আবুল কাসেম ফজলুল হকের রাষ্ট্রচিন্তা (ইংরেজি: Political thoughts of Abul Quasem Fazlul Huq) পরিব্যাপ্ত হয়েছে জাতীয়তাবাদ ও তার পরিপূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং মালেমাবাদ বা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদকে কেন্দ্র করে। এই দুই মতাদর্শের আলোকে তিনি বিশ্বায়ন ও নারীবাদবিরোধী ভূমিকাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের জন্য লড়াই করতে গিয়ে তিনি বিরোধীতা করেছেন পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্বায়নের সংগে যুক্ত সমস্ত প্রতিবিপ্লবী চিন্তাধারাকে।
আবুল কাসেম ফজলুল হক যেসব চিন্তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে চান তার প্রথমটিতেই আসে আত্মনির্ভরতা, আত্মশক্তি, স্বাজাত্যবোধ ও দেশপ্রেমের বিকশিত রূপ হিসেবে জাতীয়তাবাদ ও তার পরিপূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ। তিনি আত্মনির্ভর শক্তিমান সমৃদ্ধিমান একটি জাতি চান যারা নিজেরা নিজেদেরকে স্বাধীন রাখবে, নিজেদের আত্মবিকাশের পথ নির্মাণ করবে, বাইরের অপশক্তির হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করবে।
তিনি আধিপত্যবাদি, উপনিবেশবাদি, নয়া-উপনিবেশবাদি, সাম্রাজ্যবাদি নীতির তীব্র বিরোধি। তিনি প্রতিটি জাতির স্বাধীনভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পথ উন্মোচনের কাজ করেন, কীভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জাতিগুলো নিজেদের বিকশিত করবে তার পথ বের করেন। তিনি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্বয়ংসম্পূর্ণতার নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। পরনির্ভরতার, বৃহত শক্তির কাছে আত্মসমর্পণের ও আত্মবিক্রয়ের নীতির তিনি ঘোর বিরোধি। তাই তিনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন ‘জাতির ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি, শ্রমশক্তি ও সম্পদের সদ্ব্যবহার দ্বারা জাতির আত্মগত ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উন্নতি করা যায়’[১]।
জাতীয় হীনমন্যতাবোধ কাটিয়ে তিনি জাতিকে ঐশ্বর্যশালী করতে চান। সামাজিক আকর্ষণ, সামাজিক সংহতি, পারস্পরিক সম্প্রীতি, ও হৃদ্যতা বাড়িয়ে তিনি একটি সুস্থ, সুন্দর, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চান। তিনি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল, জাতির অবক্ষয়ের কাল দূর হবেই; জনগণের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন উন্নত করা গেলে জাতি আত্মনির্ভর হবে, নিজেদের শক্তির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবে, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে। তিনি বলেন ‘জাতির আত্মনির্ভরতাই তো স্বার্বভৌমত্ব’[২]।
ফজলুল হকের রাষ্ট্রচিন্তা এবং জনগণের আত্মশক্তি
ফজলুল হকের রাষ্ট্রচিন্তা জুড়ে আছে জনগণ সম্পর্কিত ধারণা। জাতির আত্মশক্তি বলতে তিনি জনগণের আত্মশক্তিকেই বুঝিয়েছেন। জনগণের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের উপরে আস্থশীল এই মানুষটি তাই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে ঘোষণা করতে পারেন ‘যখন জনগণ বিবেকবুদ্ধি অবলম্বন করে সংঘবদ্ধ হয়েছে তখন সেই শক্তির সামনে কোথাও কোনো অত্যাচারি শাসক— কোনো যুদ্ধবাজ শক্তি টিকতে পারেনি[৩]। কেননা জনগণ পারমানবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী, জনগণ জাগলে কোনো অপশক্তিই তাকে পরাজিত করতে পারে না।
