সাম্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (ইংরেজি: Origin and evolution of equality) হচ্ছে সাম্য ধারনাটির বিকাশের ধারাবাহিক ইতিহাস। সাম্য একটি প্রাচীন ধারণা। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ন্যায়ের মতোই সাম্যের অর্থবিচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রতাত্ত্বিকেরা দ্বিধাবিভক্ত। অতীতে পিথাগোরিয়ান সমষ্টিভাবনায় পারস্পরিক সহযোগিতা, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার যে ভাবনা ছিল তা সমতার ভাবধারাকে প্রতিফলিত করেছে।
সাম্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত ইতিহাস
প্রাচীন ভারতে বুদ্ধ (Buddha), মোৎসজি (Motsaji), পারস্যে জরাথুস্ত্র (Jarathustra) বা গ্রিসে সফিস্ট ভাবনায় সাম্যের বাণী ছিল। সাম্যের প্রশ্নে সমস্ত লোক জন্মসূত্রে স্বাধীন এবং স্বর্গীয় (ঐশ্বরিক) সম্পর্কে সমান এই ভাবনা চিনে প্রচার করেন মোৎসর্জি। বুদ্ধের চিন্তায় সাম্যভাব প্রচার পেয়েছে অষ্টমার্গের নৈতিক-আত্মিক ভাবনায়। জরাথুস্ত্র শিখিয়েছেন পারস্পরিক ভালোবাসা, ক্ষমা ও শান্তিতে থাকতে।
প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্র: গ্রিসে সফিস্ট ভাবনা অনুসারে সাম্যের কথা শুনিয়েছেন প্রোট্যাগোরাস, তাঁর মতে, মানুষ নিজেই সব কিছুর পরিমাপক (Man is the measure of all things)। সফিস্ট ভাবনার অন্যান্য আদি পথিকৃৎ হলেন জর্জিয়াস (Gorgias), প্রডিকাস (Prodicus), অ্যান্টিফন (Antiphon) এবং পরবর্তী প্রজন্মের সফিস্ট হিসাবে পরিচিত কালিক্লিস (Callicles), গ্লসিমেকাস প্রমুখ। এথেন্সের রাজনৈতিক আলোকবর্তিকার অগ্রদূত সফিস্টরা বিশ্বাস করেছেন, প্রত্যেক শ্রেণির মধ্যেই আছে বিশেষ গুণ (জর্জিয়াস)। শ্রম ও দায়িত্বশীলতা, গুণেই সামাজিক প্রগতির সন্ধান পাওয়া যাবে (প্রডিকাস)। আইন ও রাজনীতির অসম ও কর্তৃত্বপরায়ণ প্রবণতার নিন্দা করেন গ্লাসিমেকাস।
রোম: মধ্যযুগে সিসেরোর (Cicero) ভাবনায় সমতার ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে। সিসেরোর মতে, ভুলভ্রান্তি, কু-অভ্যাস ও মিথ্যা মতামত দ্বারা পরিচালিত হলেই মানুষের মধ্যেই সমতাবোধ বাধাপ্রাপ্ত হয়। প্রাকৃতিক আইনের (Jus Naturale) পেছনে ঈশ্বরের ইচ্ছা প্রাধান্য পেলেও সিসেরো এর পেছনে দেখেন মানুষের উপলব্ধি ও সমাজমুখী মন। প্রত্যেক মানুষ এবং প্রত্যেক জাতিভুক্ত মানুষ নিজের বিচারবুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা অনুসারে ভালো মন্দ বুঝতে সমর্থ। একের ‘অপরের উপর প্রভুত্বের নীতি প্রকৃতিবিরুদ্ধ’।
সিসেরো সমতার যে অর্থ বা নীতি প্রচার করেছেন সেখানে (ক) সমতা হলো নৈতিক প্রয়োজন; (খ) প্রাকৃতিক আইন এই নৈতিক প্রয়োজনকে স্বীকার করে; (গ) নাগরিক অধিকার পাবার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে ভেদনীতি বাঞ্ছনীয় নয়; (ঘ) প্রাকৃতিক আইনের চোখে সব মানুষ, জাতি সমান এবং সহযোগিতা ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ।
