সি. পি. এস. ইউ [বি]-তে দক্ষিণ বিচ্যুতি
সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের প্রশ্নে বুখারিন গ্রুপের দক্ষিণ-বিচ্যুতির বিরুদ্ধে স্তালিনের সংগ্রাম
১. এক লাইন, না দুই লাইন?
[One Line or Two Lines]
আমাদের লাইন কয়টি—একটি একক, অভিন্ন ও সাধারণ লাইন, না দু’টি লাইন ? কমরেডগণ, এটাই হলো মূল প্রশ্ন।
রাইকোভ তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন যে, আমাদের একটিমাত্র সাধারণ লাইন রয়েছে, আর আমাদের যদি “তুচ্ছ” কোনো মত-পার্থক্য থেকেই থাকে, তাহলে তার কারণ হলো সাধারণ লাইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে রয়েছে “ছোটখাট মতের অমিল” (shades of differences)।
একথা কি যথার্থ? দুর্ভাগ্যজনকভাবেই ঘটনা তা নয়। আর এটা যে নিছক অযথার্থ তাই নয়, বরং তা হলো সত্যেরও সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যদি সত্যিই কেবল একটিমাত্র লাইনই আমাদের থাকে, আর আমাদের মধ্যে থেকে থাকে ছোটখাট মতেরই অমিল তাহলে কামেনেভ কর্তৃক পরিচালিত বিগত সময়ের ট্রট্স্কীপন্থীদের সাথে কেন্দ্রীয় কমিটি ও তার রাজনৈতিক ব্যুরোর বিরুদ্ধে পরিচালিত উপদলীয় জোট গঠনের প্রচেষ্টায় বুখারিন কেন ধাবিত হয়েছেন? এটা কি একটা বাস্তব সত্য নয় যে, বুখারিন সেখানে কেন্দ্রীয় কমিটির “সর্বনাশা” লাইন সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে বুখারিন, টম্স্কি ও রাইকভের নীতিগত মত-পার্থক্যের ব্যাপারে, কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোর গঠন-বিন্যাসের ক্ষেত্রে গুরুতর পরিবর্তন সাধনের আবশ্যকতার ব্যাপারে বক্তব্য রেখেছেন ?
যদি একটিমাত্র লাইনই থেকে থাকে, তাহলে কেন্দ্রীয় কমিটির বিরুদ্ধে, বিগত সময়ের ট্রটস্কিপন্থীদের সাথে, বুখারিন কেন চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন, আর কেনই-বা রাইকভ ও টম্স্কি এই আরাধ্য-কর্মে তাঁকে সাহায্য করছেন?
যদি একটিমাত্র সাধারণ লাইনই থেকে থাকে, তাহলে রাজনৈতিক ব্যুরোর যে অংশটি একক, অভিন্ন ও সাধারণ লাইনকে সমর্থন করে সেই অংশকে কিভাবে অন্য যে অংশটি সেই একই সাধারণ লাইন সমর্থন করে সে অংশের বিশ্বস্ততা ধ্বংস করার অনুমোদন দেয়া যায়?
যদি আমাদের একটি একক অভিন্ন ও সাধারণ লাইনই থেকে থাকে তাহলে এরূপ অবস্থান পরির্তনের নীতিকে কি অনুমোদন দেয়া যায়?
যদি একটিমাত্র লাইনই থেকে থাকে, তাহলে বুখারিনের ৩১ জানুয়ারির ঘোষণাকে আমরা কিভাবে বিচার করতে পারি, যে ঘোষণাটি ছিল পুরোপুরিভাবে ও এককভাবে কেন্দ্রীয় কমিটি ও তার সাধারণ লাইনের বিরুদ্ধে পরিচালিত?
যদি একটিমাত্র লাইনই থেকে থাকে, তাহলে তিন ব্যক্তির (বুখারিন, রাইকভ ও টমস্কির ) ৯ই ফেব্রুয়ারির ঘোষণাকে আমরা কিভাবে বিচার করতে পারি, যে-ঘোষণায় ন্যাক্কারজনক ও মারাত্মক কুৎসাপূর্ণ পদ্ধতিতে তাঁরা পার্টির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন: (ক) কৃষকদের উপর সামরিক-সামন্ততান্ত্রিক শোষণের নীতি, (খ) আমলাতন্ত্রকে লালন-পালনের নীতি, এবং (গ) কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিককে খণ্ড-বিখণ্ড করার নীতি অনুসরণের জন্যে?