একদা তিনি আমাকে জনগণ বলতে ‘বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যারা বিদেশের দালাল নয়, যারা সাধারণ মানুষের কল্যাণে চিন্তা করেন, যারা দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চান, যারা দেশের প্রশাসনব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনৈতিকব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধাপে ধাপে সংস্কার করে উন্নত করতে চান তাদের সকলকেই’ বুঝিয়েছিলেন। জনগণের সংজ্ঞাকেও তিনি সময়ের প্রবহমানতায় পুননির্ধারণ করে নিতে চান। এই জনগণের উন্নতির কথা বলেই তিনি ক্ষান্ত থাকেন না। তিনি সে কথাকে কাজে পরিণত করার জন্য রচনা করেন ‘আটাশ দফাঃ আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি’। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে লিখিত বাংলাদেশের এই মুক্তিসনদটির প্রচার শুরু হয় ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এবং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার কপি বিতরণ ও বিপণন করা হয়।
২০০৫-২০১৩ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় ধরে তিনি এবং স্বদেশ চিন্তা সংঘ[৪]-এর কর্মিরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চেষ্টা করেছেন ২৮ দফাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কার্যকর করতে; এই কর্মসূচিকে রাজনীতিক, লেখক, বুদ্ধিজীবি, ছাত্রনেতাদের হাতে পৌঁছে দিতে। এই সুদীর্ঘ সময় ক্রমাগত লেগে থেকে স্বদেশ চিন্তা সংঘ দৃঢ়ভাবে চেষ্টা ও আশা করেছে ২৮ দফার ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতিতে সদর্থক পরিবর্তন আনতে এবং দেশে একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, বিজ্ঞানমনষ্ক, সৃষ্টিশীল রাজনৈতিক ধারা বিকশিত করতে। এ-কাজ করতে গিয়ে তিনি মাঝে মাঝে হতাশ হয়েছেন কিন্তু কাজ পরিত্যাগ করেননি। তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন কী কারণে দেশে প্রগতিশীল কর্মসূচিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল গড়ে উঠছে না।
১৯৬০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, এবং তারপর থেকে কখনোই রাজনীতির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেননি। ফলে তিনি বুঝেছেন এ-দেশে রাজনীতিকে উন্নত করার আকাঙ্খী দলের খুব অভাব। প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনাকারী সংগঠন এদেশে অনেক রয়েছে কিন্তু জনজীবনের সংকট থেকে মুক্তিপ্রত্যাশি রাজনৈতিক দল নেই। তিনি অজস্র উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন এদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সমালোচনার জন্য সমালোচনা, বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করেছে; কিন্তু জনগণকে দীর্ঘমেয়াদি সামগ্রিক কর্মসূচির ভিত্তিতে জনমত তৈরি করে ঐক্যবদ্ধ করতে চায়নি। তিনি বহুবার বলেছেন এদেশের বামপন্থিদের গত ১১০ বছরের ইতিহাসে ‘রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার কোনো লক্ষণ পাওয়া যায় না। নিতান্ত উল্লেখ করার মতো কিছু পাওয়া গেলে যেতেও পারে, কিন্তু একটা জাতিভিত্তিক প্রগতিশীল কর্মসূচি— সমাজতান্ত্রিক অভিমুখি কর্মসূচি নিয়ে, জনসাধারণকে সংগে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগোবার কোনো চেষ্টা— কোনো চিন্তা খুঁজে পাওয়া যায় না’[৫]। এভেবেই তিনি বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলোর ইস্যুভিত্তিক সাময়িক উত্তেজনাকর স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনের বিরোধিতা করেন; একদফাভিত্তিক সরকার পতনের আন্দোলনকে জাতির জন্য আত্মঘাতি বলে মনে করেন। তিনি জাতিকে জাগাতে চান দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সামগ্রিক প্রগতিশীল বহুল প্রচারিত কর্মসূচির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ ও প্রাণবন্ত করে; হুজুগে মাতিয়ে নয়।
