সংগ্রামী বস্তুবাদের তাৎপর্য

[১]‘পদ জনামেনেম মার্কসিজমা’ (মার্কসবাদের পতাকাতলে)[২] পত্রিকার সাধারণ কর্তব্য সম্পর্কে তার ১ ও ২ নং সংখ্যায় ত্রৎস্কি[৩] মূলকথাগুলো সবই বলেছেন এবং চমৎকার বলেছেন। পত্রিকার ১ম- ২য় সংখ্যায় উদ্বোধনী বিবৃতিতে সম্পাদকমণ্ডলী যে কর্মধারা ঘোষণা করেছেন তার সারাংশ ও কর্মসূচিকে আরো প্রত্যক্ষভাবে নির্দিষ্ট করার মতো কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই।

এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, ‘পদ জনামেনেম মার্কসিজমা’ পত্রিকার চারপাশে যাঁরা সম্মিলিত হয়েছেন তাঁরা সবাই কমিউনিস্ট নন, তবে সবাই সঙ্গতিনিষ্ঠ বস্তুবাদী। আমার ধারণা, কমিউনিস্ট ও অ-কমিউনিস্টদের এই জোট নিঃসন্দেহেই আবশ্যক, এবং পত্রিকাটির কর্তব্য তাতে সঠিকভাবেই নির্ধারিত হচ্ছে। বিপ্লব যেন-বা একলা বিপ্লবীরাই সাধন করতে পারে, এই ধারণাটা হলো কমিউনিস্টদের (সাধারণভাবে বিপ্লবীদেরও, যাঁরা মহা বিপ্লবের সূত্রপাত করেছেন সফলভাবেই) একটি অন্যতম বৃহৎ ও বিপজ্জনক ভুল। বরং যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক কাজের সাফল্যের জন্য এই কথাটা বুঝে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারা দরকার যে, বিপ্লবীরা তাঁদের ভূমিকা পালন করতে পারে কেবল সত্যসতই প্রাণবান ও অগ্রণী একটি শ্রেণির অগ্রবাহিনী হিসেবে। অগ্রবাহিনী তার অগ্রবাহিনীর ভূমিকা পালন করতে পারে কেবল তখন, যখন সে তার পরিচালিত জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে সত্যি করেই সমগ্র জনগণকে সামনে চালাতে পারে। ক্রিয়াকলাপের অতি বিভিন্ন সব ক্ষেত্রে অ-কমিউনিস্টদের সঙ্গে জোট না বাঁধলে কমিউনিস্ট নির্মাণে কোনো সাফল্যের কথাই উঠতে পারে না।।

‘পদ জনামেনেম মার্কসিজমা’ পত্রিকা যাতে নেমেছে, বস্তুবাদ ও মার্কসবাদ সমর্থনের সে কাজেও এ কথা প্রযোজ্য। রাশিবার অগ্রণী সমাজচিন্তার প্রধান-প্রধান ধারায় সৌভাগ্যবশত পাকা বস্তুবাদী ঐতিহ্য বর্তমান। গ. ভ. প্লেখানভের[৪] কথা ছেড়ে দিলেও শুধু চের্নিশেভস্কির[৫] নাম উল্লেখ করাই যথেষ্ট ― ফ্যাশনচল প্রতিক্রিয়াশীল দার্শনিক মতবাদের সন্ধানে, ইউরোপীয় বিদ্যার তথাকথিত ‘শেষ কথার’ যে চুমকিতে মজে আধুনিক নারোদনিকরা (জনবাদী সমাজতন্ত্রী[৬], সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি ইত্যাদি) তাঁর কাছ থেকে পিছু হটেছে, সে চুমকির তলে তারা বুর্জোয়ার দাস্যবৃত্তি, বুর্জোয়া কুসংস্কার ও বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলতার কোনো রকম দাস্যবৃত্তির রকমফেরটা ধরতে পারে নি।

অন্তত রাশিয়ায় অ-কমিউনিস্টদের শিবিরে এখনো বস্তুবাদীরা আছেন ও নিঃসন্দেহে আরো দীর্ঘদিন থাকবেন, এবং দার্শনিক প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে, তথাকথিত ‘শিক্ষিত সমাজের’ দার্শনিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সুসঙ্গত ও সংগ্রামী বস্তুবাদের সমস্ত অনুগামীদের সম্মিলিত কাজের মধ্যে টেনে আনা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। আধুনিক সমাজে দর্শনের অধ্যাপকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসলে ‘পাদ্রীতন্ত্রের ডিপ্লোমা-পাওয়া চাপরাশী’ ছাড়া কিছু নয়, এই যে উক্তি করেছিলেন দিৎসগেন-পিতা[৭] (যেমন হামবড়া তেমনি অসার্থক তাঁর সাহিত্যিক পুত্রের সঙ্গে তাঁকে গুলানোর দরকার নেই), তাতে তিনি বুর্জোয়া দেশগুলিতে প্রচলিত তাদের পণ্ডিত ও প্রাবন্ধিকদের মনোযোগধন্য দার্শনিক ধারাগুলি সম্পর্কে মার্কসবাদের মূল দৃষ্টিভঙ্গিটা প্রকাশ করেন বেশ সঠিক, যুতসই, পরিষ্কার করে।

