গ্রন্থ সমালোচনা:
বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা, অনুপ সাদি সম্পাদিত,
প্রকাশক: ইত্যাদি প্রকাশ, ৩৮/৩ বাংলাবাজার, ঢাকা ২০১০
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৪৮৮।
মূল্য: পাঁচশত পঞ্চাশ টাকা।
বর্তমানে আমাদের জাতি হাজারো সমস্যায় জর্জরিত । প্রগতিশীল কোনো শক্তির বিকাশ হচ্ছে না। রাজনৈতিক দিক দিয়ে জাতি অতিবাহিত করছে এক অন্ধকার সময়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় উত্তরণের আস্থাযোগ্য চেষ্টা কিংবা গণতন্ত্রের অনুশীলন জাতীয় জীবনে নেই। বাংলাদেশে গণতন্ত্র একটা আকাঙ্ক্ষা মাত্র যার বাস্তবায়নের কোনো যৌক্তিক পরিকল্পনাই নেই। সুস্থ গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা ও অনুশীলন যখন দুর্লভ তখন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা শীর্ষক এই সম্পাদিত গ্রন্থটির প্রকাশ অবশ্যই এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গণতন্ত্রের পথে যাত্রার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নতুন চিন্তার উন্মেষে এই গ্রন্থ সহায়ক হতে পারে ।
এ কথা সত্য যে, গণতন্ত্র বিষয়ে বাঙালির চিন্তা-চেতনা কিছুটা এগোলেও অনুশীলন মোটেই এগোয়নি। অনুশীলন না হওয়ার ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বাস্তবের স্পর্শ পায়নি, শুধুমাত্র অযৌক্তিক অবাস্তব আবেগ রূপেই থেকে গেছে। গণতন্ত্রের নির্বাচনসর্বস্ব ধারণা, রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, সামরিক শাসন, জরুরি অবস্থা ও দুর্নীতি আর বিদেশি শক্তিকে রাজনীতির অভ্যন্তরে ডেকে আনা ইত্যাদির ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ব্যহত হচ্ছে । গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও সামজ জীবনে প্রয়োগ করতে গেলে প্রয়োজন যথার্থ অনুশীলন। অনুশীলন হলো যুগপৎ চিন্তা ও কাজ। অনুশীলনেই গণতন্ত্র সফল হয়। এরই মধ্যে কেউ কেউ জাতীয় দায়িত্ববোধ থেকে চিন্তা প্রকাশ করেছেন। চিন্তার বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে বলা যায়, কেউ কেউ শুধু চিন্তার জন্য চিন্তা করছেন, কেউ কেউ নিজের চিন্তা দ্বারা পাঠকের ভেতরের সত্তাকে সমৃদ্ধ করবার চেষ্টা করেছেন, আর খুব কম সংখ্যক লেখক চিন্তাকে কর্মে রূপ দেয়ার জন্য চিন্তা করেছেন। এই তিন ধারার চিন্তা ছাড়াও বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার তুলনামূলকভাবে কিছু ভালো লেখা এই গ্রন্থে সম্পাদক বেছে নিয়েছেন। তবে দুর্বল লেখাও আছে ।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চিন্তা ও চর্চা সুস্থ ও স্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে না। গণতান্ত্রিক চিন্তারও রয়েছে নানামুখিতা। বিভিন্নতা মূলত দৃষ্টিভঙ্গির। আন্তরিকতাও কি সবার সমান? দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার ভূ-খণ্ডকে ঘিরে আমাদের গণতান্ত্রিক চিন্তার উন্মেষ ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
গত প্রায় চার দশক ধরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়নি এবং বাংলাদেশ কখনো প্রত্যক্ষভাবে কখনো পরোক্ষভাবে সামরিক শাসনে থেকেছে। এমতাবস্থায় বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার পরিচয় তুলে ধরার জন্য গ্রন্থ-সম্পাদনার মতো দুরূহ কাজ সম্পাদক অনুপ সাদি হাতে নিয়েছেন যা তার জাতীয় দায়িত্ববোধেরই পরিচয়। এই গ্রন্থে ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ ও ‘সর্বহারার গণতন্ত্র নিয়ে একপেশে লেখার পাশাপাশি মধ্যপন্থী লেখাগুলোও যথার্থ স্থান পেয়েছে। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকরণের সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে এই গ্রন্থের কোনো কোনো লেখা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তার পরেও মনে হয়, ভালো হত বাস্তবতা ভিত্তিক তিন ধারার (আওয়ামী, বিএনপি, জাতীয় পার্টি) রাজনীতির মূল্যায়নভিত্তিক লেখা যোগ করলে। আমার মনে হয়েছে, গ্রন্থটিতে মওদুদ আহমদের ও আরো দু’একজনের লেখা যোগ করা উচিত ছিল।