রাজনৈতিক ধারার প্রগতি ঘটানো সবচেয়ে কঠিন, তিনি একথা মানেন এবং গভীর মনোযোগের সাথে বাঙালির রাজনৈতিক কাজকে সমৃদ্ধ করতে করণীয় নির্দেশ করেন। রাজনীতি তার কাছে নিছক একটি আলোচনার বিষয় নয়; রাজনীতি তার কাছে জনগণের সমগ্র জীবনের সমস্যাসমূহ থেকে মুক্ত হবার ক্রমাগত প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টার সাথে বাঙালি জীবনের সম্পৃক্তি অতীতে খুব একটা ছিলো না। তিনি জানেন বাঙালির জ্ঞানগত ঐতিহ্যের সংগে রাজনৈতিক ঐতিহ্যের সংযোগ ও সমন্বয় অতীতে করা যায়নি। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন ‘চিন্তাকে সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করা হয়েছে আমাদের রাজনীতিতে’। এই চিন্তা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন জ্ঞানের ভাণ্ডারকে। জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে, ধনাত্মক দৃষ্টিভংগি অবলম্বন করে, দার্শনিক রাষ্ট্রচিন্তকদের মতের ভিত্তিতে, জনগণকে সংগে নিয়ে, রাষ্ট্র ও সমাজকে প্রগতিশীল করার লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচিকে সামনে এনে ক্রমাগত কাজ চালিয়ে যাওয়ার নাম রাজনীতি। এই রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশের রাজনীতির অধোগামি ধারাকে কটাক্ষ করে তাই তিনি বলতে পারেন,
‘জনস্বার্থের বিবেচনা যে রাজনীতিতে নেই, সে রাজনীতির অবসান যত দ্রুত ঘটে ততই মংগল। বর্তমান রাজনীতি নিতান্ত রাষ্ট্রটিকে রক্ষা করার যোগ্যতা রাখে না’[৬]।
ফজলুল হকের রাষ্ট্রচিন্তা ও নেতৃত্বের সমস্যা
আবুল কাসেম ফজলুল হকের রাষ্ট্রচিন্তা ব্যাপ্ত করেছে নেতৃত্ব সম্পর্কিত চিন্তার এক বিশাল ক্ষেত্র। তিনি রাজনৈতিক চিন্তায় জড়িত করেছেন নেতৃত্ব, নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য, নেতৃত্বের গুণাবলী, নেতৃত্বের স্বরূপ, নেতৃত্বের গঠন ও নেতৃত্ব নির্বাচন পদ্ধতির সমস্যাকে। তিনি নেতৃত্বকে কোনো ভাববাদি আজগুবি ব্যাপার বলে মনে করেন না। তিনি জানেন জনগণই নেতৃত্ব সৃষ্টি করে, জনগণ যেরকম নেতৃত্ব আশা করে সেরকম নেতৃত্ব তৈরি করে নেয়। জনগণ উন্নত না হলে নেতৃত্ব উন্নত হবে না একথা তিনি বহুবার বলেছেন এবং জনগণের মান উন্নত করার জন্য রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, পর্যালোচনা, আত্মসমালোচনা ইত্যাদি জনগণের মাঝে বিকশিত করার চেষ্টা করেছেন। আমি যতদিনই তার বক্তৃতা শুনেছি প্রায় সবদিনই দেখেছি, তিনি এ-বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। তার অনেক লেখাতেই নেতৃত্ব ও রাজনীতির বিষয়টি ঘুরেফিরে এসেছে। তিনি লিখেছেন,
‘বাংলাদেশের সমাজে ভালো নেতৃত্ব গড়ে না ওঠার নানা কারণের মধ্যে একটি প্রধান কারণ হলো জনসাধারণের কোনো কোনো অংশের চরিত্রদৈন্য এবং প্রায় সকলের অসতর্কতা, হুযুগপ্রিয়তা, অপরিণামদর্শিতা ও অবিমৃষ্যকারিতা’[৭]।
নেতৃত্বের গঠনপ্রক্রিয়া একটি বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন গঠনমূলক সচেতন প্রক্রিয়া; এটি সতস্ফূর্ততার ব্যাপার নয়। তাৎক্ষণিক, ভাবাবেগযুক্ত, পরিকল্পনাহীন আন্দোলনের নেতৃত্ব সমস্যার সাময়িক সমাধান করতে পারলেও জনজীবন, রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নতি ঘটাতে পারবে না। কেননা ‘নেতৃত্ব নিতান্তই ব্যক্তিবিশেষের ব্যাপার নয়, দলগত ব্যাপার; কেবল দলগত ব্যাপার নয়, জনগণেরও ব্যাপার’[৮]। এই দলীয় ব্যাপারটির প্রতি তিনি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং প্রথমেই দলগঠন প্রক্রিয়ায় মনোযোগ দিতে বলেন। তার রাষ্ট্রচিন্তার ধারাটি হচ্ছে অনেকটা ব্যক্তি-দল-রাজনীতি-রাষ্ট্র-সমাজ এবং বিপরীতক্রমেও চলমান। তিনি আরো অনেক কিছুর মতোই রাজনীতি বিষয়ে পূর্ণাংগ গভীর মনোযোগ দেবার জন্য সদাপ্রস্তুত। আমি দেখেছি রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলে তার কোনো ক্লান্তি নেই, যেমনি সমাজ ও রাষ্ট্র বিষয়ে তিনি প্রতিনিয়ত চিন্তাশীল।