আমাদের রুশী যে বুদ্ধিজীবী অন্যান্য দেশে তাদের সহভ্রাতাদের মতোই নিজেদের প্রাগ্রসর লোক বলে ভাবতে ভালোবাসে, তারা কিন্তু দিৎসগেনের[৮] ভাষায় প্রকাশিত ওই মূল্যায়নের পটে সমস্যাটা টেনে আনতে মোটেই ভালোবাসে না। তবে, এটা তারা ভালোবাসে না কারণ সত্যটা তাতে চোখে বেঁধে। শাসক বুর্জোয়ার কাছে আধুনিক শিক্ষিত লোকেদের রাষ্ট্রিক, তৎপর সাধারণ-অর্থনৈতিক, তারপর সামাজিক ও অন্যান্য সমস্ত নির্ভরশীলতার কথা কিছুটা ভাবলেই বোঝা যাবে দিৎসগেনের কঠোর মন্তব্যটা একান্ত সঠিক। রেডিয়ম আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত দার্শনিক ধারাগুলো থেকে শুরু করে আজ যেগুলো আইনস্টাইনকে[৯] আঁকড়ে ধরতে চাইছে, ইউরোপীয় দেশগুলোয় ঘন ঘন মাথা চাড়া দেওয়া এই সব বিপুল পরিমাণ ফ্যাশনচল দার্শনিক ধারার কথা মনে করলেই একটা ধারণা পাওয়া যাবে বুর্জোয়ার শ্রেণিস্বার্থ ও শ্রেণিঅবস্থান এবং ধর্মের নানা রূপভেদের প্রতি তার সমর্থনের সঙ্গে ফ্যাশনচল দার্শনিক ধারাগুলোর সারার্থের সম্পর্কটা কী।

যা বলা হলো তা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সংগ্রামী বস্তুবাদের মুখপত্র হতে চায় যে পত্রিকা, তাকে জঙ্গী মুখপত্র হতে হবে প্রথমত, সমস্ত আধুনিক ‘পাদ্রীতন্ত্রের ডিপ্লোমা-পাওয়া চাপরাশীদের’ অটল স্বরূপমোচন ও সমালোচনার দিক থেকে, তা তারা সরকারী বিদ্যার প্রতিনিধি হিসেবেই কথা বলুন, অথবা নিজেদের ‘বাম গণতন্ত্রী বা ভাবাদর্শে সমাজতন্ত্রী’ প্রাবন্ধিক ঘোষণা করে স্বাধীন লেখক হিসেবেই দেখা দিন।

দ্বিতীয়ত, এরূপ পত্রিকাকে হতে হবে সংগ্রামী নিরীশ্বরবাদের মুখপত্র। এ কাজ চালাবার মতো সংস্থা অন্তত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আমাদের আছে। কিন্তু কাজটা চলছে চূড়ান্ত রকম শৈথিল্যে, চূড়ান্ত রকম অসন্তোষজনকভাবে, বোঝা যায় আমাদের খাঁটি রুশী (সোভিয়েত হলেও) আমলাতান্ত্রিকতার সাধারণ পরিস্থিতির চাপ সয়ে। সেইজন্যেই আমাদের ওই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির কাজের পরিপূরণে, তার সংশোধনে এবং তার সঞ্জীবনে, সংগ্রামী বস্তুবাদের মুখপত্র হবার কর্তব্যধারী পত্রিকাটির অক্লান্ত নিরীশ্বরবাদী প্রচার ও সংগ্রাম চালানো অত্যন্ত জরুরি। এদিক থেকে সমস্ত ভাষায় প্রকাশিত সমস্ত সাহিত্য মন দিয়ে অনুসরণ করা উচিত এবং এ ক্ষেত্রে যা কিছুটা মূল্যবান এমন সবকিছুরই অনুবাদ অন্তত সারার্থ প্রকাশ করা দরকার।

এঙ্গেলস অনেক আগেই জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রচারের জন্য আঠারো শতকের শেষের সংগ্রামী নিরীশ্বরবাদী সাহিত্য অনুবাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন আধুনিক প্রলেতারিয়েতের নেতাদের[১০]। আমাদের পক্ষে লজ্জার কথা, এতদিন পর্যন্তও আমরা সেটা করি নি (বিপ্লবী যুগে ক্ষমতা দখল করা যে সে ক্ষমতার সঠিক সদ্ব্যবহারের চেয়ে অনেক সহজ তার অসংখ্য সাক্ষ্যের একটি এটা)। মাঝে মাঝে আমাদের এই শৈথিল্য, আলস্য ও অকর্মণ্যতার কৈফিয়ৎ দেওয়া হয় ‘গালভরা’ সব যুক্তিতে, যেমন, আরে বাপু, আঠারো শতকের সাবেকী নিরীশ্বরবাদী সাহিত্য যে অচল, অবৈজ্ঞানিক, নাবালকোচিত ইত্যাদি। হয় পুঁথিবাগীশি নয় মার্কসবাদ বোঝার পূর্ণ অক্ষমতা চাপা দেওয়া এই ধরনের পণ্ডিতম্মন্য কূটতর্কের চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। অবশ্যই আঠারো শতকী বিপ্লবীদের নিরীশ্বরবাদী রচনায় অবৈজ্ঞানিক ও নাবালকোচিত জিনিস কম মিলবে না। কিন্তু সেসব রচনাকে সংক্ষিপ্ত করত, আঠারো শতকের শেষ থেকে ধর্মের বৈজ্ঞানিক সমালোচনায় মানবজাতির যে প্রগতি হয়েছে তার উল্লেখ করে, এ বিষয়ে সাম্প্রতিকতম বইয়ের উল্লেখ করে সংক্ষিপ্ত পরিশিষ্ট যোগ করতে প্রকাশকদের বাধা কোথায়? লক্ষ লক্ষ যে জনগণকে (বিশেষ করে কৃষক ও কারুজীবী) আধুনিক সমাজ তমসা, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে নিপতিত করেছে তারা কেবল বিশুদ্ধ মার্কসবাদী জ্ঞানালোকের সোজাসুজি পথে এ তমসা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, এ কথা ভাবা হবে মার্কসবাদীর পক্ষে সম্ভবপর সবচেয়ে মহা ভুল ও জঘন্য ভুল। এই জনগণকে দেওয়া উচিত নিরীশ্বরীবাদী প্রচারের সব মাল-মসলা, পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত জীবনের নানা ক্ষেত্রের তথ্যের সঙ্গে, নানাভবে এগুতে হবে তাদের দিকে যাতে তাদের আকৃষ্ট করা যায়, জাগিয়ে তোলা যায় ধর্মের ঘুম থেকে, নানা দিক দিয়ে বিচিত্রতম উপায়াদি মারফত ঝাঁকুনি দিতে হবে তাদের।

