারা। সেই দিব্য জ্যোতিঃ ও দিব্য আনন্দকে লালন করিতে হইবে এবং তাহাকে ব্যবহার করিতে হইবে। এই দিব্য আনন্দই সকল অস্তিত্বের মূল আনন্দ—আনন্দময় পরমপুরুষ।”
ভারত-জননী ছিল অরবিন্দের চিন্ময়ী সত্তা। তাই তিনি বলেছেন, “Mother India is not piece of earth, she is power, a Godhead, for all nations have such a Devi supporting their separate existence and keeping it in being.”
তিনি মহাশক্তি লাভের জন প্রার্থনা করেছেন, “Mother Durga! Giver of force and love and knowledge ….. in the battle of life in India’s battle, we are warriors commisssioned by thee.”
ইতিমধ্যে বিপ্লবীরা বিচারক শামসুল আলমকে হত্যা করলেন। এই হত্যার মামলায় ইংরাজ সরকার অরবিন্দকে জড়িত করবার মতলব করল। বিশ্বস্ত সূত্রে এই সংবাদ জানতে পেরে অরবিন্দ নিবেদিতাকে জানালেন। তারপর বাগবাজার বোসপাড়া লেনের বাড়িতে ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে আলোচনা করে তিনি চন্দননগরে মতিলাল রায়ের বাড়িতে চলে যান। চন্দননগর হলো ফরাসী সরকারের শাসনাধীন। ইংরাজ সরকারের নাগালের বাইরে।
তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁর রোপিত বীজ শুধু অঙ্কুরিতই নয়, ভাবীকালে মহীরুহ হয়ে উঠবার সম্ভাবনায় উজ্জ্বল। পরবর্তীকালের বিপ্লববাদ ব্রিটিশ রাজশক্তির মূলে যে চরম আঘাত করেছিল তাই তার প্রমাণ।
অরবিন্দ ঘোষের রাষ্ট্রচিন্তা মূল্যায়ন
অরবিন্দ তাঁর তত্ত্ব সম্পর্কে বলেছেন, “মানুষ যদি নিছক প্রাণধর্ম ও মননধর্মকে আশ্রয় করে থাকে, তাহলে মানব-সমাজে দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ দূর হবে না। চাই নীতির আদর্শ–ধর্মের আদর্শ …… সমষ্টিগত ভাবে যদি আমাদের লক্ষ্য হয় ভাগবত উপলব্ধি; তাহলে মানব জাতির বিবর্তন অসম্ভব। তখনই মানুষে মানুষে ভেদজ্ঞান লুপ্ত হবে, উপলব্ধি করব একই হয়েছেন বহু’, ‘বহু’ রয়েছেন একে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে মে ইউরোপে ভ্রমণে যাচ্ছিলেন। যাবার পথে পন্ডিচেরীতে নেমে পুরাতন বন্ধু অরবিন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁদের তখনকার কথোপকথন ১৩৩৫ সনের শ্রাবণ সংখ্যার প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
“শ্রী অরবিন্দ আত্মাকেই সব চেয়ে সত্য করে চেয়েছেন। সত্য করে পেয়েছেন। সেই তাঁর দীর্ঘ তপস্যার চাওয়া ও পাওয়ার দ্বারা তার সন্তা ওতপ্রোত। ইনি এঁর অন্তরের আলো দিয়েই বাইরের আলো জ্বালাবেন। … অরবিন্দকে তাঁর যৌবনের মুখে ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে যে তপস্যার আসনে দেখেছিলুম, সেখানে তাকে জানিয়েছি—অরবিন্দ। রবীন্দ্রের লহ নমস্কার।
আজ তাঁকে দেখলুম তার দ্বিতীয় তপস্যার আসনে অপ্রগলভ স্তব্ধতায়। আজও তাঁকে মনে মনে বলে এলুম— অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লই নমস্কার।”
অরবিন্দ তার বিশ্বাসের কথা জগদ্বাসীকে জানিয়েছেন, ‘পৃথিবীতে অতিমানবের মহাপ্রকাশ হবে। আবার ধর্ম সংস্থাপন হবে, সবার হবে ভাগবত জীবন।’ [৬]
এক কথায় অরবিন্দ ঘোষের রাষ্ট্রচিন্তা আধুনিক পুঁজিবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধীতায় কার্যকর ছিল। একচেটিয়া মালিকানা ও কেন্দ্রীভূত ব্যবসায়ী জোটকে অরবিন্দ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতেন। তিনি ব্যাবসায় বাণিজ্যে সরকারি অনুপ্রবেশকে ইতিবাচক হিসেবে নেননি। তার মতে, সমাজ জীবনকে সুষ্ঠুরূপ দিতে হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা ও নিরাপত্তা থাকা একান্তই প্রয়োজন।[৭]
চিত্রের ইতিহাস: অরবিন্দ ঘোষের আলিপুর জেলে ১৯০৮ সালে পুলিশের তোলা দুটি আলোকচিত্র।
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ২১ অক্টোবর ২০১৮, “অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন ভাববাদী চিন্তাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, কবি ও শিল্পশাস্ত্রী”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/aurobindo-ghose/
২. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ২১-২২।
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৮১।
৪. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত।
৫. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৭৯০-৭৯৭।
৬. যাহেদ করিম, পূর্বোক্ত।
৭. অধ্যাপক একেএম শহীদুল্লাহ ও এম রফিকুল ইসলাম, প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা, গ্রন্থকুটির ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৮/১৯, পৃষ্ঠা ২১২।
রচনাকাল ২১ অক্টোবর ২০১৮, নেত্রকোনা বাংলাদেশ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।