বোধ হয় এসব ঘোষণা খুব প্রাচীন ইতিহাসের অন্তর্ভূক্ত? বোধ হয় এখন এটা মনে করা হচ্ছে যে এসব ঘোষণা ছিল একেকটি ভুল? বোধ হয় রাইকভ, বুখারিন ও টমস্কী এসব সন্দেহাতীতভাবেই ভ্রান্ত ও পার্টি-বিরোধী ঘোষণা প্রত্যাহার করে নিতে প্রস্তুত? যদি ঘটনা তাই হয়ে থাকে, তাহলে সরলভাবে ও সততার সাথে তাঁরা সেটা বলুন। তাহলেই প্রত্যেকে বুঝতে পারবে যে আমাদের লাইন কেবল একটাই এবং আমাদের মধ্যে কেবল আছে ছোটখাট মতেরই অমিল। কিন্তু, বুখারিন, রাইকভ ও টমস্কীর বক্তৃতা থেকে এটা স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান যে, তাঁরা তা করবেন না। আর তারা যে তা করবেন না তাই নয়, বরং ভবিষ্যতেও তাঁদের এসব ঘোষণাকে প্রত্যাখান করার কোনো ইচ্ছা তাঁদের নেই, এবং তাঁরা বলেছেন যে, ঘোষণাগুলিতে উপস্থাপিত তাঁদের মতামতের প্রতি তাঁরা অনুগত।
তাহলে একক, অভিন্ন ও সাধারণ লাইন রইলো কোথায়?
যদি একটিমাত্র লাইনই থেকে থাকে, আর বুখারিন গ্রুপের মতামত অনুযায়ী পার্টি লাইন হলো কৃষকদের উপর সামরিক-সামন্ততান্ত্রিক নীতির অনুসরণ, তাহলে সেটাকে প্রতিহত করার বদলে এই সর্বনাশা নীতি অনুসরণ করায় বুখারিন, রাইকভ ও টমস্কি কি আমাদের সাথে যোগ দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন? তা বাস্তবিকই অসম্ভব।
যদি একটিমাত্র লাইনই থেকে থাকে, আর বুখারিন নেতৃত্বাধীন ‘বিরোধী পক্ষের’ মতামত অনুযায়ী পার্টির লাইন হলো আমলাতন্ত্রের লালন-পালন, তাহলে সেটাকে প্রতিহত করার বদলে পার্টির অভ্যন্তরে আমলাতন্ত্রের লালন-পোষণে বুখারিন, রাইকভ ও টমস্কী কি আমাদের সাথে যোগ দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন? তা বাস্তবিকই একেবারে বাজে কথা।
যদি একটিমাত্র লাইনই থেকে থাকে, আর বুখারিন নেতৃত্বাধীন ‘বিরোধী পক্ষের’ মতে পার্টি লাইন হলো কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিককে খণ্ড-বিখণ্ড করা, তাহলে সে-নীতিকে প্রতিহত করার বদলে, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিককে খণ্ড বিখণ্ড করার কাজে বুখারিন, রাইকভ ও টমস্কি কি সত্যিই আমাদের সাথে যোগ দিতে চান? এসব বাজে কথা কিভাবেই-বা আমরা বিশ্বাস করতে পারি?
না, কমরেডগণ, আমাদের একটি একক, সাধারণ লাইন রয়েছে – রাইকভের এই সজোর উক্তির মধ্যে অবশ্যই কিছু গোলমেলে ব্যাপার আছে। যেভাবেই এটাকে দেখুন না কেন, বুখারিন গ্রুপের ঘোষণা ও আচরণ সম্পর্কে এইমাত্র উপস্থাপিত বাস্তব ঘটনাবলীকে আমরা যদি স্মরণে রাখি তাহলে একটিমাত্র, অভিন্ন লাইনের ব্যাপারে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে।
যদি একটিমাত্র লাইনই থেকে থাকে, তাহলে বুখারিন, রাইকভ ও টমস্কির দ্বারা অবলম্বিত পদত্যাগ করার কর্ম নীতিকে আমরা কিভাবে দেখব? এটা কি কল্পনাসাধ্য যে যেখানে একটি অভিন্ন সাধারণ লাইন রয়েছে সেখানে রাজনৈতিক ব্যুরোর একটি অংশ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির একের পর এক সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করতে সুসম্বদ্ধ ভাবেই অস্বীকার করেছে এবং ছয় মাস ধরে পার্টির কাজকর্মকে অব্যাহত ভাবে নস্যাৎ করেছে? যদি সত্যিই আমাদের একটি একক, অভিন্ন ও সাধারণ লাইন থেকে থাকে, তা হলে রাজনৈতিক ব্যুরোর একাংশ কর্তৃক পদ্ধতিপূর্ণভাবে যে পদত্যাগের নীতি অবলম্বিত হয়েছে সেই সংহতিনাশক কর্মনীতিকে আমরা কিভাবে বিচার করবো?