সমাজতন্ত্র সম্পর্কে একটি আলোচনা দেখুন

আঠারো শতকের সাবেকী নিরীশ্বরবাদীদের উদ্দাম, জীবন্ত, প্রতিভাদীপ্ত যে লেখাগুলোয় প্রচলিত পাদ্রীতন্ত্রের ওপর সরস প্রকাশ্য আক্রমণ চালানো হতো সেগুলো ধর্মের ঘুম থেকে লোককে জাগিয়ে তোলার পক্ষে আমাদের সাহিত্যে প্রচলিত একঘেয়ে, নীরস, সুনির্বাচিত তথ্যাভাবে প্রায় অব্যাখ্যাত মার্কসবাদের যে পুনঃকথনে (পাপ ঢেকে লাভ কী) প্রায়ই মার্কসবাদকে বিকৃত করা হয়, তার চেয়ে হাজার-গুণ উপযোগী। মার্কস ও এঙ্গেলসের বড়ো বড়ো সমস্ত রচনাই আমাদের দেশে অনূদিত হয়েছে। মার্কস ও এঙ্গেলসের করা সংশোধনে আমাদের দেশে সাবেকী নিরীশ্বরবাদ ও সাবেকী বস্তুবাদের পরিপূরণ হবে না, এ আশঙ্কা একেবারেই অমূলক। সবচেয়ে জরুরি কথা, আমাদের তথাকথিত মার্কসবাদী কিন্তু আসলে মার্কসবাদ বিকৃতিকারী কমিউনিস্টরা ঠিক যে কথাটি প্রায়ই ভোলে, সেটা হলো ধর্মের প্রশ্নে সচেতন মনোভাব গ্রহণ ও ধর্মের সচেতন সমালোচনায় এখনো খুবই অপরিণত জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারা।

অন্যদিকে, ধর্মের আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমালোচকদের দিকে চেয়ে দেখুন। প্রায় সর্বদাই এই শিক্ষিত বুর্জোয়া প্রতিনিধিরা ধর্মীয় কুসংস্কার খণ্ডনকে ‘সম্পূরণ করে নেন’ এমন সব যুক্তি দিয়ে যাতে সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা বুর্জোয়ায় ভাবদাস, ‘পাদ্রীতন্ত্রের ডিপ্লোমা-পাওয়া চাপরাশী’ হিসেবে উদ্ঘাটিত হয়ে পড়েন।

দুটি দৃষ্টান্ত। অধ্যাপক র. ইউ. ভিপপার[১১] ১৯১৮ সালে একটি বই প্রকাশ করেন ‘খ্রীষ্টধর্মের উদ্ভব’ (ফারস প্রকাশভবন, মস্কো)। আধুনিক বিজ্ঞানের প্রধান প্রধান ফলাফলের পুনর্বিবরণ দিয়েছেন লেখক কিন্তু রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গির্জার যা হাতিয়ার সেই কুসংস্কার ও বুজরুকির সঙ্গে তিনি লড়ছেন না তাই নয়, এ সব প্রশ্ন এগিয়ে গেছেন তাই নয়, ভাববাদী ও বস্তুবাদী উভয় ‘চূড়ান্তপনার’ ঊর্ধ্বে ওঠার একেবারে হাস্যকর ও প্রতিক্রিয়াশীল এক বড়াই করেছেন। এটা হলো প্রভু বুর্জোয়ার দাস্যবৃত্তি, যারা সারা দুনিয়ায় মজুর নিঙড়ানো মুনাফা থেকে কোটি কোটি টাকা ঢালে ধর্মের সমর্থনে।