পশ্চাৎপদ দেশে শ্রমজীবীদের গণতন্ত্রের সমস্যা এবং বুর্জোয়াদের গণতন্ত্রের সমস্যা এক রকম নয়। কেন নয় তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বদরুদ্দীন উমর তাঁর প্রবন্ধে । কিন্তু তিনি মার্কসীয় দর্শনের পুরাতন কথার মধ্যেই সমাধানের পথ খুঁজেছেন যা বাংলাদেশের বেলায় বাস্তবসম্মত হয় না বলে কার্যক্ষেত্রে সুফল আনতে পারে না। যতীন সরকার তার প্রবন্ধে সত্যিকার বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উপায় নির্দেশ করতে গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের পিছুটানের প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন যা গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রগতির সবচেয়ে বড় অন্তরায়। যে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তিনি ভাবেন তারা তো শাসক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী। ক্ষুদ্র শাসক শ্রেণির বা ধনিক শ্রেণির সীমাবদ্ধতাই তাদেরও সীমাবদ্ধতা। সর্বজনীন কল্যাণে তারা চিন্তা করেন না। বাংলাদেশের বেলায় শাসক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা জনগণের গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এঁদের প্রধান অংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেবাদাস রূপে কর্মতৎপর। তাদের ভূমিকা বাংলাদেশে বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠারও অনুকূল নয়।
রাজনৈতিক নেতত্ব ছাড়া কোনো জাতি আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নতি অর্জনে সক্ষম হয় না। রাজনীতির সুস্থ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তখনই দানা বেঁধে উঠবে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ ও সর্বজনীন কল্যাণবোধ দৃঢ় রূপ লাভ করবে। ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠলে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকরণও সম্ভব হবে। জনজীবন অবশ্যই রাজনীতি-প্রভাবিত। বাঙালির গণতন্ত্র সবচেয়ে বেশি হোঁচট খায় তার রাজনৈতিক দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে। রাজনীতির দুর্বলতার কারণে দীর্ঘ কাল বাঙালি পরাধীন থেকেছে। কিন্তু জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক আগ্রহ সবসময় ছিল। ফলে সহজেই তাদেরকে গণতন্ত্রের নামে আবেগাপ্লুত করা সম্ভব হয়েছে। আবেগকে কাজে লাগিয়ে অনেক নেতা বাঙালির জাতীয় জীবনে অনেক মহৎ অর্জন সম্ভব করেছেন। তার পরেও গণতন্ত্রের অনুশীলনে ঘাটতি থেকে গেছে। এটি মূলত নেতাদেরই ব্যর্থতা। জনগণকে দায়িত্ব নিতে হবে। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর আধিপত্যবাদীদের বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে অধিক আগ্রহ দেখানো এবং রাজনীতিকে শুধুই ক্ষমতা লাভের প্রতিযোগিতায় পর্যবসিত করা গণতন্ত্রের একমাত্র লক্ষ বলে প্রচার করা হচ্ছে। কেবল ভোটসর্বস্ব কার্যক্রম দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বা গণতন্ত্রায়ন কখনোই সম্ভব নয়। ভোটাভুটি গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও উপায় সমূহের একটি মাত্র। অন্য উপাদানগুলোকে অবহেলা করার ফলে সবই ব্যর্থ হয়।
সংসদীয় গণতন্ত্রের সংস্কৃতি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা সংসদীয় সংস্কৃতি সৃষ্টির বড় উপায়। এই সদিচ্ছার বড় অভাব বাংলাদেশে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকরণে রাজনৈতিক দলসমূহের নেতিবাচক প্রভাবই বেশি। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি সৃষ্টির ব্যর্থতা ঐ সংসদকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। সংসদের পেছনে যেসব রাজনৈতিক দল সক্রিয়, সেগুলোতে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও গণতন্ত্রের অনুশীলন নেই।