শ্রেণি উদ্ভব হবার কারণ ও বিলুপ্তি প্রসঙ্গে মার্কসবাদ

শ্রেণি উদ্ভব বা সামাজিক শ্রেণি কী এবং কেমন করে তার উদ্ভব হলো, এ নিয়ে মানুষে ভেবেছে অনেক আগে থেকেই। শোষকেরা প্রচার করে যে শ্রেণি সর্বদাই ছিলো এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এইসব ভাববাদী কথা বলেই শোষকেরা জনগণকে দাবিয়ে রাখতে চায়।

শ্রেণি বিকাশের অভিজ্ঞতা বিচার করে শ্রেণির মর্মার্থ, তার উদ্ভবের কারণ ও বিলুপ্তির পথ নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক মীমাংসা দেয় মার্কসবাদ। শ্রেণির অস্তিত্বকে মার্কস সংশ্লিষ্ট করেছেন সামাজিক উৎপাদন বিকাশের সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্যায়গুলির সংগে। তাঁর পূর্ববর্তী বুর্জোয়া বিজ্ঞানীরা সেটা করেননি। বুর্জোয়া বিজ্ঞানীদের কাছে শ্রেণি ছিলো ইতিহাসের সংগে সম্পর্কহীন। ইতিহাসের দিক থেকে শ্রেণিসমাজের উত্তরণমূলক চরিত্র নিরূপণ করেন মার্কস। তিনি দেখান কী কারণে এবং কখন শ্রেণি সমাজকে বিলুপ্ত হতে হবে, তার জায়গায় আসতে হবে শ্রেণিহীন সমাজ। তিনি দেখান যে পুঁজিবাদী সমাজ হলো মানবজাতির ইতিহাসে বৈরি শ্রেণি নিয়ে গঠিত শেষ সমাজ। আর শ্রেণিহীন সমাজের পথ গেছে সমস্ত ধরনের পীড়নের বিরুদ্ধে, সমস্ত মেহনতির স্বার্থরক্ষক নিজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রলেতারিয়েতের শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে।

শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে মার্কস ও এঙ্গেলস আবিষ্কার করেন সেই প্রধান শক্তিকে যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে শ্রেণিহীন শোষণহীন সমাজ গড়তে সক্ষম।

শ্রেণি পুঁজিবাদেই সর্বাপেক্ষা স্পষ্ট হয়। অন্য সমাজের শ্রেণিরূপ অবশ্য মার্কস-এঙ্গেলসও বিশদ ব্যাখ্যা করেননি। পুঁজিবাদেও মধ্যবর্তী স্তরগুলি শ্রেণিরূপকে ঝাপসা করে দেয়। তবে পুঁজিবাদ যে উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলে সেখানে বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েতের অবস্থা স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। তা সত্ত্বেও এখানে শ্রেণিচেতনা সব সময় বোধের মধ্যে থাকে না। কেবল লড়াই দেখা দিলেই আত্ম-অস্তিত্বের স্বরূপ উপলব্ধি হয়। তখন মানুষের ইতিহাসকে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস বলা হয়। পরে এঙ্গেলস বলেন, ‘এযাবৎ বিদ্যমান সব সমাজের লিখিত ইতিহাস হলও শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস’[১]।

অতীতে সংঘর্ষে ও বিদ্রোহে শ্রেণিরূপের সাথে পদমর্যাদার দ্বন্দ্ব, নানা সামাজিক স্তর ও বর্গের অবস্থানের মধ্যে জটিলতা নানাভাবে অবস্থান করেছে। ধনী আর দরিদ্র, শোষক আর শোষিতে বিভাগটা হলও শ্রেণির বিভাগ। শ্রেণি বলা হয় লোকেদের তেমন ভাগাভাগিকে যাতে উৎপাদনের উপায়ের সংগে বিভিন্ন সম্পর্কের কারণে একদল লোক অন্য দলের পরিশ্রম হস্তগত করে।

শ্রেণি কী সর্বদাই ছিলো এবং থাকবে? একসময় শ্রেণি ছিলই না। আদিম ব্যবস্থায় লোকে থাকত কৌমে, গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে। সবারই ছিলো সমান অধিকার। শ্রম ছিল সাধারণ, মালিকানাও সাধারণ। যা আহরণ করা হতো তাতে থাকত সবারই সমান অধিকার, বণ্টন হতো সমান সমান। তবে অর্থ-সম্পদের বিকাশ ছিল খুবই নিচু, তাতে খেয়ে দেয়ে থাকা চলত নেহায়েত কোনোক্রমে। এই পরিস্থিতিতে অন্যের ঘাড় ভেঙে থাকা, অন্যকে শোষণ করা ছিল অসম্ভব।

আবার ভবিষ্যতের সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণিভেদ লোপ পাবে। লেনিনের একবার একটা প্রতিবেদন দেবার কথা ছিলো। প্রেক্ষাগৃহে দেখলেন, টাঙানো আছে শ্লোগান ‘শ্রমিক ও কৃষকদের রাজত্বের শেষ নেই’। এ ধ্বনির ভ্রান্তিটা তিনি শ্রোতাদের বোঝান। বলেন শ্রেণি হিসেবে নিজেদের চিরন্তন করে রাখা শ্রমিকদের কাজ নয়, শ্রেণিভেদ দূর করে তাদের গড়তে হবে শ্রেণিহীন সমাজ— কমিউনিজম।[২]

