আল ফারাবি বা দার্শনিক আল ফারাবীর রাষ্ট্রচিন্তা (ইংরেজি: Political thoughts of Al Farabi) বা রাষ্ট্রদর্শনে আল ফারাবির অবদান হচ্ছে রাষ্ট্র সম্পর্কে এই দার্শনিকের সামগ্রিক চিন্তাধারা। ফারাবি রাষ্ট্র সম্পর্কে যেসব চিন্তাধারা লালন করতেন তাতে প্লেটো ও অ্যাারিস্টটলের চিন্তাধারার প্রভাব দেখা যায়। প্লেটো যেমন ‘রিপাবলিক’ বা আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, আল ফারাবিও তেমন একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন। আল ফারাবির আদর্শ রাষ্ট্র প্লেটোর রাষ্ট্রের ন্যায় সাধারণ মানুষের অসাধ্য বোধ হতো না। প্রকৃত পক্ষে আল ফারাবি যে সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রকে কার্যকর দেখেছে, তাদের উন্নত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নিজের আদর্শ রাষ্ট্র কল্পনা করেছিলেন।[১]
আল ফারাবি কোনো চরম মত পোষণ করেন নি। চিন্তার ক্ষেত্রে প্রায়ই তিনি পরস্পর-বিরোধী ধারাকে এক সাথে মিলাবার চেষ্টা করেছেন। এই আপসের প্রমাণ যেমন প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলকে ঐক্যবদ্ধ করার মধ্যে রয়েছে, তেমনি বিশ্বের স্রষ্টা এবং সৃষ্টির ব্যাখ্যাতেও রয়েছে। আল ফারাবি একদিকে মনে করেছেন যে, আল্লাহই হচ্ছেন একমাত্র স্রষ্টা; আর সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর প্রকাশ। অপর দিকে আল্লাহকে স্রষ্টা স্বীকার করেও সৃষ্টি বা বিশ্বকে শাশ্বত বলে তিনি অভিমত পোষণ করেছেন। বিশ্বকে শাশ্বত মনে করার মধ্যে বস্তুজগৎ এবং বিজ্ঞানকে স্বীকারের প্রবণতা আল ফারাবীর চরিত্রে দেখা যায়। এদিক থেকে সে-যুগে তিনি প্রগতিশীল চিন্তাবিদের স্বাক্ষর রেখেছেন, একথা বলা যায়।
ধর্মের ন্যায় তাঁর রাষ্ট্র-ব্যবস্থাতেও একনায়কত্বের প্রকাশ ছিল। আল ফারাবীর মতে রাষ্ট্রের রইস বা প্রধান থাকবে সবার উপরে। অপর সকলে তার বাধ্য হবে। সে নিজে কারু বাধ্য হবে না। নাগরিকদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগের ক্ষেত্র স্তরভেদ থাকবে। এক স্তর তার উপরের স্তরের আদেশ মান্য করবে। এবং অধঃস্তরের উপর আদেশ জারি করবে। অধঃতম স্তরের নাগরিক কেবল হুকুম মান্যই করবে অপর কাউকে সে হুকুম দিবে না। কারণ হুকুম দেবার মতো তার নিচে অধঃতর কোনো স্তর থাকবে না।
মুসলিম সভ্যতার অর্থনীতিক বিকাশের তৎকালীন যুগে একনায়কতন্ত্রের এই ধারণা গোত্রতান্ত্রিক বহুধাবিভক্ত সামন্তবাদী সমাজকে এককেন্দ্রিক বৃহত্তর রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যে সংহত করার অনুকূল শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। যুগের প্রেক্ষিতে এরূপ ভাবধারার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। চরম সত্য বা স্রষ্টার ব্যাখ্যায় আল ফারাবী যেমন প্লেটোর ভাবধারাকে গ্রহণ করেছেন, মনোজগতের বিশ্লেষণে তেমনি তিনি এ্যারিস্টটল-এর ব্যাখ্যাকেই অধিকতর স্বীকার করেছেন।[২]
আল ফারাবির রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
আল ফারাবি গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর ‘দি রিপাবলিক’ ও ‘দি লজ’ গ্রন্থের উপর নির্ভর করে রাষ্ট্রতত্ত্ব বিষয়ক চিন্তা ভাবনা শুরু করলেও নিজের ব্যক্তিগত বিচিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে রাষ্ট্রের নতুন ব্যাখ্যা দান করেন। তাঁর আলোচনা অনেক ক্ষেত্রেই প্লেটোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর। আল ফারাবীর মতে, মানুষ তার সুখ, শান্তি, আরাম, আয়েশ ও সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের সমবায় গঠন করে থাকে। গ্রাম-শহর, জনপদ, রাষ্ট্র, জাতি সবই সমবায় ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র এ সমবায় ব্যবস্থারই পূর্ণাঙ্গ রূপ। তিনি এরিস্টটলের সুরে বলেন যে, রাষ্ট্র হচ্ছে সকল সমবায়ের শ্রেষ্ঠতর সংগঠন।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে আল ফারাবির মতবাদে সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতাব্দীর টমাস হবস, জন লক ও রুশোর মত সামাজিক চুক্তিবাদীদের মতবাদের সঙ্গে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দুইই বিদ্যমান। তিনি এ সব চুক্তিবাদীদের কাল্পনিক প্রকৃতির রাজ্যে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিল, কিন্তু এই রাষ্ট্রে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার ছিল না। আদিকালে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্বকলহ ও সংঘাত লেগেই থাকত। দুর্বলেরা মার খেত সবলের হাতে। এই নাজুক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তির শর্তানুযায়ী সিদ্ধান্ত হয় যে, কেউ কারো উপর অত্যাচার ও জুলুম করবে না, এবং বল পূর্বক কারো সম্পদ ছিনিয়ে নিবে না। কেউ চুক্তি ভঙ্গ করলে সকলে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের অধিকার রক্ষা করবে। তার মতে মানুষের যুক্তিবোধের উপর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল ফারাবীর এই মতবাদ অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক চিন্তা ধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।[৩]