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চেতনা রূপ নিতে সক্ষম হয় না, কারণ কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষকেরা গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সাথে একীভূত হয় না। রাজনীতি শহরকেন্দ্রিক মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কৃষকদের চিন্তা-চেতনা খুবই পশ্চাতবর্তী। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের নামে তাদেরকে ব্যবহার করে মাত্র। সুবিধা আদায় করে নেয় শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকরণের আরেকটি বড় বাধা হলো রাজনৈতিক ভাবে মন্ত্রিপরিষদ যে নীতি নির্ধারণ করে, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়ে স্রেফ বসে থাকে। ফলে সমাজ জীবন সন্ত্রাসকবলিত হয়ে পড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় রাজনীতিবিদ ও আমলা উভয়ে মিলে দুর্নীতিতে মত্ত হয়। জনজীবনে উৎকণ্ঠা উদ্বিগ্নতা বেড়েই চলে। আহমদ শরীফ, এমাজউদ্দিন আমহদ, মাহবুর রহমান, মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, কবীর চৌধুরী এঁদের চিন্তায় দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকলেও লেখায় এসব বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছে।
আবদুল হকের নেতৃত্ব ও গণচেতনা’ প্রবন্ধটি গভীর চিন্তার পরিচায়ক। বর্তমান সময়ে বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয় লেখাটিকে যদিও এটা লেখা হয়েছে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ঠিক পরে—তখনকার বাস্তবতায়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দুটি প্রবন্ধের মধ্যে প্রথমটিতে সরস ভাষায় তিন দশকের গণতন্ত্রের রূপ ও প্রকৃতি আলোচিত হয়েছে আর অপরটিতে রয়েছে তাত্ত্বিক আলোচনা।
আমহদ ছফার ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শোভাযাত্রা’ প্রবন্ধে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকরণের সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতির কিছু বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করা হয়েছে। এস আমিনুল ইসলামের লেখায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়ন প্রসঙ্গটি গবেষণামূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশে তিনি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সঙ্ঘ, এনজিও ও বুদ্ধিজীবী চক্রের ভূমিকায় জোর দিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। এস এ মালেক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে বাধাগুলো উল্লেখ করেছেন।
মনজুরুল আহসান খান বুর্জোয়া গণতন্ত্রে পুঁজিবাদী সমাজের স্বরূপ এবং পাশাপাশি বুর্জোয়া রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সঙ্কট এবং ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেছেন। মফিদুল হক তার প্রবন্ধে গণতন্ত্রের প্রয়োগে বাস্তবতার দিকটি বিবেচনায় এনেছেন যা গুরুত্বপূর্ণ। মোহাম্মদ আরিফুজ্জামানের প্রবন্ধটিতে গণতন্ত্রের সমস্যা খতিয়ে দেখা হয়েছে এবং সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে বুর্জোয়াদের আঁতাতের সুযোগে কীভাবে আগ্রাসন বেড়ে চলছে, প্রবন্ধটিতে তার জ্বলন্ত উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। রেহমান সোবহান গণতন্ত্রের বিবর্তন ও স্তম্ভগুলো আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় গণতন্ত্রের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করেছেন আহমদ রফিক। শিবনারায়ণ রায় জনসাধারণকে সুসংস্কৃত করার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে দৃঢ়মূল করার কথা ভেবেছেন। তিনি বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার গুরুত্ব নির্দেশ করেছেন। শ্যামল চক্রবর্তী ও আরো যারা সর্বহারার গণতন্ত্রের কথা বলেছেন বা শ্রেণিসংগ্রামের বিজয়াভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন তাদের লেখায় চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বক্তব্যের স্পষ্টতা লক্ষণীয়। তাদের বক্তব্যের পরিচ্ছন্নতার সাথে বাংলাদেশ ও বাঙালির রাজনৈতিক বাস্তবতার ব্যবধান থাকায় এসব চিন্তা বাস্তবে কার্যকর হওয়ার পথে বাধার সম্মুখীন হয়। তা সত্ত্বেও বলা যায় রাজনৈতিক চিন্তার উৎকর্ষসাধনে লেখাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো নিয়ে রাজনীতিবিদদের বাস্তবসম্মত ভবিষ্যতমুখী আলোচনা সমালোচনা দরকার।