পার্টি শৃঙ্খলা (ইংরেজি: Party Discipline) সম্পর্কিত আলোচনা দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদে স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত। অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলাকে লেনিন মোকাবেলা করার জন্য শৃঙ্খলা ও ঐক্য বিষয়ে বহু মতামত প্রদান করেছেন। শৃঙ্খলা সংক্রান্ত লেনিনবাদী চিন্তা গড়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাবাদের চিন্তার সাথে সমন্বয় করে।
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি, সে সময় নাম ছিল সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি, গঠনের আগে প্রায়ই জার সরকার বিভিন্ন সংগঠনের শ্রেষ্ঠ কর্মীদের ধরে নিয়ে যেত; তাদের নির্বাসনে পাঠাত, শাস্তিমূলক কারাদন্ডে দন্ডিত করত।
পার্টি শৃঙ্খলা সম্পর্কে লেনিনবাদী ধারণা
একদিকে স্বৈরতন্ত্রী জার সরকারের নৃশংস অত্যাচারের আগুনের মধ্যেই পার্টিকে গড়ে তুলবার বিপদ যেমন ছিলই, তেমনি অন্যদিকে আরও বিপদ ছিলো এই যে অনেকগুলি স্থানীয় কমিটি ও তাদের সদস্যরা ছোটখাট স্থানীয় দৈনন্দিন কাজ ছাড়া কিছুই করত না, পার্টির ভেতরে সংগঠনগত ও মতাদর্শগত বিভ্রান্তিতে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছিল; তারা বিশ্বাস করত যে, ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্রীভূত পার্টি ছাড়াও কাজ চালানো বেশ সম্ভব।
কেন্দ্রীভূত পার্টি গঠন করতে হলে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলির এই পশ্চাৎপদতা, এই নিশ্চেষ্টতা ও সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ঘুরাবার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটাই সব ছিল না, পার্টির মধ্যে একটা বেশ বড় উপদল ছিল যাদের নিজেদের ছাপাখানা ছিল–রুশদেশে ‘রাবোচায়া মিসল’ (শ্রমিকদের চিন্তা) এবং বিদেশে ‘রাবোচায়া দেলো’ (শ্রমিকদের লক্ষ্য)। তারা মতের দিক হতে পার্টির মধ্যে সাংগঠনিক ঐক্যবোধের অভাব আর মতাদর্শগত বিভ্রান্তির প্রশংসা করত, এবং শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ ও কেন্দ্রীভূত পার্টি গঠনের পরিকল্পনাকে অপ্রয়োজনীয় ও কৃত্রিম বলত। তারাই হলো মার্কসবাদী এবং তাদের অনুবর্তী দল। সর্বহারা শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক পার্টি গঠনের পূর্বে ‘অর্থনীতিবাদীদের’ পরাজিত করা প্রয়োজন ছিল।
এই কাজে ও শ্রমিক শ্রেণির পার্টি গঠনের কাজে লেনিন নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কিভাবে শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ পার্টি গঠন করার কাজ আরম্ভ করতে হবে, এই সমস্যা নিয়ে নানা মত প্রচারিত ছিল। কেউ কেউ ভাবত যে, পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস আহ্বান করে পার্টি গঠনের কাজ আরম্ভ হোক। সেই কংগ্রেস স্থানীয় সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে পার্টি গড়তে পারবে।
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন এই মতের বিরোধিতা করেন। তাঁর মত ছিল এই যে, কংগ্রেস ডাকবার পূর্বে পার্টির লক্ষ্য ও আদর্শ সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করা দরকার, কি ধরনের পার্টি চাই তা নির্ধারিত হওয়া দরকার, ‘অর্থনীতিবাদীদের’ সঙ্গে যে অনৈক্য আছে তাকে নীতির দিক হতে পরিষ্কার দেখিয়ে দেওয়ার দরকার; পার্টির লক্ষ্য ও আদর্শ সম্বন্ধে ‘অর্থনীতিবাদী’ ও বিপ্লবী কমিউনিস্টদের মধ্যে মতের অনৈক্য যে আছে তা গোপন না করে পার্টিকে সোজাসুজি জানিয়ে দেওয়া দরকার; স্থানীয় সংগঠনগুলিকে এই দুটি মতের মধ্যে সুচিন্তিতভাবে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া দরকার। এই অপরিহার্য কর্তব্য প্রথমে সমাধা করার পরই পার্টি কংগ্রেস আহ্বান করা সঙ্গত ছিল। লেনিন ব্যাপারটিকে সোজাসুজি এইভাবে প্রকাশ করলেন,