পুঁজিবাদী সমাজ: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় জন লক, জ্যাঁ জ্যাক রুশো, জেরেমি বেনথাম, হবহাউস, বার্কার, হ্যারল্ড ল্যাস্কি সকলের ভাবনায় সাম্যের কথা এসেছে। লক বলেছেন, প্রাকৃতিক নিয়ম সমস্ত মানুষের জন্য দাবি করে শান্তি ও নিরাপত্তা। স্বাভাবিক অবস্থা হলো ‘সমতার অবস্থা যেখানে সমস্ত ক্ষমতা ও সমস্ত আইন পারস্পরিক, কেউ কারোর চেয়ে বেশি পাচ্ছে না। (Selected Philosophical Writings, John Locke, P-7-8)
রুশো মনে করেন, আদিম অবস্থায় অর্থাৎ অস্তিত্বের প্রথম পর্বে মানুষ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যেই ছিল। কিন্তু জ্ঞান ও শিল্পকলার সূচনা, সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই সুখ রইল না। সমতা অন্তর্ধান করলো। মানুষের জীবনে শ্রম আর সম্পত্তির আবির্ভাবের হাত ধরেই এল দাসত্ব ও দারিদ্র। রুশো মনে করেন, সম্পত্তিতে ‘আমার তোমার’ ভাবনা থেকেই দেখা দিল অসাম্য। রুশো যখন বলেন ‘মানুষ জন্মেই স্বাধীন কিন্তু সর্বত্র শৃঙ্খলে আবদ্ধ’ (Man is born free but everywhere he is in chains) তখন তিনি এটাই বোঝাতে চাইলেন নতুন সমাজ ও তার আইন দুর্বলের পক্ষে শৃঙ্খল আর ধনীর পক্ষে ক্ষমতা। (Rousseau : Social Contract) বেনথাম সাম্যের ব্যবস্থা হিসাবে ‘বহুজনের হিতসাধনের বাণী’ শোনালেন। হবহাউস সমতার পরিবেশ আবিষ্কার করেন মানুষের নৈতিক ও মানবিক ভাবনার বিকাশে, সমাজ বন্ধনের মধ্যে।
আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম: সাম্যের মর্মবাণীটি উদ্ধার করা যায় ১৭৭৬ সালে ঘোষিত আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণায়? ‘সব মানুষের সৃষ্টি সমানভাবে এবং তাদের দেওয়া হয়েছে কিছু অপ্রত্যর্পণযোগ্য অধিকার’ (১৭৭৬ সালের স্বাধীনতার ঘোষণা)। ১৭৮৯ সালে ফরাসি মানবিক ও নাগরিক ঘোষণায় প্রায় একই কথা বলা হলো: সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবেই জন্মেছে এবং মর্যাদায় ও অধিকারে তারা সমান।
ঊনবিংশ শতকেই সাম্যের ভাবনা রীতিমত প্রচারে আসে এবং সাম্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত পাঠ শুরু হয়। সমতা বা সাম্যের প্রশ্নে সাধারণভাবে যে সব অর্থ উঠে আসে তা হলো: (১) অধিকার, স্বাধীনতা, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, ভালবাসা, মানবতা, ন্যায়ের গুণাবলি সমতার মধ্যে আছে। (২) সমতা বহুমাত্রিক ধারণা। ধারণাগত বৈষম্য থাকলেও এর মূল কথা হলো সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া এবং প্রতিটি মানুষকে তার নিজেকে উপলব্ধি করার ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। সাম্যের পরিস্থিতিতেই স্বাধীনতার প্রকৃত উপলব্ধি সম্ভব। (৩) ইতিবাচক অর্থে সাম্য হলো সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগের ব্যবস্থা। নেতিবাচক অর্থে সাম্য হলো বিশেষ সুবিধার অনুপস্থিতি। কার্ল মার্কস থেকে হ্যারল্ড লাস্কি সকলেই সমতার দর্শনের আধুনিক প্রচারক।[১]
তথ্যসূত্র
১. দেবাশীষ চক্রবর্তী, রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়সমূহ, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ৪৭-৪৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা উনিশটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।