আমাদের পার্টির ইতিহাস থেকে পদত্যাগের নীতির বিভিন্ন উদাহরণ সম্পর্কে আমরা অবহিত আছি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানি যে, অক্টোবর বিপ্লবের ঠিক পরদিনই কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ-এর নেতৃত্বে কিছু কমরেড তাঁদেরকে প্রদত্ত পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং দাবি করেন যে পাটির কর্মনীতি পরিবর্তন করতে হবে। আমরা জানি যে, সে সময়ে আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যে নীতিটি ছিল এক অবিমিশ্র বলশেভিক সরকার গঠন করা সেই নীতির বিপরীতে মেনশেভিক ও সোশ্যালিষ্ট রেভলিউশনারীদের অন্তর্ভূক্ত করে একটি সংযুক্ত সরকার সৃষ্টির দাবী উপস্থিত করেই তাঁদের নীতিকে তাঁরা সঙ্গত প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়ে পদত্যাগের নীতির একটা অর্থ ছিল, কারণ তার ভিত্তি ছিল দুটি ভিন্ন লাইন, যার একটি ছিল এক খাঁটি বলশেভিক সরকার গঠন করা আর অন্যটি ছিল মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভলিউশনারীদের সাথে যৌথভাবে একটি কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সেটা ছিল সুস্পষ্ট ও বোধগম্য। কিন্তু, বুখারিন-পন্থী ‘বিরোধীপক্ষ’ যখন, একদিকে, সাধারণ লাইনের ঐক্যের কথা ঘোষণা করে, অন্যদিকে, অক্টোবর বিপ্লব কালে জিনোভিয়েভ ও কামেনেভ কর্তৃক অনুসৃত নীতি থেকে গৃহীত পদত্যাগের কর্মনীতি অবলম্বন করে তখন আমরা কোনো যুক্তি, কোনো ধরণের যুক্তিই খুঁজে পাই না।
হয় এটি, না হয় অন্যটি – হয় লাইন হলো কেবল একটি, যেক্ষেত্রে বুখারিন ও তাঁর বন্ধুদের পদত্যাগের নীতি হলো অবোধগম্য ও ব্যাখ্যার অসাধ্য; না হয় আমাদের রয়েছে দুই লাইন, যেক্ষেত্রে পদত্যাগের নীতি হলো পুরোপুরিভাবেই বোধগম্য ও ব্যাখ্যাযোগ্য।
যদি একটিমাত্র লাইন থেকে থাকে, তাহলে এই বাস্তব ঘটনাকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবো যে, যখন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রসঙ্গে ও কৃষক প্রশ্ন প্রসঙ্গে মূল থিসিসটি গৃহীত হয়, তখন রাজনৈতিক ব্যুরোতে ভোট গ্রহণ কালে, রাজনৈতিক ব্যুরোর ত্রয়ী সদস্য – রাইকভ, বুখারিন ও টমস্কী— বিরত থাকাটা সম্ভব মনে করলেন? এটা কি কখনও ঘটে যে, একটি একক সাধারণ লাইন রয়েছে কিন্তু আমাদের কমরেডদের এক অংশ আমাদের অর্থনৈতিক কর্মনীতির মূল মূল প্রশ্নে ভোট দান থেকে বিরত থাকছেন? না, কমরেডগণ, এরূপ বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটে না।
সর্বশেষে, যদি একটিমাত্র লাইনই থেকে থাকে, এবং আমাদের মধ্যে ছোট-খাট মতের অমিলই থেকে থাকে, তা হলে এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক ব্যুরোর একটি কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত আপোষ-সমঝোতাকে বুখারিনপন্থী বিরোধী পক্ষের কমরেডরা – বুখারিন, রাইকভ ও টমস্কি – কেন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন? এটাই কি বাস্তব ঘটনা নয়, যে-অন্ধ গলিতে বুখারিন গ্রুপ স্বয়ং ঢুকে পড়েছিলেন এই আপোষ প্রস্তাব সেখান থেকে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য পন্থায় বেরিয়ে আসার সুযোগ তাদের প্রদান করেছিল?
এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারীতে কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কতৃক প্রস্তাবিত এই আপোষ-সমঝোতার পাঠ হচ্ছে এইরূপ:
“কমিশনে মতামত বিনিময়ের পর এটা স্থির করা হয় যেঃ
১. বুখারিন স্বীকার করছেন যে, কামেনেভের সাথে তাঁর আপোষ মীমাংসাটা ছিল একটি রাজনৈতিক ভ্রান্তি,
২. বুখারিন স্বীকার করেছেন যে, ১৯২৯ সালের ৩০ জানুয়ারী তাঁর ‘ঘোষণায়’ অন্তর্ভুক্ত দাবীগুলো, যাতে অভিযোগ করা হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় কমিটি বাস্তবে অনুসরণ করছে ‘কৃষকদের উপর সামরিক-সামন্ততান্ত্রিক শোষণের’ নীতি, কেন্দ্রীয় কমিটি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিককে খণ্ড-বিখণ্ড করছে এবং পার্টির অভ্যন্তরে আমলাতন্ত্রকে লালন-পালন করছে — এই সমস্ত দাবীগুলোই উত্তেজনার মুহূর্তে, আবেগচালিত বিতর্ককালে করা হয়েছে, তিনি আর এসব দাবী পোষণ করেন না, এবং মনে করেন যে, এসব প্রশ্নে তাঁর ও কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে কোনো মত পার্থক্য নেই;
৩. সুতরাং বুখারিন স্বীকার করছেন যে, রাজনৈতিক ব্যুরোতে সমন্বয়পূর্ণ কাজ করা সম্ভব ও আবশ্যক;
8. ‘প্রাভদা’ ও ‘কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক’ উভয় ক্ষেত্রে বুখারিন তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করছেন;
৫. ফলশ্রুতিস্বরূপ, বুখারিন তাঁর ৩০ জানুয়ারির ঘোষণা প্রত্যাহার করছেন।
উপরোক্ত ভিত্তিতে, বুখারিনের ভ্রান্তিগুলোর একটি রাজনৈতিক মূল্যায়ন সম্বলিত খসড়া প্রস্তাবটি রাজনৈতিক ব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের প্রেসিডিয়ামের যৌথ সভায় উপস্থিত না করাটা সম্ভব বলে কমিশন মনে করছে এবং প্রস্তাব করছে যে, রাজনৈতিক ব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের প্রেসিডিয়ামের যৌথ সভা বর্তমান সমস্ত দলিলগুলো (বক্তৃতার আক্ষরিক রিপোর্ট, ইত্যাদি) প্রচার করা প্রত্যাহার করুক।
কমিশন প্রস্তাব করছে যে, রাজনৈতিক ব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের প্রেসিডিয়াম ‘প্রাভদার’ প্রধান সম্পাদক হিসেবে এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নির্বাহী কমিটির সম্পাদক হিসেবে তাঁর স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনার জন্য আবশ্যক সার্বিক পরিবেশ বুখারিনকে প্রদান করুক”।
যদি প্রকৃতই আমাদের একটিমাত্র লাইনই থেকে থাকে এবং যদি আমাদের মধ্যে থেকে থাকে ছোটখাট মতেরই অমিল, তাহলে কেন বুখারিন ও তাঁর বন্ধুরা এই আপোষ-সমঝোতাকে প্রত্যাখ্যান করলেন? এটাই কি অত্যস্ত স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান নয় যে, পার্টির অভ্যন্তরে বিরাজমান উত্তেজনার পরিসমাপ্তি যাতে ঘটান যায় এবং রাজনৈতিক ব্যুরোর কাজ-কর্মের ক্ষেত্রে ঐকমত্য ও সামঞ্জস্যতার পক্ষে সঙ্গতিশীল একটি পরিবেশ যাতে সৃষ্টি করা যায় সে উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ব্যুরো কর্তৃক প্রস্তাবিত আপৌষ-সমঝোতার সুযোগটি কাজে লাগাবার জন্যে বুখারিন ও তাঁর বন্ধুদের চূড়ান্তভাবেই আগ্রহান্বিত হওয়া উচিত ছিল?
