দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উৎস ও চরিত্র

৯ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬

[১৯৪৬ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি, সুপ্রীম সোভিয়েতের নির্বাচনের সময় তাঁর জেলার ভোটারদের উদ্দেশ্যে এক বক্তৃতা থেকে।]

এটা ভাবা ভুল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হঠাৎ ঘটে গেছে বা কোনও কূটনীতিজ্ঞর ভুলের জন্য এই যুদ্ধ বেধেছে। অবশ্য ভুল যে হয় না তা নয়। বাস্তবে, আধুনিক একচেটিয়া পুঁজির বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতেই এই যুদ্ধ বেধেছে। মার্কসবাদীরা একাধিকবার ঘোষণা করেছে পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সাধারণ সংকট ও সশস্ত্র সংঘর্ষের জন্ম দেয়। তাই আমাদের সময়ে পুঁজিবাদের বিকাশ মসৃণভাবে ঘটে না, একই গতিতে ঘটে না। এই বিকাশ ঘটে সংকটের মধ্য দিয়ে, সামরিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে।

পুঁজিবাদী দেশগুলোর অসম বিকাশ সময় সময় পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার ভারসাম্যে বিপর্যয় ডেকে আনে। এটাই হলো ঘটনা। যে সমস্ত পুঁজিবাদী দেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় বাজার ও কঁচামালের ক্ষেত্রে নিজেদের বঞ্চিত মনে করে সাধারণত তারা পরিস্থিতির পরিবর্তন করার চেষ্টা করে এবং সামরিক শক্তির সাহায্যে নিজের পক্ষে “প্রভাবাধীন ক্ষেত্রের” পুনর্বিন্যাস করতে চায়। এর ফল হলো পুঁজিবাদী দুনিয়া শত্রুভাবাপন্ন দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে যুদ্ধ বাধে।

চুক্তি ও শান্তিপূর্ণ ভাগবাটোয়ারার দ্বারা শক্তি অনুযায়ী যদি বিভিন্ন দেশের মধ্যে কাঁচামাল ও বাজার মাঝে মাঝে আবার ভাগবাটোয়ারা করা যায় তাহলে হয়তো সামরিক বিপর্যয় এড়ানো যেতে পারে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান পুঁজিবাদী পরিস্থিতিতে তা করা অসম্ভব।

এইভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির প্রথম সংকটের ফল আর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫) হলো দ্বিতীয় সংকটের ফল।

এর অর্থ এ নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিলিপি। এর বিপরীতে চরিত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্ভবত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে আলাদা। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে মিত্রশক্তিকে আক্রমনের আগে প্রধান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র – জার্মানি, জাপান, ইটালি – দেশের মধ্যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার শেষ চিহ্নকেও ধ্বংস করেছিল, নিজেদের দেশে পাশবিক সন্ত্রাসবাদী রাজত্ব কায়েম করেছিল, ছোট ছোট দেশের স্বাধীন বিকাশ ও সার্বভৌমত্বের নীতির মূলে কুঠারাঘাত করেছিল, অন্য দেশের ভূখণ্ড গ্রাস করার নীতিকে নিজেদের নীতি বলে ঘোষণা করেছিল। আর সবাইকে শুনিয়ে ঘোষণা করেছিল দুনিয়া জুড়ে ফ্যাসিবাদী রাজত্ব কায়েম করার জন্য ও দুনিয়ার উপর প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য তারা অগ্রসর হয়েছে।

আরো পড়ুন

এ ছাড়াও চেকোশ্লোভাকিয়া ও চীনের মধ্যাঞ্চল দখল করে অক্ষ শক্তি দেখিয়ে দিয়েছে, সমস্ত স্বাধীনতাপ্রেমী জাতিকে দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করার হুমকিকে তারা কাজে পরিণত করতে প্রস্তুত। এই প্রেক্ষিতে, প্রথম মহাযুদ্ধের মত না হয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ প্রথম থেকেই অক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধের চরিত্র গ্রহণ করেছিল, গ্রহণ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র। এই যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা। অক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশগ্রহণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফ্যাসিবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চরিত্রকে শক্তিশালী করেছিল এতে কোনও সন্দেহ নেই।

এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন এবং অন্যান্য স্বাধীনতাকামী রাষ্ট্রের জোট গড়ে উঠেছিল। এই জোট পরবর্তীকালে অক্ষ শক্তির সামরিক শক্তিকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উৎস ও চরিত্রের এই হলো অবস্থা।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: যোসেফ স্তালিনের এই লেখাটি “Origin and Character of the Second World War” লেখাটির বঙ্গানুবাদ। বাংলা লেখাটি প্রথমে রোদ্দুরে ডট কমে ২১ আগস্ট ২০২০ তারিখে প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে লেখাটি হুবহু ফুলকিবাজ ডট কম প্রকাশ করছে ১৬ আগস্ট ২০২৩ তারিখে। লেখাটির মূল উৎস হচ্ছে, জে ভি স্ট্যালিন নির্বাচিত রচনাবলী চতুর্থ খন্ড, প্রমিথিউস পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ মে ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৭৫-২৭৬ থেকে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!