খ্যাতনামা জার্মান পণ্ডিত আর্তুর দ্রেভস[১২] তাঁর ‘খ্রীষ্টের অতিকথা’ গ্রন্থে ধর্মীয় কুসংস্কার ও গল্পগুলিকে খণ্ডন করে প্রমাণ করেছেন যে, আদৌ কোনো খ্রীষ্ট ছিলেন না, তাহলেও গ্রন্থের শেষে ধর্মের পক্ষেই মত দিয়েছেন, শুধু সেটা নবায়িত, পরিশুদ্ধ, সূক্ষ্ম ধর্ম যা ‘দিন-দিন বেড়ে ওঠা প্রকৃতিবাদী বন্যাকে’ প্রতিহত করতে পারবে (২৩৮ পৃঃ, ৪র্থ জার্মান সংস্করণ, ১৯১০)। ইনি খোলাখুলি সজ্ঞান প্রতিক্রিয়াশীল, সাবেকী ক্ষীয়মাণ ধর্ম কুসংস্কারের বদলে নতুন আরো বিষাক্ত ও বিশ্রী কুসংস্কার আমদানির জন্য ইনি শোষকদের প্রকাশ্যে সাহায্য করছেন।

আরো পড়ুন

এর অর্থ, ড্রেভসকে অনুবাদ করার প্রয়োজন ছিল না, তা নয়। এর অর্থ, কমিউনিস্ট ও সঙ্গতিশীল সমস্ত বস্তুবাদীর উচিত বুর্জোয়ার প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে কিছুটা পরিমাণ ঐক্য স্থাপন করা ও তারা প্রতিক্রিয়ায় নেমে গেলে অক্লান্তভাবে তাদের স্বরূপমোচন করা। এর অর্থ, যে যুগে বুর্জোয়ারা ছিল বিপ্লবী সেই আঠারো শতকের বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের সঙ্গে ঐক্য স্থাপন না করা হলো মার্কসবাদ ও বস্তুবাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা, কারণ আধিপত্যকারী ধর্মীয় তমসাবাদীদের সঙ্গে সংগ্রামে কোনো না কোনো মাত্রায়, কোনো না কোনো রূপে ড্রেভসদের সঙ্গে ‘ঐক্য স্থাপন’ আমাদের পক্ষে বাধ্যতামূলক।

‘পদ জনামেনেম মার্কসিজমা’ নামে যে পত্রিকাটি সংগ্রামী বস্তুবাদের মুখপত্র হতে চায় তার উচিত নিরীশ্বরবাদী প্রচারের জন্য, তদ্বিয়ষক সাহিত্যের পরিক্রমার জন্য, এবং এক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপের বিপুল ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনের জন্য অনেক জায়গা দেওয়া। বিশেষ করে যেসব বইয়ে অনেক প্রত্যক্ষ তথ্য ও প্রতিতুলনা আছে, যাতে ধর্মপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রচার ব্যবস্থার সঙ্গে আধুনিক বুর্জোয়ার শ্রেণিস্বার্থ ও শ্রেণিসংগঠনের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে সেসব বই ও পুস্তিকাকে কাজে লাগানো বিশেষ জরুরি।

উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কিত মালমসলা বিশেষ জরুরি, সেখানে ধর্ম ও পুঁজির আনুষ্ঠানিক, সরকারি, রাষ্ট্রীয় যোগাযোগটা কম দেখা যায়। কিন্তু অন্যদিকে তাতে আমাদের কাছে আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, তথাকথিত ‘আধুনিক গণতন্ত্র’ (যার পায়ে মেনশেভিক, সোশ্যালিস্ট- রেভলিউশানারি এবং অংশত নৈরাজ্যবাদী প্রভৃতিরা এত বোকার মতো মাথা ঠোকে) আর কিছুই নয় বুর্জোয়ার কাছে যা লাভজনক তেমন প্রচারের স্বাধীনতা, আর সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনা, ধর্ম, তমসবাদ, শোষকদের সমর্থন ইত্যাদির প্রচারই তার কাছে লাভজনক ।

আশা করা যাক, সংগ্রামী বস্তুবাদের মুখপত্র হতে চায় যে পত্রিকা, তা আমাদের পাঠক সাধারণকে নিরীশ্বরবাদী সাহিত্যের সমীক্ষা দেবে, কোন কোন রচনা কী ধরনের পাঠক মহলের পক্ষে কোন দিক থেকে উপযোগী, তার হদিশ থাকবে, উল্লেখ থাকবে আমাদের দেশে কী কী প্রকাশিত হলো (প্রকাশিত বলে ধরতে হবে কেবল চলনসই অনুবাদগুলোকে, সংখ্যায় তা বেশি নেই) এবং আরো কী প্রকাশ করা উচিত।