আবুল কাসেম ফজলুল হকের রাষ্ট্রচিন্তা পাওয়া যাবে তার প্রবন্ধের পাঠে। সেসব পাঠ করতে গেলে বা তার আলোচনা শুনলে আমাদের এই অভিজ্ঞতা হয় যে, তিনি কোনো বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একের পর এক সমার্থক শব্দ লিখতে বা বলতে থাকেন। যেমন, তিনি লিখেছেন
‘যে সমাজে বিবেক লোপ পায়, বুদ্ধি বিকারপ্রাপ্ত হয়, নিষ্ঠুরতা ও হিংসা-প্রতিহিংসা ভালোবাসার স্থলাভিষিক্ত হয়, সেখানেই ধর্মের নামে, মানবতা ও ন্যায়বিচারের নামে, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নামে অনাচার চলে; স্বাধীনতার নামে বারবার স্বেচ্ছাচার-স্বৈরাচার মাথা তোলে; ধূর্ততা-চতুরতা-ভাওতা-প্রতারণার আধিপত্য কায়েম হয়; একটির পর একটি অন্ধকারের শক্তি রাজত্ব করে; ক্ষমতার অত্যাচারে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়; ভিক্ষাবৃত্তি, বেকারত্ব, দুর্নীতি, দারিদ্র, অনাহার, অর্ধাহার, নিরাপত্তাহীনতা, বিদেশি হস্তক্ষেপ, অদৃষ্টবাদ, পরাধীনতা, অন্ধবিশ্বাস, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, বিবেকহীনতা, অযুক্তি, কুযুক্তি, অনাচার, অপচয়, অপব্যয়, অনাস্থা, অপ্রেম, নিষ্ঠুরতা, অবক্ষয়, সামাজিক শিথিলতা, বিচ্ছিন্নতা, বিযুক্তি প্রভৃতি সকল শত্রু মিলে জীবনের সুস্থতা, স্বাভাবিকতা ও গতিশীলতাকে হরণ করে নেয়। সাধারণ মানুষ নিস্তেজ ও নিষ্ক্রিয় থাকলে শূন্যমস্তিষ্ক, ফাঁকাহৃদয়, নির্বোধ দুর্বৃত্তদের নেতৃত্ব দুর্দৈবের মতো স্বেচ্ছাচারি নিষ্ঠুরতায় পরিণত হয়। তাতে নেতৃত্ব আর শোষণ-পীড়ন-প্রতারনা সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়’।[৯]
এভাবেই তিনি শব্দের পর সমার্থক শব্দ সাজিয়ে নির্মাণ করেন একটি সামগ্রিক চিন্তা; যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে গড়ে তোলেন যুক্তির সমগ্রতা। এই সমগ্রতা তিনি প্রকাশ করেছেন তার সামগ্রিক চিন্তাধারায়।
পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্বায়ন বিরোধীতা
আবুল কাসেম ফজলুল হকের রাষ্ট্রচিন্তা আবর্তিত হয়েছে ইতিহাসের আলোকে। তিনি বিশ্বায়নবাদী চিন্তার আবির্ভাবকে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিকশিত রূপ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। বিশ শতকে পৃথিবীতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। পুঁজিবাদি উপনিবেশবাদি বিশ্বব্যবস্থার সঙ্কট নিয়ে শতাব্দীর শুরু, ১৯১৭-তে রুশ বিপ্লব, পরে কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, আবার শতাব্দীর শেষ দিকে সেগুলোতে ভাঙন, এরই মধ্যে দুটি মহাযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদের চরম উত্থান ও পতন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উপনিবেশসমূহের স্বাধীনতা অর্জন, শতাব্দীর শেষ পদে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান এবং রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহারের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে কলুষিত করার আর রহস্যবাদ ও অদৃষ্টবাদের সাময়িক পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বিংশ শতাব্দী।
বিশ শতকের সমাজবাদের বিস্তারনের অবস্থায় উন্নত জীবনের দাবিতে অতীতের রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তন ঘটবে, পুরাতন আদর্শের জায়গায় নতুন আদর্শের উদ্ভব ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবে আমরা তা প্রত্যক্ষও করছি। ১৯৮০’র দশকের শেষে ও ’৯০’র দশকের প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। চিন জাতীয়তাবাদি নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে। ১৯৬০’র দশকের পৃথিবীব্যাপি বিস্তৃত বিপ্লবি আকাঙ্খা পরবর্তি দশকেই কমতে শুরু করে এবং বর্তমানে শূন্যের কোঠায়; আর এরই মধ্যে আমেরিকা একক সুপার পাওয়ার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়েছে। ক্ষুদ্র ও অর্থনীতিতে দুর্বল রাষ্টগুলোর স্বাধীন সত্তায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
