জনতা দল (ইংরেজি: People’s Party) ছিল ভারতের একটি প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী রাজনৈতিক দল যা ভিপি সিং-এর নেতৃত্বে জয়প্রকাশের নারায়ণের জন্মবার্ষিকীতে ১১ অক্টোবর ১৯৮৮ তারিখে জনতা পার্টি, লোকদল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (জগজীবন) এবং জন মোর্চা একত্রিত হওয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল।
১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে গঠিত জনতা পার্টি বছর দুয়েকের মধ্যেই ভাঙনের মুখে পড়ে। পার্টির অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় লোকদল, জনসংঘ (পরে ভারতীয় জনতা পার্টি নাম গৃহীত হয়) ও সোসালিস্ট গোষ্ঠী নানা কারণে একের পর এক জনতা পার্টি পরিত্যাগ করে ।
১৯৮৮ খ্রি রাজীব গান্ধী মন্ত্রিসভা তথা কংগ্রেস দলে এক সংকট দেখা দেয়। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। রাজ্য ও জাতীয় স্তরের বিরোধী বিভিন্ন দল কংগ্রেসের বিকল্প সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর মাদ্রাজে এক সভায় জনমোর্চা নামে একটি সংগঠনে সমন্বিত হয়। তাতে জনতা পার্টির একাংশ, লোকদল, কংগ্রেস (স), ডি এম কে, তেলুগু দেশম, অসম গণ পরিষদ প্রভৃতি সাতটি দল যোগ দেয় ।
ওই বছরের ১১ অক্টোবর বাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে অবশিষ্ট জনতা পার্টি, কংগ্রেস (ইন্দিরা) থেকে বহিষ্কৃত বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী, লোকদল (ব) এবং কংগ্রেস (স) সমেত জনমোর্চার সহযোগে জনতা দল গঠিত হয়। পূর্বতন জনতা পার্টির গঠনতন্ত্র নবগঠিত জনতা দলের গঠনতন্ত্র হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল লোকসভায় দলটি স্বীকৃতি পায় এবং সেটিকে চক্রমধ্যে হলধর নির্বাচনী প্রতীক দেওয়া হয়। জনতা দলের কর্মপন্থা সংক্রান্ত দলিলে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ, গ্রামীণ ও কৃষি অর্থনীতির উন্নয়ন, কাজের অধিকার, ভূমিব্যবস্থার সংস্কার, মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তফসিলি ও অন্যান্য অনুন্নত জাতিসমূহকে আইনানুগ সুযোগসুবিধা দান, কর্মসংস্থান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদির উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
ইতিহাস সম্পর্কে একটি নৃত্য আলেখ্য দেখুন
ক্ষমতায় আরোহণ
এটি প্রথম ক্ষমতায় আসে ১৯৮৯ সালে; মূলত বর্বর কুচক্রী রাজীব গান্ধীর দুর্নীতির অভিযোগের পর, যা বোফর্স কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত ছিল। এই কেলেঙ্কারিতে ভারতের জনগণের শত্রু বর্বর রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস (আই) নির্বাচনে হেরে যায়।
১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে জনতা দল, বিজেপি ও বামপন্থী দলগুলির সমর্থনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী হন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। পরে বিজেপি সমর্থন প্রত্যাহার করায় মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। চন্দ্রশেখরের নেতৃত্বে দলের একাংশ সমাজবাদী জনতা দল নাম গ্রহণ করে এবং কংগ্রেসের সমর্থনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করে, মাস কয়েক পরে সেটিরও পতন ঘটে।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে মধ্যবর্তী সাধারণ নির্বাচনে জনতা দলের মাত্র ৫৯জন লোকসভার সদস্যপদে জয়ী হন। তাঁদের মধ্যে ২০ জন সাংসদ অজিত সিং-এর নেতৃত্বে বেরিয়ে এসে প্রথমে একটি পৃথক দল গঠন এবং পরে কংগ্রেসে যোগ দেন। এটি ছিল দলের দ্বিতীয় ভাঙন। অবশিষ্ট ৩৯ জন সদস্য ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। মূলত দলের পূর্বতন সোসালিস্ট গোষ্ঠীর ১৪জন সদস্যকে নিয়ে জর্জ ফারনান্ডেজের নেতৃত্বে নতুন একটি দল প্রথমে জনতা দল (জর্জ) এবং পরে সমতা পার্টি নাম গ্রহণ করে। তাঁদের বিশিষ্ট নেতা রবি রায় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা ভি পি সিং, সভাপতি এস আর বোম্বাই, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব ও উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়ককে দলের যাবতীয় দুর্গতির জন্য দায়ী করেন।
ইতিপূর্বে চন্দ্রশেখরের সমাজবাদী জনতা পার্টি ছেড়ে মূলায়ম সিং যাদব সমাজবাদী পার্টি গঠন এবং বহুজন সমাজ পার্টির নেতা কাঁসিরামের সহযোগে উত্তর প্রদেশে সরকার গঠন করেন (১৯৯৩)। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে দল বিহারে শাসনক্ষমতা বজায় রাখে, কিন্তু উড়িষ্যায় দল ক্ষমতাচ্যুত হয়। অন্য দিকে দল কর্ণাটকে ক্ষমতাসীন হতে সমর্থ হয়।
পার্টির ক্ষমতার দ্বিতীয় পালা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে, যখন জনতা দলের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ফ্রন্ট জোট ক্ষমতায় আসে, সীতারাম কেশরীর অধীনে কংগ্রেসের বাইরের সমর্থনে এইচডি দেবগৌড়াকে তাদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেয়। বিভিন্ন ইউনাইটেড ফ্রন্ট সাংবিধানিক গোষ্ঠীর সমর্থনে ক্ষমতা লাভের আশায় কংগ্রেস এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে এবং আই কে গুজরাল পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন। তার সরকারও কয়েক মাসের মধ্যে পতন ঘটে এবং ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জনতা দলের নেতৃত্বাধীন জোট ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে ক্ষমতা হারায়। এভাবেই একটি প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী দলের পতন ঘটে।
আরো পড়ুন
- বিজেপি ভারতের জনগণ, গণতন্ত্র ও মানবতা বিরোধী সংগঠন
- জনতা দল ছিল ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল
- যুগান্তর দল বা যুগান্তর সমিতি ছিল বাংলার গোপন বিপ্লববাদী সংস্থা
- অনুশীলন সমিতি ছিল বাংলার বিপ্লববাদী রাজনৈতিক সংগঠন
তথ্যসূত্র
১. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ১১০-১১১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।