——————-

কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্ভুক্ত নয় এমন সঙ্গতিনিষ্ঠ বস্তুবাদীদের সঙ্গে মৈত্রী ছাড়াও সংগ্রামী বস্তুবাদের করণীয় কর্মের পক্ষে কম গুরুত্বের নয়, হয়ত-বা বেশি গুরুত্বের কাজ হলো আধুনিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সেইসব প্রতিনিধিদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন, যাঁদের প্রবণতা বস্তুবাদের দিকে, তথাকথিত ‘শিক্ষিত সমাজে’ ভাববাদ ও সংশয়বাদের দিকে ফ্যাশনচল দার্শনিক দোলায়মানতার যে প্রাধান্য রয়েছে তার বিরুদ্ধে যাঁরা সে বস্তুবাদকে সমর্থন ও প্রচার করতে ভয় পান না।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব বিষয়ে ‘পদ জনামেনেম মার্কসিজমা’র প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যায় আ. তিমিরিয়াজেভ[১৩] যে প্রবন্ধ লিখেছেন তাতে এই আশার সঞ্চার হয় যে, পত্রিকাটি ঐ দুই নম্বর মৈত্রী কার্যকরী করতেও সক্ষম হবে। সেদিকে অধিকতর মনোযোগ দেওয়া উচিত। মনে রাখা উচিত যে, আধুনিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞান যেসব তীক্ষ্ণ ওলটপালটের মধ্য দিয়ে চলেছে, ঠিক তার ফলেই ক্রমাগত প্রতিক্রিয়াশীল দার্শনিক গোষ্ঠী ও উপগোষ্ঠী, ধারা ও উপধারার উদ্ভব হচ্ছে। সুতরাং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক বিপ্লব থেকে উত্থিত সমস্যাগুলিকে অনুসরণ করা এবং দার্শনিক পত্রিকার কাজে প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের টেনে আনা – এই হলো কর্তব্য, তা সাধন না করলে সংগ্রামী বস্তুবাদ না হবে সংগ্রামী, না বস্তুবাদ। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় তিমিরিয়াজেভ এই যে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, তিমিরিয়াজেভের মতে আইনস্টাইন নিজে বস্তুবাদের বনিয়াদগুলির উপর কোনো সক্রিয় আক্রমণ না করলেও তাঁর তত্ত্বকে ইতিমধ্যেই সব দেশের বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের এক বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধি লুফে নিয়েছে, সে কথা শুধু আইনস্টাইন সম্পর্কেই প্রযোজ্য নয়, উনিশ শতকের শেষ থেকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বড়ো বড়ো সংস্কারকদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে না হলেও পুরো একসারি লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

এবং এই ঘটনাটির প্রতি আমাদের মনোভাব যাতে জ্ঞানহীনের মতো না হয়, সেজন্য একথা বুঝতে হবে যে, একটা দৃঢ় দার্শনিক ভিত্তি ছাড়া বুর্জোয়া ভাবাদর্শের আক্রমণ বুর্জোয়া বিশ্বদৃষ্টির পুনরাবির্ভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কোনো প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, কোনো বস্তুবাদই দাঁড়াতে পারবে না। সে সংগ্রামে টিকে থাকা ও পরিপূর্ণ বিজয়ে সেটা শেষ পর্যন্ত চালানোর জন্য প্রকৃতিবিজ্ঞানীকে হতে হবে এক আধুনিক বস্তুবাদী, মার্কস যার প্রতিনিধি সেই বস্তুবাদের সচেতন অনুগামী, অর্থাৎ তাঁকে হতে হবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী। সে লক্ষ্য সাধনের জন্য ‘পদ জনামেনেম মার্কসিমা’র লেখকদের উচিত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের ধারাবাহিক অধ্যয়নের ব্যবস্থা করা, অর্থাৎ যে দ্বন্দ্বতত্ত্ব মার্কস তাঁর ‘পুঁজি’ গ্রন্থে এবং ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক রচনায় ব্যবহারিকভাবে প্রয়োগ করেছিলেন এবং এমন সফলভাবে প্রয়োগ করেছিলেন যে বর্তমানে প্রচ্যে (জাপানে, ভারতে, চীনে) জীবন ও সংগ্রামের মধ্যে নতুন নতুন শ্রেণির জেগে ওঠার প্রত্যেকটি দিনই ― অর্থাৎ কোটি কোটি সেই মানুষের জেগে ওঠা যারা বিশ্বজনের অধিকাংশ এবং যাদের ঐতিহাসিক নিষ্ক্রিয়তা ও ঐতিহাসিক তন্দ্রার অবস্থাই এতদিন ইউরোপের বহু অগ্রসর দেশের অচলায়তন ও অবক্ষয়ের হেতু হয়ে এসেছে, ― নতুন নতুন জাতি ও নতুন নতুন শ্রেণির জীবনের মধ্যে জেগে ওঠার এই প্রত্যেকটা দিনই ক্রমাগত মার্কসবাদ প্রমাণ করছে। বলাই বাহুল্য, হেগেলীয়[১৪]  দ্বন্দ্বতত্ত্বের এরূপ অধ্যয়ন, এরূপ ব্যাখ্যান ও এরূপ প্রচার খুবই দুরূহ, এবং সন্দেহ নেই যে তার প্রথম পরীক্ষাগুলোর সঙ্গে ভুলভ্রান্তি জড়িয়ে থাকবে। কিন্তু ভুল করে না কেবল সে-ই যে কিছুই করে না। বস্তুবাদীভাবে গৃহীত হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বকে মার্কস যেভাবে প্রয়োগ করেছিলেন তার ওপর ভিত্তি করে আমরা এ দ্বন্দ্বতত্ত্বকে তার সব দিক দিয়ে পরিবিকশিত করতে পারি ও করা উচিত, হেগেলের প্রধান প্রধান রচনার উদ্ধৃতি ছাপাতে পারি পত্রিকায়, বস্তুবাদীর মতো তার ব্যাখ্যা করতে পারি, মার্কস যেভাবে দ্বন্দ্বতত্ত্ব প্রয়োগ করেছিলেন তার নিদর্শন নিয়ে সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আধুনিক ইতিহাস থেকে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও বিপ্লব থেকে দ্বান্দ্বিকতার যে অজস্র নমুনা মিলছে তার সাহায্যে টিকা যোগ করতে পারি। ‘পদ জনামেনেম মার্কসিজমা’ পত্রিকার সম্পাদক ও লেখক গোষ্ঠীর হওয়া উচিত আমার মতে, একধরনের ‘হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের বস্তুবাদী বন্ধু সমাজ’। প্রকৃতিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লব যেসব দার্শনিক প্রশ্ন তুলছে এবং যার সামনে বুর্জোয়া ফ্যাশনের বুদ্ধিজীবী ভক্তরা প্রতিক্রিয়ায় ‘পদস্খলিত’ হচ্ছেন, তেমন সব দার্শনিক প্রশ্নের একগুচ্ছ জবাব আধুনিক প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা পাবেন হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের বস্তুবাদী ব্যাখ্যানের মধ্যে (যদি তাঁরা অবশ্য সন্ধান করতে পারেন এবং আমরা তাঁদের সাহায্য করতে শিখি)।

