রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাষ্ট্রচিন্তা হচ্ছে বিপ্লববিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তবাদী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাষ্ট্রচিন্তা (ইংরেজি: Political ideas of Rabindranath Tagore) হচ্ছে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলন ও সকল ধরনের বিপ্লববিরোধী এক প্রতিক্রিয়াশীল সুবিধাবাদী চিন্তাধারা। উনিশ ও বিশ শতকের বাংলা ভাষার প্রতিক্রিয়াশীল জনপ্রিয় কবি, লেখক, গীতিকার, দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণতান্ত্রিক বিপ্লবে আস্থাশীল নন, কৃষকের সমস্যার ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন, সর্বহারা বিপ্লবের যুগে সামন্তবাদী আবর্জনার ফেরিওয়ালা, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হলেও এই দুটিকে ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে বিদায় করার জন্য কাজ করতে অপারগ, চিন্তায় ঋষিসুলভ এবং কর্মে সুবিধাবাদী। নানা রঙে নানা ধারায় পিছিয়ে থাকা এক তুমুল প্রভাবশালী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

যদিও তিনি বাঙালিকে ভালোবেসেছিলেন তাদেরকে বদলানোর উদ্দেশ্যে, কিন্তু নিজে খুব বদলেছিলেন তা নয়। রবীন্দ্রভাবনার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বাঙালি ও তার ভাষা। বাঙালির প্রাণে আলো জ্বালানো এই মানুষটি ইউরো-কেন্দ্রীকতাবাদী রেনেসাঁ ও আলোকায়নের যুগ দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর জীবনকাল পুঁজিবাদের বিকাশের শেষ পর্যায় এবং সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের কাল। দক্ষিণ এশিয়ার পরাধীনতার কালেও এই মানুষটি উপনিবেশবাদী গণতন্ত্রের উদারনীতিক ভাবাদর্শে এবং ইউরোপিয় সভ্যতার প্রতি আস্থাশীল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাষ্ট্রচিন্তা হচ্ছে বিপ্লববিরোধী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাষ্ট্রচিন্তা হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিপ্লববিরোধী। সামন্তবাদের সমর্থক এই কবি, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরোধী ছিলেন। গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কৃষক জমির মালিক হন। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন কৃষকের জমির মালিকানার বিরোধী ছিলেন। জমির অধিকারকে তার কাছে কাড়াকাড়ি মনে হয়েছিল, এবং এই কাড়াকাড়িকে বনবিড়ালের কাড়াকাড়ি মনে হয়েছিল। এইভাবে তিনি গণতন্ত্র বিরোধীতা থেকে উপস্থিত হন সাম্যবাদ বিরোধিতায়।

আরো পড়ুন: গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র সাম্যবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথ

পুরোপুরি যুক্তিতাড়িত না হলেও এই কবি আবেগের প্রাবল্যে ভেসে যাননি। রাজনীতিক না হয়েও রাজনীতি বিষয়ে সারা জীবন লিখেছেন এবং রাজনীতি সংক্রান্ত ভুল চিন্তা জনগণের মাঝে প্রোথিত করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ ও জাতিসমূহের স্বাধীনতার শত্রু সংগঠন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে কিছুদিন কবিতা লিখে শেষে সেই সংগঠন ছেড়ে দেন, কিন্তু বিপ্লবীদের সারা জীবন বিরোধীতা করেছিলেন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদী রবীন্দ্রনাথ

বাঙালির উন্নতি প্রত্যাশী এই মানুষটি জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের সমন্বয় করেছিলেন। তিনি বাঙালির ত্রুটিগুলোকে ঘৃণা করতেন। তিনি সর্বদাই চেয়েছেন বাঙালি তার মহত্ত নিয়ে বিকশিত ও প্রকাশিত হোক। বাঙালি এক হোক তার শক্তি দিয়ে। তাই তিনি লিখতে পেরেছিলেন,

আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরি পরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহবল হইয়া উঠাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য।[১]

তিনি আরো লিখেছেন,

আমরা ব্যক্তির জন্য আত্মবিসর্জন করিতেও পারি, কিন্তু মহৎ ভাবের জন্য সিকি পয়সাও দিতে পারি না। আমরা কেবল ঘরে বসিয়া বড়ো কথা লইয়া হাসিতামাশা করিতে পারি, বড়ো লোককে লইয়া বিদ্রূপ করিতে পারি, তার পরে ফুড় ফুড়্‌ করিয়া খানিকটা তামাক টানিয়া তাস খেলিতে বসি। আমাদের কী হবে তাই ভাবি। অথচ ঘরে বসিয়া আমাদের অহংকার অভিমান খুব মোটা হইতেছে। আমরা ঠিক দিয়া রাখিয়াছি আমরা সমুদয় সভ্য জাতির সমকক্ষ। আমরা না পড়িয়া পণ্ডিত, আমরা না লড়িয়া বীর, আমরা ধাঁ করিয়া সভ্য, আমরা ফাঁকি দিয়া পেট্রিয়ট–আমাদের রসনার অদ্ভুত রাসায়নিক প্রভাবে জগতে যে তুমুল বিপ্লব উপস্থিত হইবে আমরা তাহারই জন্য প্রতীক্ষা করিয়া আছি; সমস্ত জগৎও সেই দিকে সবিস্ময়ে নিরীক্ষণ করিয়া আছে।  

সমাজ, চিঠিপত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আলোকায়নের সমর্থক রবীন্দ্রনাথ

মানুষের বৈষম্যকে তিনি অস্বাভাবিক মনে করতেন, যা প্রায় সব কবিই করে থাকেন। বৈষম্যকে দূর করার জন্য তিনি বুর্জোয়া রাজনৈতিক নেতাদের মতো হয়তো হেন করেগা, তেন করেগা বলেননি; তবুও তিনি ছিলেন বিবেকহীন বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাইতো বলছেন,

“দেহের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমা হলে সেটাকে স্বাস্থের লক্ষণ বলে না। তেমনি গোটা দেশকে রিক্ত করে, নিঃস্ব করে, বঞ্চিত করে অল্প কিছু মানুষের জন্য অনন্যসাধারণ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করাটাও কোনো সভ্য সমাজের রীতি নয়।”

জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে তিনি এগিয়েছেন মানবমুক্তির সন্ধানে। তিনি জেনেছেন মানুষের মুক্তিসংগ্রামে শামিল হলে সবচেয়ে কাছের ঘরের মানুষটিও বিরোধীতা করতে পারে। তাই তিনি একলা লড়াই করতে সাহস যোগান। স্বদেশ পর্বের গানে লিখেছেন আপনজনে ছেড়ে যাবে, কিন্তু এতে দুর্ভাবনার কিছু নেই, পথে অন্ধকার নেমে আসলেও বারবার আলো জ্বালতে হবে, হয়তো দু’চারবার আলো নিভে যাবে কিন্তু একসময় আলো ঠিকই জ্বল্বে, কাছের মানুষটির পাষাণ হৃদয় না গললেও বনের প্রাণিও হয়তো লড়াকু মানুষটির কথা শুনবে।  বারবার চেষ্টা করেই আলোর দুয়ার খুলতে হবে।[২]

ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভংগি ফুটে উঠেছে এই বাক্যে যেখানে তিনি বলছেন,

“যে রাজা প্রজাকে দাস করে রাখতে চেয়েছে, সে রাজার সর্বপ্রধান সহায় ধর্ম, যা মানুষকে অন্ধ করে রাখে। সে ধর্ম বিষকন্যার মতো; আলিঙ্গন করে সে মুগ্ধ করে, মুগ্ধ করে সে মারে। শক্তিশেলের চেয়ে ভক্তিশেল গভীরতর মর্মে গিয়ে প্রবেশ করে কেননা তার মার আরামের মার।…. ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা ভালো।”