পার্টির ঐক্যের কথা, রাজনৈতিক ব্যুরোতে যৌথ কাজকর্মের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এটাই কি স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান নয় যে, যিনিই সাচ্চা ঐক্য চান এবং কাজ-কর্মের ক্ষেত্রে যৌথ-নীতিকে মূল্য দেন তিনিই এই আপোষ-সমঝোতাকে গ্রহণ করতেন? তাহলে কেন বুখারিন ও তাঁর বন্ধুরা এই আপোষ সমঝোতাকে প্রত্যাখ্যান করলেন?
এটাই কি স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান নয় যে, যদি আমাদের একটিমাত্র লাইনই থাকতো, তাহলে ‘তিন ব্যক্তির’ ৯ ফেব্রুয়ারির ‘ঘোষণা’ থাকতো না, কিংবা কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রস্তাবিত আপোষ-সমঝোতাকে গ্রহণ করায় বুখারিন ও তাঁর বন্ধুদের প্রত্যাখ্যানও থাকতো না।
না, কমরেডগণ, উপরে উপস্থাপিত বাস্তব ঘটনাগুলোকে যদি আমরা স্মরণে রাখি, তাহলে আপনাদের একক, অভিন্ন লাইনের ব্যাপারে অবশ্যই কিছু গোলমেলে বিষয় আছে।
এটাই বেরিয়ে আসছে যে, বাস্তবত আমাদের লাইন একটি নয়, বরং দুইটি। একটা হলো কেন্দ্রীয় কমিটির লাইন আর অন্যটি হলো বুখারিন গ্রুপের লাইন।
রাইকভ তাঁর বক্তৃতায় সত্য কথাটি বলেন নাই যখন তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, আমাদের রয়েছে একটিমাত্র সাধারণ লাইন। এর দ্বারা তিনি তাঁর নিজস্ব লাইনকে মুখোশাবৃত করতে চেয়েছেন, যে লাইনটি হলো পার্টি লাইন থেকে ভিন্ন, এবং যার উদ্দেশ্য হলো গোপনে পার্টি লাইনের বিশ্বস্ততা ধ্বংস করা। যথার্থভাবে মতানৈক্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া, পার্টি’র অভ্যন্তরীণ প্রকৃত পরিস্থিতিকে ঢাকা দিয়ে রাখা, স্বীয় অবস্থানকে পর্দাবৃত করে রাখা এবং পার্টির পক্ষে পরিপূর্ণ স্পষ্টতা অর্জন অসম্ভব করে তোলার প্রয়াসই হলো সুবিধাবাদের কর্মনীতি।
সুবিধাবাদের পক্ষে এরূপ কর্মনীতি আবশ্যক হয়ে পড়ে কেন? কারণ লাইনের ঐক্য সম্পর্কিত কথাবার্তার ধূম্রজালের আড়ালে পার্টি লাইন থেকে ভিন্ন নিজস্ব লাইনকে কার্যত বাস্তবায়িত করতে তা সুবিধাবাদীদের সমর্থ করে তুলে। কেন্দ্রীয় কমিটি ও কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের বর্তমান প্লেনামে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতায় রাইকভ এই সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীই গ্রহণ করেছেন।
কমরেড লেনিন তার অন্যতম একটি নিবন্ধে সাধারণভাবে সুবিধাবাদীদের যে চরিত্র বর্ণন করেছেন তা শুনবেন কি? এই চরিত্র বর্ণনটি আমাদের কাছে তার সাধারণ তাৎপর্যের কারণেই কেবল নয়, বরং রাইকভের ক্ষেত্রে তা যথাযথভাবে প্রযোজ্য বলেও গুরুত্বপূর্ণ।
সুবিধাবাদ ও সুবিধাবাদীদের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লেনিন যা বলেছেন তা হলো এইঃ