এরূপ কর্তব্য গ্রহণ ও নিয়মিতভাবে তা পালন না করলে বস্তুবাদ সংগ্রামী বস্তুবাদ হয়ে উঠতে পারে না। শ্যেদ্রিনের[১৫] উক্তি ব্যবহার করে বলা যায়, তা থেকে যাবে আক্রমণকারী ততটা নয়, যতটা আক্রান্ত। এছাড়া বড়ো বড়ো প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা এতদিনকার মতোই বারম্বার নিজেদের দার্শনিক সিদ্ধান্ত ও সাধারণীকরণে অসহায় হয়ে পড়বেন। কেননা প্রকৃতিবিজ্ঞান এত দ্রুত এগুচ্ছে, এবং তার সমস্ত ক্ষেত্রে এমন গভীর বৈপ্লবিক ওলটপালটের পর্ব অতিক্রম করছে যে দার্শনিক সিদ্ধান্ত না টেনে প্রকৃতিবিজ্ঞান পারে না।

উপসংহারে একটি দৃষ্টান্ত দেব যা দর্শনের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাহলেও অন্তত সামাজিক সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যার প্রতি ‘পদ জনামেনেম মার্কসিজমা’ পত্রিকাটিও মনোযোগ দিতে চায়।

তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞান কী ভাবে আসলে অতি কদর্য ও জঘন্য প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গির বাহক হয়, এটি তারই একটি নিদর্শন।

কিছুদিন আগে ‘রুশ টেকনিকাল সমিতির’ একাদশ বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘ইকনমিস্ট’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি (১৯২২ সাল) আমায় পাঠানো হয়। এ পত্রিকা আমায় পাঠায় যে তরুণ কমিউনিস্ট (পত্রিকার বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হবার সময় তার ছিল না বলেই মনে হয়), সে অসতর্কে পত্রিকাটির প্রতি অসাধারণ সহানুভূতি প্রকাশ করে। আসলে এ পত্রিকা হলো, কতটা সচেতনভাবে জানি না, আধুনিক ভূমিদাস-মালিকদের মুখপত্র, তবে অবশ্যই বৈজ্ঞানিকতা, গণতান্ত্রিকতা ইত্যাদির আবরণে আড়াল নেওয়া ।

এ পত্রিকার ‘যুদ্ধের প্রভাব প্রসঙ্গে’ জনৈক শ্রী প. আ. সরোকিনের[১৬] বিস্তৃত এক তথাকথিত ‘সমাজতাত্ত্বিক’ গবেষণা স্থান পেয়েছে। পণ্ডিতী প্রবন্ধটি লেখকের এবং তাঁর অসংখ্য বৈদেশিক গুরু ও সহকর্মীদের ‘সমাজতাত্ত্বিক’ রচনা থেকে পণ্ডিতী উদ্ধৃতিতে কণ্টকিত। কী রকম তাঁর পাণ্ডিত্য দেখুন:

৮৩ পৃষ্ঠায় পড়ি:

‘পেত্রগ্রাদে বর্তমানে ১০,০০০ বিবাহের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে ৯২.২টি ক্ষেত্রে — সংখ্যাটা অকল্পনীয়, তদুপরি ১০০টি বিবাহভঙ্গের মধ্যে ৫১.১টি বিবাহ স্থায়ী হয় এক বছরেরও কম, ১১% এক মাসের কম, ২২% দু’মাসের কম, ৪১% ৩-৬ মাসের কম, এবং কেবল ২৬% — ৬ মাসের বেশি। এই সব সংখ্যা থেকে প্রমাণ হয় যে, আধুনিক আইনী বিবাহ হলো কেবল একটা ঠাট, যাতে আসলে বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক আড়াল পাচ্ছে এবং ‘ফল’ পিয়াসীদের ‘আইনসঙ্গতভাবে’ ক্ষুধাতৃপ্তির সুযোগ মিলছে (‘ইকনমিস্ট’, ১ম সংখ্যা, ৮৩ পৃঃ)।

কোনো সন্দেহ নেই যে, এই ভদ্রলোক এবং যে রুশ টেকনিকাল সমিতি পত্রিকা প্রকাশ করেন ও তাতে এই ধরনের আলোচনা ছাপান তাঁরা নিজেদের গণতন্ত্রপন্থী বলে মনে করেন এবং খুব অপমানিত বোধ করবেন যদি তাঁরা আসলে যা সেই নামে ডাকা যায়: অর্থাৎ ভূমিদাস-মালিক, প্রতিক্রিয়াশীল, ‘পাদ্রীতন্ত্রের ডিপ্লোমা-পাওয়া চাপরাশী’।

বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ ও বিবাহ-বহির্ভূত সন্তান এবং সেইসঙ্গে এক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতির বিষয়ে বুর্জোয়া দেশের আইনবিধির সঙ্গে সামান্য মাত্র পরিচয় থাকলে এ সম্পর্কে আগ্রহী যে-কোনো ব্যক্তিই দেখবেন যে, আধুনিক বুর্জোয়া গণতন্ত্র এমনকি সর্বাধিক গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রও এই ব্যাপারে মেয়েদের প্রতি এবং বিবাহ-বহির্ভূত সন্তানদের প্রতি আচরণে ঠিক ভূমিদাস-মালিক রূপেই নিজেকে জাহির করে।

তাতে অবশ্যই গণতন্ত্র এবং বলশেভিকগণ কর্তৃক গণতন্ত্র লঙ্ঘনের চিৎকার চালাতে মেনশেভিক, সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশানারি, নৈরাজ্যবাদীদের একাংশের এবং পশ্চিমের অনুরূপ সব পার্টির পক্ষে কোনো অসুবিধা হয় না। অথচ আসলে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, বিবাহ-বহির্ভূত সন্তানদের অবস্থা প্রভৃতি প্রশ্নের ক্ষেত্রে বলশেভিক বিপ্লবই হলো একমাত্র সুসঙ্গত রূপে গণতান্ত্রিক বিপ্লব। আর এ প্রশ্ন যে-কোনো দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যার স্বার্থের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট। বলশেভিক বিপ্লবের আগে বিপুল সংখ্যক বুর্জোয়া বিপ্লব ঘটলেও ও নিজেদের তারা গণতান্ত্রিক বিপ্লব নামে অভিহিত করলেও কেবল বলশেভিক বিপ্লবই উল্লিখিত ক্ষেত্রে যেমন প্রতিক্রিয়াশীলতা ও ভূমিদাস প্রথার বিরুদ্ধে তেমনি শাসক ও সম্পত্তিধারী শ্রেণিদের চলতি ভণ্ডামির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সংগ্রাম চালিয়েছে।

১০,০০০ বিবাহের মধ্যে ৯২টি বিবাহবিচ্ছেদ যদি শ্রী. সরোকিনের কাছে অকল্পনীয় লাগে, তাহলে এই অনুমানই করতে হয় যে, হয় লেখকের বসবাস ও শিক্ষাদীক্ষা হয়েছে জীবন থেকে এমনই বিচ্ছিন্ন এক মঠে যার অস্তিত্বে আদৌ বিশ্বাস করাই কঠিন, নতুবা লেখক প্রতিক্রিয়া ও বুর্জোয়ার স্বার্থে সত্য বিকৃত করছেন। বুর্জোয়া দেশের সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে এতটুকু পরিচয় যার আছে, এমন সমস্ত লোকই জানে যে, সেখানে সত্যকার বিবাহবিচ্ছেদের (গির্জা ও আইন দ্বারা অবশ্যই অনুমোদিত নয়) সত্যকার সংখ্যা সর্বত্রই অতুলনীয় রকমের বেশি। এ ব্যাপারে অন্য দেশ থেকে রাশিয়ার পার্থক্য কেবল এইখানে যে, তার আইন ভণ্ডামিকে এবং নারী ও তার সন্তানদের অধিকারহীন অবস্থাকে পূত-পবিত্র করে তোলে না, বরং খোলাখুলি এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নামে সর্বপ্রকার ভণ্ডামি ও সর্বপ্রকার অসাম্যের বিরুদ্ধে নিয়মিত যুদ্ধ ঘোষণা করে।

এই ধরনের আধুনিক ‘সুশিক্ষিত’ ভূমিদাস-মালিকদের বিরুদ্ধেও লড়াই চালাতে হবে মার্কসবাদী পত্রিকাকে। নিশ্চয় এদের বৃহৎ একটা অংশ এমনকি আমাদেরই রাষ্ট্রের টাকা পায় ও তরুণদের জ্ঞানদানের রাষ্ট্রীয় চাকুরিতে বহাল আছে, যদিও সে কাজে তাদের যোগ্যতা নাবালক-বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে খাঁটি এক লম্পটের যোগ্যতার চেয়ে বেশি নয়।

রাশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতা জয় করতে পেরেছে, কিন্তু তা ব্যবহার করতে এখনো শেখে নি, নইলে সে এই ধরনের অধ্যাপক ও বিদ্বৎসমাজের সভ্যদের অনেক আগেই সৌজন্য সহকারে পাঠিয়ে দিত বুর্জোয়া ‘গণতন্ত্রের’ দেশে। এই ধরনের ভূমিদাস-মালিকদের আসল জায়গা সেখানেই।