এবার প্রশ্ন কীভাবে আর কখন দেখা দিলো শ্রেণি? শ্রেণিহীন আদিম কৌম সমাজব্যবস্থা টিকে ছিলো বহু হাজার বছর ধরে, তার ভেতর উৎপাদনী শক্তির বিকাশ অতি ধীরে ধীরে হলেও এগিয়ে চলছিলো অবিচলভাবে। সেই অনুসারে বদলাতে থাকে আদিম সমাজের গোটা জীবনধারাও। দেখা দিতে থাকলো স্তরভেদ। একদল ধনী হয়ে উঠতে থাকল, নিজেদের মালিকানায় হস্তগত করলো জমি, পশুপাল, উৎপাদনের উপায়; আর অন্যদল সম্পত্তিহীনেরা বাধ্য হলও ধনীদের জন্য খাটতে, পরিণত হলও দাসে। ব্যক্তিগত মালিকানা দেখা দেবার সংগে সংগে গড়ে ওঠে শ্রেণি। সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে প্রভু আর দাস, নিপীড়ক আর নিপীড়িত শ্রেণিতে, অর্থাৎ দুটি শত্রুদলে। আর এই শত্রুদলেরা মিলেই গড়ে ওঠে একটি নির্দিষ্ট সমাজ। সমাজের ভিতরকার দ্বন্দ্ব-মিলের গতিধারা হচ্ছে সমাজের প্রবহমানতা। এই শ্রেণিসংগ্রামই শ্রেণিকে বিলুপ্ত করবে। শ্রেণিচেতনার অবসান হলেই দেখা দেবে মানবচেতনা।

প্রতিটি শ্রেণিকে দেখতে হবে উৎপাদনের উপায়ের যে প্রণালী থেকে তাদের জন্ম তার সংগে জড়িত করে। তার অর্থ, উৎপাদনের প্রতিটি বৈরগর্ভ সমাজে নিজেদের মধ্যে সংগ্রামরত দুটি প্রধান বিপরীত শ্রেণি তাদের পক্ষে নবজাত বৈশিষ্ট্যসূচক শ্রেণিতে ভেঙে যায়; যেমন দাস সমাজে প্রভু আর দাস, সামন্ত সমাজে সামন্ত এবং অধীনস্থ কৃষক, পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতি আর প্রলেতারিয়েত বিভক্ত হয়ে যায়। এ থেকে দাঁড়ায় যে শ্রেণির প্রকৃতি ও মর্মার্থ সঠিকভাবে বুঝতে হলে কোনো একটা সুনির্দিষ্ট সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংগে তার সম্পর্ক দৃষ্টিচ্যুত করা চলে না।

উৎপাদনের উপায়ের সংগে সম্পর্ক থেকেই নির্ধারিত হয়ে যায় শ্রমের সামাজিক সংগঠনে শ্রেণির ভূমিকা এবং সামাজিক সম্পদ পাবার উপায় ও পরিমাণ। এই প্রসঙ্গে ভি. আই. লেনিন লিখেছেন,

“শ্রেণিদের মধ্যে পার্থক্যের মৌল লক্ষণ হলো সামাজিক উৎপাদনে তাদের স্থান, সুতরাং উৎপাদনের উপায়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে।”[৩]

প্রতিটি শ্রেণির থাকে উৎপাদনের উপায়ের সংগে সুনির্দিষ্ট নিজস্ব সম্পর্ক। বৈরি সমাজে একদল উৎপাদন চালায়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যাপারগুলো পরিচালনা করে, ব্যাপৃত থাকে প্রধানত মননধর্মী শ্রমে। অন্য শ্রেণিরা বাধ্যতামূলক গুরুভার কায়িক শ্রম চালায়। এসব লক্ষণ দিয়েই পার্থক্য করা যায় শ্রেণি আর অন্যান্য সামাজিক গ্রুপের মধ্যে যারা শ্রেণি নয়। যেমন, উৎপাদনের উপায়ের সাথে বুদ্ধিজীবীদের নিজস্ব কোনো সম্পর্ক নেই, তাই তারা শ্রেণি নয়, বুদ্ধিজীবীরা হলও বিভিন্ন শ্রেণির অংশবিশেষ নিয়ে একটা সামাজিক স্তর।

শত্রুশ্রেণিতে সমাজ বিভক্ত হয়ে যাবার পর থেকে সমাজতন্ত্রের বিজয় অবধি মানবজাতির গোটা ইতিহাস হলও নিপীড়িত আর নিপীড়কদের মধ্যে নির্মম সংগ্রামের ইতিহাস। নিপীড়িত শ্রেণি লড়ে তাদের মুক্তির জন্য। নিপীড়করা তাদের সম্পদ আর ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হতে অনিচ্ছুক। নিপীড়িতদের আরো দাসত্বে বাঁধার জন্য তারা চেষ্টা করে, নিজেদের প্রভুত্ব আরো দৃঢ় করার জন্য তারা লড়ে। মার্কস ও এঙ্গেলস লিখেছেন,