আল ফারাবি বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বময় এক রাষ্ট্র গঠনের কথাও কল্পনা করেছেন। তবে তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমবায়ের কথা অস্বীকার করেন নি। তিনি উল্লেখ করেন যে ইতিহাসের বিবর্তন ধারায় সমবায় ব্যবস্থা সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রযোজ্য হবে। কালক্রমে জাতি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে সাম্রাজ্য গঠন করবে। সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ সম্পর্কে আল ফারাবির বক্তব্য খুবই প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী জাতিগুলো ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য্যের লোভে দূর্বল জাতিগুলোর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এ পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এই অনাকাঙ্খিত জটিল সমস্যার মোকাবিলায় তিনি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে জোটবদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চয়ের কথা বলেছেন। তাঁর এই বক্তব্য বর্তমান যুগে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
আদর্শ রাষ্ট্রের শাসক
ফারাবি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্লেটোর ‘দি রিপাবলিক’ গ্রন্থে বর্ণিত আদর্শমন্ডিত দার্শনিক শাসকের কথা কল্পনা করেছেন। তাঁর মতে রাষ্ট্রনায়ক হবেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্য কারও আদেশ তিনি পালন করবেন না। মানব দেহে আত্মার স্থান যেমন সর্বোচ্চ তেমনি রাষ্ট্রে ও সমাজে রাষ্ট্র নায়কের স্থান সর্বোচ্চ। প্লেটোর মত ফারাবিও জোরালো কন্ঠে বলেন কেবল দার্শনিকদেরই শাসক হওয়া উচিৎ। কারণ তাঁরাই সমস্ত সৎ গুণের অধিকারী। ফারাবি সার্বভৌমকে রাইসুল আউয়াল বা প্রধানতম নেতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি অন্য কোনো শক্তির অধীনে থাকবেন না। তাঁর আদেশ অন্য সকলের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে পালনীয় হবে। তিনি বলেন যে, রাষ্ট্রনায়ক সততার সাথে কাজ করবেন এবং ন্যায়নীতি অনুসরণ করবেন। তিনি স্বেচ্ছাচারকে ঘৃণা করবেন। শাসক উদার চিত্তের অধিকারী হবেন এবং ক্ষমতার প্রতি লোভ রাখবেন না। ইংরেজ আইনবিদ জন অস্টিন সার্বভৌমের যে ব্যাখা প্রদান করেছেন আল ফারাবি কয়েক শতাব্দী পূর্বেই তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ফারাবির রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়ক সারকথা
বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আল ফারাবির রাষ্ট্রচিন্তা মূলত যৌক্তিক রাষ্ট্রতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনের চেষ্টা। নি:সন্দেহে বলা যায় তিনি ছিলেন প্রাচ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দার্শনিক। গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর ন্যায় ফারাবি রাষ্ট্রনায়কের সুন্দর চিত্র অংকন করেছেন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও এরিস্টটলকে প্রায় বিলুপ্ত অবস্থা থেকে তিনি তুলে এনেছিলেন। তাঁর এ অবদানের মূল্য অপরীসীম।
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, ২২ মার্চ ২০১৯, “আল ফারাবী ইসলামি দর্শনে এক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক” রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/al-farabi/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫।
৩. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, মো আব্দুর রশীদ, এ এমদাদুল হক ও অন্যান্য; রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় খণ্ড, রাষ্ট্রচিন্তা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ত্রয়োদশ প্রকাশ, ২০২০, পৃষ্ঠা ৮৯।
রচনাকাল ১৮ মার্চ, ২০২১, এসজিআর।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।