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক চিন্তার বিভ্রান্তি, প্রায়োগিক রাজনীতিতে নগ্ন-সুবিধাবাদ ও পশ্চাৎপদতা প্রতিমুহূর্তে জনগণের জীবনযাত্রাকে পীড়ন করছে। উত্তরণের অভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যখন চরম অনাস্থা ও হতাশা বিরাজ করছে সেই সময়ে আবুল কাসেম ফজলুল হক তার লেখাটিতে বাংলাদেশকে জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার জন্য বাস্তবমুখী জনকল্যাণমুখী প্রজ্ঞানিঃসৃত প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট লক্ষ নির্দেশ বা পরিকল্পনাই গণতন্ত্রের অবলম্বন। কর্মপরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট কর্মনীতি। কর্মনীতি অনুশীলনের উপর নির্ভরশীল। অনুশীলনে গেলেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন কর্মপদ্ধতি ও কর্মপরিকল্পনা দরকার হয়। লক্ষ, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি বিকাশশীল পদ্ধতি যা সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। সেদিক থেকে ‘আটাশ দফা : বাংলাদেশে আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মনীতি’ একটি সৃষ্টিশীল কর্মপরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি—যা বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশে জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূলনীতিতে পরিণত হতে পারে। উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেলে আটাশ দফা হয়ে উঠতে পারে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা বা হক-ভাসানীর একুশ দফার মতো কার্যকর ও জনপ্রিয় কর্মসূচি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেলে জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের সুনির্দিষ্ট হাতিয়ার হয়ে উঠতে পরে এই বক্তব্য। এই বক্তব্য নিয়ে ভিন্নমত দেখা দিলে আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে মতৈক্যে পৌঁছা সম্ভব। বাংলাদেশে গতানুগতিক ধারার পরিবর্তে জনগণের গণতান্ত্রিক ধারা যারা কামনা করেন তাদের জন্য লেখাটিতে রয়েছে পর্যাপ্ত চিন্তার খোরাক।
ভভিষ্যতের বাংলাদেশ নির্মাণে এ গ্রন্থ সম্পর্কে শেষ কথা হলো, সমালোচকের কট্টর দৃষ্টির আড়ালে এই গ্রন্থটিতে এমন কিছু চিন্তা রয়েছে যেগুলো পাঠকের গণতন্ত্রভাবনাকে উদ্দীপ্ত করতে এবং চিন্তাশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। গ্রন্থটি বিশ্বস্ত পাঠকদের গভীরভাবে চিন্তা করতে উৎসাহিত করবে বলে আশা করি। এই গ্রন্থ প্রয়াসে সম্পাদকের মহত্ত্বের পরিচয় আছে। এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হননি, গণতন্ত্র সম্পর্কে উৎকৃষ্ট এমন আরো কিছু লেখা বাংলাদেশে এবং পশ্চিম বাংলায় আছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশের প্রয়োজনে সেগুলো নিয়ে প্রকাশিত হতে পারে আরো গ্রন্থ। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র নেই, গণতান্ত্রিক চিন্তা নেই, গণতন্ত্র নিয়ে আগ্রহ নেই; তবে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে শূন্যগর্ভ আলোচনার অভাব নেই। এই বাস্তবতার মধ্যে আলোচ্য গ্রন্থটির গুরুত্ব স্বীকার্য। গণতান্ত্রিক চিন্তার চর্চা বিকাশশীল থাকলে এবং চিন্তার সঙ্গে কাজের সংযোগ ঘটলে অবশ্যই তা সর্বজনীন কল্যাণের কারণ হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: গবেষক দিল আফরোজের এই সমালোচনাটি প্রধান সম্পাদক আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং সম্পাদক মিজান রহমান কর্তৃক ছোটকাগজ লোকায়ত-এর বর্ষ ২৭ সংখ্যা ২ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৯৩-৯৭ হতে সংগৃহীত এবং ফুলকিবাজ ডট কম পুনঃপ্রকাশিত।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।