রাষ্ট্রদর্শন বা রাজনৈতিক দর্শন, (ইংরেজি: Political Philosophy) হলো রাজনীতি, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, সম্পত্তি, অধিকার, আইন এবং কর্তৃপক্ষ দ্বারা আইনের প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়গুলির অধ্যয়ন। রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসাবেও পরিচিত এই রাষ্ট্রদর্শন বিষয়টি মানবজাতির প্রগতির পথ ও তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে। এটি রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলোর রূপ কেমন, কী সরকারকে বৈধ করে তোলে, কোন অধিকার এবং স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রের রক্ষা করা উচিত, রাষ্ট্র কোন রূপ গ্রহণ করবে, আইন কী এবং নাগরিকরা কোন ধরনের সরকারকে বৈধতা দেয় এবং যদি প্রয়োজন হয় তবে কখন আইনীভাবে সরকারকে উৎখাত করা যেতে পারে ইত্যাদি প্রসঙ্গে।[১]
রাষ্ট্রদর্শন বা রাজনৈতিক দর্শন রাজনৈতিক বিষয়ের প্রকৃতি এবং আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থার বহুবিধ বিষয় সম্পর্কিত বিজ্ঞানের পাঠ ও আলোচনার আধার। রাষ্ট্রদর্শন কতকগুলো পূর্বনির্ধারিত অনুমানকে স্বতঃসিদ্ধ বলে গ্রহণ করে। সেজন্য রাজনৈতিক দর্শন অনুমানের উপর নির্ভরশীল। এছাড়া মূল্যবোধের ধারণা ও আলোচনা রাজনৈকি দর্শনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত।
রাষ্ট্রদর্শন হচ্ছে রাষ্ট্র সম্পর্কে দার্শনিক চিন্তন, রাষ্ট্রের প্রকৃতি, কার্যাবলি, মূল্য, রাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতার সত্যতা, জীবন ও জগতের পরম সার্থকতা হিসেবে রাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতার যথার্থতা সম্পর্কে দার্শনিক অনুসন্ধান লাভ এবং আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থার বহুবিধ বিষয় সম্পর্কিত বিজ্ঞানের পাঠ ও আলোচনার আধার।
রাষ্ট্রদর্শন বলতে আমরা রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রকৃতি, পরিধি ও কার্যাবলি এবং মানব জাতির উন্নয়ন ও প্রগতি সম্পর্কিত মতবাদকে বুঝি। সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র সম্পর্কিত দার্শনিক চিন্তাভাবনাই হলো রাষ্ট্রদর্শন। রাষ্ট্রদর্শনের বিষয়বস্তু প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। যেমন, মানব প্রকৃতি ও তার কার্যকলাপ, জীবনের সমগ্র অনুভূতির জন্য পৃথিবীর অপরাপর বিষয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক।[২]
রাষ্ট্রদর্শনের বৈশিষ্ট্য
অনেকে রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনকে সমার্থক বলে গণ্য করেন। রাজনৈতিক তত্ত্বের ন্যায় রাজনৈতিক দর্শনও রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থার আলোচনার তুলনায় আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যের অনুসন্ধান, রাষ্ট্রের আদর্শ ও উদ্দেশ্য এবং আদর্শ রাজনৈতিক জীবনের উপস্থাপনার উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের প্রাচীন রাজনৈতিক চিন্তা উপরোক্ত লক্ষ্যকে অনুসরণ করে আবর্তিত হয়েছে।[৩]
ডি. ডি. রাফায়েল (D. D. Raphael) তাঁর ‘Problems of Political Philosophy’ গ্রন্থে রাজনৈতিক দর্শনের চরিত্র নিরূপণের জন্য চেষ্টা করেছেন। তিনি আলোচনাকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেছেন।[৪] যথা :
১. বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও দার্শনিক তত্ত্ব (Scientific theory and Philosophical theory);
২. বিশ্বাসের সমালোচনামূলক মূল্যায়ন (Critical evaluation of beliefs);
৩. ধারণার ব্যাখ্যা (Clarification of concepts);
৪. দর্শন ও মতাদর্শ (Philosophy and Ideology);