“মুক্ত মানুষ ও দাস, প্যাট্রিসিয়ান ও প্লিবিয়ান, জমিদার ও ভূমিদাস, গিল্ডকর্তা ও কারিগর, এককথায় নিপিড়ক ও নিপীড়িত শ্রেণিরা পরস্পরের প্রতি নিরন্তর প্রতিপক্ষ থেকেছে, এক অবিরাম লড়াই চালিয়েছে, কখনো গোপনে বা কখনো প্রকাশ্যে; আর সে লড়াই প্রত্যেকবারই শেষ হয়েছে হয় গোটা সমাজেরই এক বিপ্লবী পুনর্গঠনে অথবা দ্বন্দ্বরত শ্রেণিগুলোর সার্বিক ধ্বংসে।…

সামন্ত সমাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে আধুনিক যে বুর্জোয়া সমাজ জন্ম নিয়েছে তার মধ্যে শ্রেণিবিরোধ শেষ হয়ে যায়নি। এ সমাজ শুধু প্রতিষ্ঠা করেছে নতুন শ্রেণি, অত্যাচারের নতুন অবস্থা পুরাতনের বদলে সংগ্রামের নতুন ধরন।

আমাদের যুগ অর্থাৎ বুর্জোয়া যুগের কিন্তু একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে, শ্রেণিবিরোধ এতে সরল হয়ে এসেছে। গোটা সমাজ ক্রমেই দুটি বিশাল শত্রুশিবিরে ভাগ হয়ে পড়েছে, ভাগ হচ্ছে পরস্পরের সম্মুখীন দুই বিরাট শ্রেণিতে — বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েতে।”[৪]

শোষণমূলক ব্যবস্থায় শ্রেণিসমূহের মধ্যে সংগ্রাম হচ্ছে সমাজ বিকাশের নিয়ম, সামাজিক অগ্রগতির পরাক্রান্ত চালিকা শক্তি। সমাজ বিবর্তনের একটা পর্যায়ে শ্রেণিসংগ্রাম অনিবার্যভাবে সমাজবিপ্লবে পর্যবসিত হয়। সমাজবিকাশের জরুরি কার্য সম্পাদনে বৈপ্লবিক শ্রেণিসংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই।শোষিত শ্রেণিগুলোর বৈপ্লবিক সংগ্রাম পুরনো অচল হয়ে পড়া ব্যবস্থা পরিষ্কার করে নতুন বিকাশমান ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করে।শ্রেণিসংগ্রামের রূপ শ্রেণি সংগঠনের রূপের সংগে সংশ্লিষ্ট যা বিশেষ জাজ্বল্যমানরূপে দেখা যেতে পারে প্রলেতারিয়েতের শ্রেণিসংগ্রামের দৃষ্টান্ত থেকে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েত সংগ্রাম চালায় তিনটি প্রধান রূপে যেগুলো হচ্ছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শীয়। এই তিনটি রূপের শ্রেণিসংগ্রাম চালাতে গিয়ে প্রলেতারিয়েত তৈরি করে তাদের অগ্রগামি সংগ্রামী পার্টি যা দেশে দেশে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েমের মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজের প্রথম স্তর সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ চালাতে থাকে।[৫]

তথ্যসূত্র:

১. মার্কস-এঙ্গেলস; কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার; মার্চ-জুন, ১৮৪৮, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭২ পৃষ্ঠা ২৬
২. ভি. আই. লেনিন; সম্পূর্ণ রচনাবলী; খণ্ড-৪৩, পৃষ্ঠা-১৩০, গৃহীত অংশটুকু নেয়া হয়েছে ভ. বুজুয়েভ ও ভ. গরোদনভ রচিত মার্কসবাদ লেনিনবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৯৩ থেকে।
৩. V. I. Lenin, ‘Vulgar Socialism and Narodism as Resurrected by the Socialist-Revolutionaries’, Collected Works, Vol. 6, Progress Publishers, Moscow, 1977, P. 262-263
৪. মার্কস-এঙ্গেলস; কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, ১৮৪৮, মার্কস-এঙ্গেলস রচনা সংকলন, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭২ পৃষ্ঠা ২৬, ২৭।
৫. এই নিবন্ধটির বেশিরভাগ অংশের ধারণা নেয়া হয়েছে ভ. বুজুয়েভ ও ভ. গরোদনভ রচিত মার্কসবাদ লেনিনবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৯১-৯৫ এবং আ. ইয়ের্মাকোভা ও ভ. রাত্নিকভ রচিত শ্রেণি ও শ্রেণিসংগ্রাম, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা২১-২৪ থেকে। উল্লেখ্য প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] লিখিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত মার্কসবাদ গ্রন্থের ৯০-৯৫ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরে ডট কমে ১৩ আগস্ট ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত। সেখান থেকে লেখাটি ১৩ জুলাই ২০২২ তারিখে ফুলকিবাজ ডট কমে পুনরায় প্রকাশ করা হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!