রাশিয়ার চিঠি

সাহসি ও আশাবাদি রবীন্দ্রনাথ ‘আহবান’ কবিতায় বলেন

রক্তে-রাঙা ভাঙন-ধরা পথে
দুর্গমেরে পেরোতে হবে বিঘ্নজয়ী রথে,
পরান দিয়ে বাঁধিতে হবে সেতু।
ত্রাসের পদাঘাতের তাড়নায়,
অসম্মান নিয়ো না শিরে, ভুলো না আপনায়।

আহবান, জোড়াসাঁকো, কলিকাতা, ১ এপ্রিল, ১৯৩৯

সত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নানামুখী চিন্তা লক্ষ করা যায়। বোঝাপড়া কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছেন এই বলে যে,

“মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।”

সত্যকে তিনি যত কঠিনই হোক না কেন গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি অনেক সময় সত্যকেই কঠিন বলেছেন। নিজে লিখেছেন সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা। রবীন্দ্রনাথের সত্যোপলব্ধি সম্বন্ধে হুমায়ুন আজাদের মূল্যায়ন,

“সত্য ছাড়া সৌন্দর্যকে তিনি বেশ ভয় পেতেন, কে জানে কখন সৌন্দর্য আবার কোন রসাতলে ডুবোয়। সারা জীবনে পদ্যে ও গদ্যে সত্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি বহু কথা বলেছেন, কীটসের উক্তিটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের ভেবে ব্যবহার করেছেন বহু বার; কিন্তু যখনই তিনি উদ্ধৃত করেছেন উক্তিটি, তখনই ভুল উদ্ধৃত করেছেন, বা নিজের বিশ্বাস অনুসারে সাজিয়েছেন শব্দগুলোকে। কীটসের -কে রবীন্দ্রনাথ সব সময়ই উদ্ধৃত করেছেন -রূপে। কেনো এমন করেছেন রবীন্দ্রনাথ? কীটসের কাছে সৌন্দর্য আগে, রবীন্দ্রনাথের কাছে সত্য আগে কেনো? সৌন্দর্যকে প্রধান মনে করতে কি কোনো অপরাধবোধে ভুগতেন রবীন্দ্রনাথ?”[৩]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাষ্ট্রচিন্তা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধীতা

বিশ শতকের সূচনা থেকেই তিনি পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের ভয়াবহ পরিণামের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে উঠেছিলেন। ‘স্বার্থদীপ্ত লোভ, হিংসার উৎসব, অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ-রাগিণী’র বিরুদ্ধে তিনি ফুটিয়ে তুলছিলেন তার গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা। উগ্র-জাতিপ্রেম ও পুঁজিবাদী জাতিয়তাবাদের মুখোশ খুলতেও কার্পণ্য করেননি। লিখেছেন,

শক্তিদম্ভ স্বার্থলোভ মারীর মতন
দেখিতে দেখিতে আজি ঘিরিছে ভুবন।
দেশ হেতে দেশান্তরে স্পর্শবিষ তার
শান্তিময় পল্লী যত করে ছারখার।

শক্তিদম্ভ; নৈবেদ্য

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তার ত্রুটিসমূহ যত দ্রুত আমরা উপলব্ধি করতে পারব ততই দক্ষিণ এশিয়ার নিপীড়িত জাতি ও জনগণের মুক্তি সহজতর করা সম্ভব হবে।  

রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার বিশ্লেষণ শুনুন ইউটিউব থেকে

তথ্যসূত্র

১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগরচরিত, ভাদ্র-কার্ত্তিক, ১৩০২, বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ, পুনর্মুদ্রণ ভাদ্র ১৪০০, পৃষ্ঠা ৫০-৫১।
২. স্বদেশ পর্বের গান।
৩. হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, জুলাই ১৯৯৭, পৃষ্ঠা- ৫৫-৫৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!