পৃথিবীর এই পরিবর্তিত অবস্থায় বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার গতি প্রকৃতির দিখে লক্ষ্য রেখে মানব ইতিহাসের অতীতের অভিজ্ঞতা দেখে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আর্ন্তজাতিকতাবাদ, কল্যাণরাষ্ট্র ইত্যাদি সম্পর্কে আবুল কাসেম ফজলুল হক তার প্রধান চারটি চিন্তা যথা মার্কসবাদ থেকে মাওবাদ, নিপীড়িত জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম থেকে বিশ্বায়ন ও নারীবাদবিরোধী ভূমিকাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে মুক্তির জন্য কাজ করেছেন।
গত চার দশকে এসব বিষয়ে তিনি লিখেছেন অনেক চিন্তামূলক প্রবন্ধ। তাঁর লেখায় আছে ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, নীতিবিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রচিন্তা, সাহিত্যালোচনা ইত্যাদির আশ্রয়ে বাঙলাদেশে জীবন ও সমাজের নিপুণ বিশ্লেষণ। তাঁর লেখা ও কথায় একটি মূল সুর প্রতিধ্বনিত: এ সুরটি হলো বাঙালি, বাঙলা ভাষা ও বাঙলাদেশকে কেন্দ্র করে বিকশিত। ফলে তিনি আন্তরিকভাবে জাতীয়তাবাদি এবং জাতীয়তাবাদি হওয়ার কারণেই আর্ন্তজাতিকতাবাদি। সকল জাতির সমমর্যাদায় বেঁচে থাকার ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে তিনি উৎসাহের সংগে সমর্থন করেন। এক জাতির উপর অন্য জাতির আরোপ করে দেওয়া রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে তিনি অবাঞ্ছনীয় মনে করেন। মানবজাতির উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়ান এবং অতীত অভিজ্ঞতা থেকে খুঁজে আনেন ভবিষ্যতের উজ্জ্বল দিনের বাস্তবায়নসম্ভব স্বপ্নীল আদর্শ।[১০]
তথ্যসূত্র ও টিকা
১. অনুপ সাদি সম্পা.; বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা; ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ; ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১০; পৃষ্ঠা ৯৬।
২. আবুল কাসেম ফজলুল হক; প্রাচুর্যে রিক্ততা; কথাপ্রকাশ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০১০; পৃষ্ঠা ৮৪।
৩. দেখুন, মিজান রহমান সম্পা.; সাময়িকপত্র লোকায়ত; বর্ষ ২৯, সংখ্যা ১; ফেব্রুয়ারি ২০০৯; পৃষ্ঠা ২১।
৪. একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, পাঠচক্র ও আড্ডাকেন্দ্র; সংগঠনের বর্তমান সভাপতি আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং মহাসচিব হাসান ফকরী। আহমদ শরীফ (১৯২১-১৯৯৯) ছিলেন প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি।
৫. আবুল কাসেম ফজলুল হক; রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ; কথাপ্রকাশ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০০৮; পৃষ্ঠা ২৩৭।
৬. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৫।
৭. আবুল কাসেম ফজলুল হক; শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ; কথাপ্রকাশ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০১১; পৃষ্ঠা ১৪৫।
৮. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭।
৯. আবুল কাসেম ফজলুল হক; রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ; কথাপ্রকাশ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০০৮; পৃষ্ঠা ১৯৬-১৯৭।
১০. অনুপ সাদি, “নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে সভ্যতা ও সংস্কৃতি” দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, ১৯ আগস্ট ২০০২, ঢাকা।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।