ইচ্ছে থাকলেই শেখা যায়।

১২ মার্চ ১৯২২

আরো পড়ুন

টিকা

১. সংগ্রামী বস্তুবাদের তাৎপর্য প্রবন্ধটি প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিল ‘পদ জনামেনেম মার্কসিজমা’ পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যার জন্য, পার্টির ১১শ কংগ্রেস নাগাদ এটি বেরোবার কথা ছিল (কংগ্রেস হয় মস্কোয় ১৯২২ সালের ২৭ মার্চ – ২ এপ্রিল)।
২. ‘পদ জনামেনেম মার্কসিজমা’ (মার্কসবাদের পতাকাতলে) ― দার্শনিক ও সামাজিক অর্থনৈতিক পত্রিকা মস্কো থেকে প্রতি মাসে প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৪৪ সালের জুলাই পর্যন্ত (১৯৩৩ ― ১৯৩৫ সালে দু’মাসে একবার)।
৩. ত্রতস্কি (ব্রনস্তেইন), লেভ দাভিদভিচ ― সোশ্যাল-ডেমোক্রেট, রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পরে (১৯০৩) মেনশেভিক। ১৯০৫-১৯০৭ সালের বিপ্লব পরাজিত হবার পর লুপ্তিপন্থী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে (১৯১৪-১৯১৮) মধ্যপন্থী; যুদ্ধ, শান্তি আর বিপ্লবের প্রশ্নে লেনিনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালান। রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসে বলশেভিক পার্টিতে গৃহীত হন। অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে কয়েকটা দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। পার্টির সাধারণ নীতি, সমাজতন্ত্র নির্মাণের লেনিনীয় নীতির বিরুদ্ধে তীব্র উপদলীয় সংগ্রাম চালান, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিজয় অসম্ভব একথা প্রচার করেন। ১৯২৭ সালে ত্রতস্কি পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন, ১৯২৯ সালে সোভিয়েত বিরোধী কার্যকলাপের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে নির্বাসিত হন।
৪. প্লেখানভ, গেওর্গি ভালেন্তিনভিচ ― রুশ এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের বিখ্যাত কর্মী, রাশিয়ায় মার্কসবাদের প্রথম প্রচারক। রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পরে মেনশেভিকদের একজন নেতা।
৫. চের্নিশেভস্কি, নিকোলাই গাভ্রিলভিচ ― মহান রুশ বিপ্লবী গণতন্ত্রী ও কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী, পণ্ডিত, সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক, রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেসির একজন প্রখ্যাত পূর্বসূরি একজন বস্তুবাদী দার্শনিক।
৬. জনবাদী-সমাজতন্ত্রী ― ১৯০৬ সালে সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি পার্টির দক্ষিণপন্থী অংশ থেকে বেরিয়ে আসা পেটি বুর্জোয়া ত্রুদোভায়া সোৎসিয়ালিস্তিচেস্কায়া পার্টির (জনবাদী-সমাজতান্ত্রিক শ্রম পার্টি) সভ্য। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর জনবাদী-সমাজতন্ত্রী পার্টি সাময়িক বুর্জোয়া সরকারকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে, পার্টির সভ্যরা সরকারে স্থান নেয়। অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর জনবাদী-সমাজতন্ত্রীরা সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র ও সশস্ত্র হামলায় অংশ নেয়।
৭. দিৎসগেন, ইওসিফ (১৮২৮-১৮৮৮) ― জার্মান শ্রমিক, সোশ্যাল- ডেমোক্রেট, দার্শনিক, স্বাধীনভাবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে পৌঁছেন। মার্কস বলেন যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের উপলব্ধিতে কিছু ভুলচুক ও অযথার্থতা থাকলেও দিৎসগেন ‘বহু চমতকার, এবং শ্রমিকের স্বাধীন চিন্তাধারার ফল হিসেবে বিস্ময়কর কথা বলেছেন’।
৮. দিৎসগেন, ইউগেন (১৮২৮-১৮৮৮) ― ইওসিফ দিৎসগেনের (১৮২৮-১৮৮৮) পুত্র ও তাঁর রচনার প্রকাশক।
৯. আইনস্টাইন, আলবার্ট (১৮৭৯-১৯৫৫) ― বিখ্যাত বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ।
১০. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ‘দেশান্তরী সাহিত্য’ দ্রষ্টব্য।
১১. ভিপপার, রবার্ট ইউরয়েভিচ (১৮৫৯-১৯৫৪) ― ইতিহাসবিদ, মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
১২. আর্তুর দ্রেভস (১৮৬৫-১৯৩৫) ― আদি খ্রিস্টান ধর্মের জার্মান ঐতিহাসিক, খ্রিস্টের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব অস্বীকার করেন; তবে গির্জার আপ্তবাক্য ও ধর্মীয় কুসংস্কারগুলির সমালোচনা তিনি করেন ভাববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে।
১৩. তিমিরিয়াজেভ, আর্কাদি ক্লিমেন্তয়েভিচ (১৮৮০-১৯৫৫) ― আচার্য-অধ্যাপক, পদার্থবিদ্যা ও গণিতে ডক্টর, ১৯২১ সাল থেকে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) সভ্য।
১৪. হেগেল, গেওর্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ (১৭৭০-১৮৩১) — মহান জার্মান ভাববাদী দার্শনিক, ভাববাদী দ্বন্দ্ববাদ গড়ে তোলেন।
১৫. সালতিকভ-শ্যেদ্রিন, মিখাইল ইয়েভগ্রাফভিচ (শ্যেদ্রিন) (১৮২৬-১৮৮৯) — রুশ লেখক, স্যাটায়ারিস্ট।
১৬. সরোকিন, পিতিরিম আলেক্সান্দ্রভিচ (১৮৮৯-১৯৬৮) — সমাজতাত্ত্বিক, সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি, পেত্রগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

Leave a Comment

error: Content is protected !!