৫. সমাজবিজ্ঞানের অনুসন্ধান পদ্ধতি।
বিশ্বাসের সমালোচনামূলক মূল্যায়ন এবং ধারণার ব্যাখ্যাকে তিনি দর্শনের দুটি পরস্পর সংশ্লিষ্ট লক্ষ্য রূপে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বাসের সমালোচনামূলক মূল্যায়ন বলতে বুঝায় বিশ্বাসকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের যুক্তিসংগত ভিত্তি উপস্থিত করা। রাফায়েল ধারণার বিশ্লেষণকে ঐতিহ্যগত দর্শনের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করেন। দার্শনিক সমস্যা মূলত সাধারণভাবে প্রযোজ্য ধারণা নিয়ে আলোচনা করে। দর্শন ধারণার বিশ্লেষণ সমন্বয় সাধন এবং উন্নতি বিধানের চেষ্টা করে।
রাফায়েলের মতে, সামাজিক ও রাজনৈকি দর্শন দর্শনের শাখা। রাজনৈতিক দর্শনকে তিনি সমাজদর্শনের অঙ্গীভূত মনে করেন। কারণ, রাজনৈতিক জীবন সমাজজীবনের একটি অংশ; তাই রাজনৈতিক দর্শনও সমাজদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।
রাষ্ট্রদর্শনের বিষয়বস্তু হিসেবে যুক্ত হয়েছে দাস সামন্ত, পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক যুগের রাজনৈতিক ও দার্শনিক মতবাদসমূহ। সাম্রাজ্যবাদী যুগে উদারতাবাদ ও মার্কসবাদ প্রধান ধারারূপে সারা দুনিয়ায় বিরাজমান। মহাদেশীয় ইউরোপে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দশকগুলিতে রাজনৈতিক দর্শনের এক বিশাল প্রস্ফুটিত রূপ দেখা গিয়েছিল, যেখানে মার্কসবাদ আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এটি ছিল জ্যাঁ-পল সার্ত্রে এবং লুই অ্যালথুসারের সময় এবং চীনে মাও সেতুং এবং কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর বিজয়, পাশাপাশি মে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাগুলি বিপ্লবী আদর্শের প্রতি বিশেষত নয়া বাম প্রমুখ ব্যক্তিদের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে।
রাষ্ট্রদর্শনের বিষয়বস্তু
রাষ্ট্রই হচ্ছে রাষ্ট্রদর্শনের মূল একথা বলা যায় না। বিভিন্ন যুগে রাষ্ট্রদর্শনের বিভিন্ন সমস্যা প্রাধান্য পেয়েছে। প্রাচীন ধ্রুপদী দাস যুগে বিশেষ করে গ্রিক ও রোমান চিন্তায় যে সমস্ত প্রশ্ন প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ন্যায়নীতির ধারণা, আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, শাসনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, শাসকের যোগ্যতা এবং আইনের প্রয়োজনীয়তা ও লক্ষ্য, সমতার ভিত্তিতে সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব কী না প্রভৃতি।[৫]
সামন্ত যুগে রাষ্ট্রদর্শনের ধারাটি ছিলো কিছুটা ভিন্ন ধর্মী। আধ্যাত্মিক ও পার্থিব শক্তির প্রাধান্যের লড়াই এই যুগের রাষ্ট্রদর্শনকে প্রভাবিত করেছে। ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে সংস্কার আন্দোলন ষোড়শ শতাব্দীতে রাষ্ট্রদর্শনের অগ্রগতিকে প্রসারিত করেছে। সার্বভৌমিকতা ও জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণাটিও এই সময় প্রচারিত হয়।
পঞ্চদশ, ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর পুঁজিবাদী চিন্তায় প্রাধান্য পায় রাষ্ট্র ও সংগঠনের বিভিন্ন তত্ত্ব। গণতন্ত্র, প্রতিনিধিত্ব, সমতা, স্বাধীনতা, শিল্পায়নের প্রভাব, পররাষ্ট্র প্রভৃতি ধারণা এই সময় জনপ্রিয় হয়।
উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী সাম্রাজ্যবাদের অবক্ষয় ও সমাজতন্ত্রের উত্থানের যুগে তে যে বিষয়গুলো ছিলো রাজনৈতিক বিতর্কের মূলে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, জাতি রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের কার্যাবলি ও ক্ষয়, রাষ্ট্রের পরিধি, রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রভৃতি।

রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাষ্ট্রদর্শন বিষয়ের সম্পর্ক
সাধারণভাবে রাজনৈতিক দর্শন ও রাজনৈতিক তত্ত্ব একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। তথাপি এদের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য হলো, রাজনৈতিক দর্শন রাজনৈতিক তত্ত্বের চেয়ে ব্যাপক। কারণ রাজনৈতিক তত্ত্ব হলো কোনো নির্দিষ্ট যুগের বা চিন্তাবিদদের রাজনৈতিক ধারণাসমূহ। অপরদিকে, রাজনৈতিক দর্শন হলো কালব্যাপী রাজনৈতিক ধারণার সমষ্টি।
আর্নেস্ট বার্কার (Ernest Barker) এর মতে, “রাজনৈতিক তত্ত্ব বিভিন্ন চিন্তাবিদদের চিন্তাধারা এবং গবেষণা মাত্র। এটি তাদের সমসাময়িক কালের বাস্তব ঘটনাপ্রবাহ হতে বহু দূরে অবস্থান করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দর্শন সমগ্র যুগের অন্তরস্থ স্থায়ী দর্শন।”[৬] রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপেই রাজনৈতিক দর্শনের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নিউ স্ট্রস (Leo Strauss) ‘What is Philosophy’ প্রবন্ধে রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের সম্পর্ক আলোচনা করেছেন। তিনি রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনকে রাষ্ট্রচিন্তার অংশরূপে গণ্য করেছেন।[৭] তাঁর মতে, রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শন পরস্পরের পরিপূরক। তিনি এ দু’য়ের পার্থক্য নির্ণয়ের বিরোধী। রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনেতিক দর্শনের যোগাযোগ অত্যন্ত গভীর। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এ ধারা প্রবহমান ছিল। দৃষ্টবাদের (ইংরেজি: Positivism) আবির্ভাব রাজনৈতিক দর্শনের দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যের ধারাকে পরিবর্তিত করার চেষ্টা করে। দৃষ্টবাদের লক্ষ্য হলো সমাজবিজ্ঞানের বিজ্ঞানসম্মত, অভিজ্ঞতাবাদী ও মূল্যবোধজনিত আলোচনা উপস্থিত করা।
বাস্তবে রাষ্ট্রদর্শন ব্যতীত কোনো রাজনৈতিক তত্ত্ব গড়ে তোলা অসম্ভব। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ দর্শনবিহীন আলোচনার কথা উল্লেখ করলেও আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক তত্ত্বই রাজনৈতিক দর্শনকে উপেক্ষা করে গড়ে উঠেনি। রাজনৈতিক তত্ত্ব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত। রাজনৈতিক তত্ত্বকে রাজনৈতিক দর্শন হতে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়।
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, ১৩ আগস্ট, ২০১৯, “রাষ্ট্রদর্শন প্রসঙ্গে”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/philosophy/on-political-philosophy/
২. মো. আবদুল ওদুদ, “রাষ্ট্রদর্শনের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, বিকাশ ধারা, পরিধি, পদ্ধতি, যুগসমূহ, উপকারিতা ও অন্যান্য বিষয়ের সাথে সম্পর্ক”, রাষ্ট্রদর্শন, মনন পাবলিকেশন, ঢাকা, দ্বিতীয় প্রকাশ; ১৪ এপ্রিল ২০১৪; পৃষ্ঠা ২৩-২৯।
৩. ড. রবিউল ইসলাম, মীর মোশাররফ হোসেন ও অন্যান্য, রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি, গ্রন্থ কুটির ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ৮
৪. উৎপল রায় ও নির্মল কান্তি ঘোষ, ১৯৮০:১০৩
৫. মো. আবদুল ও ওদুদ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৩।
৬. Earnest Barker, The Social and Political Ideas of Some Great Mediaeval Thinker, F.J.C. Hearnshaw, London, 1923, p. 10-11.
৭. উৎপল রায় ও নির্মল কান্তি ঘোষ, ১৯৮০:১০৩
রচনাকাল: ১৩ আগস্ট, ২০১৯, নেত্রকোনা, বাংলাদেশ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।