‘ঐক্যবদ্ধ হবার পূর্বে এবং ঐক্যবদ্ধ হবার উদ্দেশ্যেই আমাদের অবশ্য কর্তব্য হবে প্রথমেই আমাদের পরস্পর বিরোধী মতামতের মধ্যে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট পার্থক্যের রেখা টেনে দেওয়া।’[১]
বিপ্লবী পার্টির শৃঙ্খলা সম্পর্ককে লেনিন বিবেচনা করতেন গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাবাদ বিষয়ক ধারনায়। ‘জনগণের ভেতরে, গণতন্ত্র কেন্দ্রিকতার সাথে সম্পর্কিত এবং স্বাধীনতা শৃঙ্খলার সাথে সম্পর্কিত’ [২] । লেনিন শৃঙ্খলা সম্পর্কে লিখেছেন,
“সর্বাগ্রে এই প্রশ্ন ওঠেঃ প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী পার্টির শৃঙ্খলা টিকে থাকে কিসে? তার যাচাই হয় কিসে? কিসে তা সংহত হয়? প্রথমত, প্রলেতারীয় অগ্রবাহিনীর সচেতনতা, তার বিপ্লবনিষ্ঠা, তার সহ্যশক্তি আত্মত্যাগ ও বীরত্বে। দ্বিতীয়ত, সর্বাগ্রে প্রলেতারীয়, কিন্তু সেই সঙ্গে অপ্রলেতারিয় মেহনতী জনের ব্যাপক অংশের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপনের, ঘনিষ্ঠতার এবং কিছুটা পরিমাণে, বলা যেতে পারে, মিশে যেতে পারার নৈপুণ্যে। তৃতীয়ত, এই অগ্রবাহিনী যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিচ্ছে তার সঠিকতায়, তার রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশলের সঠিকতায় ও এই শর্তে যেন ব্যাপকতম জনগণ তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই সে সঠিকতায় নিঃসন্দেহ হয়। এই শর্তগুলো ছাড়া বিপ্লবী যে পার্টি সত্যসত্যই বুর্জোয়ার উচ্ছেদ ও সমস্ত সমাজের রূপান্তর ঘটাতে কৃতসংকল্প এক অগ্রণী শ্রেণির পার্টি হতে সমর্থ, সে পার্টিতে শৃঙ্খলা কার্যকরী করা অসাধ্য। এই শর্তগুলো ছাড়া শৃঙ্খলা গড়ে তোলার চেষ্টা অবধারিত রূপেই পরিণত হয় ফাঁকা কথায়, বুলিতে, তামাশায়। আবার অন্যদিকে এ শর্তগুলো সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দেয় না। সেটা দেখা দেয় দীর্ঘ মেহনত ও দুঃসহ অভিজ্ঞতা থেকে; তা গড়ে তোলা সহজ হয় সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব থাকলে, যে তত্ত্বটা আবার আপ্তবাক্য নয়, বরং চূড়ান্ত রূপ পায় কেবল সত্যসত্যই গণ ও সত্যসত্যই বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপের ঘনিষ্ঠ সাযুজ্যে।”[৩]
এইভাবেই পার্টি শৃঙ্খলা সম্পর্কিত কমিউনিস্ট পার্টির নীতি গড়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাবাদ নীতিকে বিস্তারিতভাবে কাজে অনুশীলন করার মাধ্যমে।
তথ্যসূত্র
১. ভি আই লেনিন, সিলেক্টড ওয়ার্কস, কী করতে হবে, ইংরেজি সংস্করণ মস্কো, ১৯৪৭, প্রথম খণ্ড পৃ ১৬২।
২. মাও সেতুং, জনগণের ভেতরকার দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসার সমস্যা সম্পর্কে, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭
৩. ভি আই লেনিন, ‘কমিউনিজমে বামপন্থার শিশু রোগ’ চার ভাগে সম্পূর্ণ, চতুর্থ ভাগ, পৃষ্ঠা ১৪
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।