আমরা যখন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বলি, তখন প্রত্যেকটি পরিক্ষেত্রে সমগ্র বর্তমানকালীন সুবিধাবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন, তার অস্পষ্টতা, বিক্ষিপ্ততা, কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার বৈশিষ্ট্যগুলিকে আমাদের কখনোই ভুলে গেলে চলবে না। একজন সুবিধাবাদী, খোদ তার স্বভাব-প্রকৃতি অনুযায়ীই, সব সময় একটি বিষয়কে সুস্পষ্টভাবে ও নিশ্চিতরূপে সূত্রায়িত করাটা কৌশলে এড়িয়ে যায়, সে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে চায়, দুটি পারস্পরিকভাবেই স্বতন্ত্র মতামতের মধ্যে সে সাপের মতই মোচড়ে মোচড়ে চলে, উভয় মতের সাথে একমত হওয়ার চেষ্টা করে এবং তুচ্ছ সংশোধনী উপস্থাপনা, সংশয় প্রকাশ, নিরপেক্ষতা অবলম্বন এবং সহজ সরল পরামর্শ প্রদান, ইত্যাদি ইত্যাদির মধ্যে তার মতপার্থক্যকে নামিয়ে আনে”।
এক কদম আগে, দু’কদম পিছে
একজন সুবিধাবাদীর ছবি এখানে পরিস্ফুট, যে সুস্পষ্টতা ও সুনিশ্চয় হওয়াকে ভয় করে এবং যে প্রকৃত অবস্থাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার, পার্টির মধ্যে প্রকৃত মতপার্থক্যকে উপেক্ষা করে যাওয়ার চেষ্টা করে ।
হ্যা, কমরেডগণ, যত অপ্রিয়ই হোক বাস্তব ঘটনাকে মোকাবেলা করায় একজনকে অবশ্যই সমর্থ হতে হবে। ঈশ্বর না করুন, সত্য প্রকাশের ভীতির রোগে আমরা আক্রান্ত না হয়ে পড়ি। প্রসঙ্গতঃ, অন্যান্য সকল পার্টি থেকে বলশেভিকরা হলো স্বতন্ত্র, কারণ তারা সত্যকে ভয় করে না আর যত তিক্তই হোন না কেন সত্যকে মোকাবেলায় তারা ভীত নয়। আর বর্তমান ক্ষেত্রে সত্যটি হলো এই যে, বাস্তবতই আমাদের কোনো একক, অভিন্ন লাইন নেই। একটি লাইন আছে যা হলো পার্টি লাইন, বিপ্লবী লেনিনবাদী লাইন। কিন্তু তার পাশাপাশি রয়েছে আরেকটি লাইন, বুখারিন গ্রুপের লাইন, যা পার্টি বিরোধী ঘোষণা দ্বারা, পদত্যাগের দ্বারা পার্টির বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ও ছদ্মাবরণকৃত বিশ্বস্ততা ভঙ্গকারী কার্যকলাপ দ্বারা, পার্টি-বিরোধী জোট গঠনের উদ্দেশ্যে বিগত সময়ের ট্রটস্কীবাদীদের সাথে নেপথ্যে বোঝাপড়া স্থাপনের দ্বারা পার্টি লাইনকে বিরোধিতা করছে। দ্বিতীয় লাইনটি হলো সুবিধাবাদী লাইন।
এটাই হলো বাস্তব ঘটনা, যেটাকে কোনো ধরণেরই কুটনীতিসুলভ বাগাড়ম্বরতা কিংবা একটি একক লাইনের অস্তিত্ব সম্পর্কিত অলঙ্কারপূর্ণ বিবৃতি দ্বারা আড়াল করা যাবে না।

জোসেফ ভিসারিওনোভিচ স্তালিন বা যোসেফ স্তালিন বা জোসেফ স্ট্যালিন (১৮ ডিসেম্বর, ১৮৭৯- ৫ মার্চ ১৯৫৩) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মানে এবং একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দীর্ঘতম সাফল্যের ইতিহাস রচনা করে গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ তথা বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম যোসেফ ভিসারিওনোভিচ সোসো, স্তালিন নামটি তিনি ১৯১০ সালে ‘লৌহমানব’ অর্থে ধারণ করেন। তাঁকে মানবেতিহাসের মহত্তম নেতা ও জনগণের শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা হয়।