অহিংসা বা গান্ধীবাদী অহিংসা (ইংরেজি: Nonviolence) হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে সামন্তবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও নিপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তির বিরোধীতাকারী এক প্রতিক্রিয়াশীল কৌশল।
অন্য অর্থে অহিংসা হচ্ছে প্রতিটি শর্তে নিজের এবং অন্যের ক্ষতি না করার ব্যক্তিগত অভ্যাস। এটি এমন বিশ্বাস থেকে আসতে পারে যে মানুষ, প্রাণী এবং/বা পরিবেশের ক্ষতি করা কোনও সাফল্য অর্জনের জন্য অপ্রয়োজনীয় এবং এটি সহিংসতা থেকে নিবৃত্তির সাধারণ দর্শনের কথা উল্লেখ করতে পারে। এটি নৈতিক, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক নীতিগুলির ভিত্তিতে হতে পারে তবে এর কারণগুলিও নিখুঁত কৌশলগত বা প্রায়োগিক হতে পারে।
অহিংসার “সক্রিয়” বা “সক্রিয়তাবাদী” উপাদান রয়েছে, এতে বিশ্বাসীরা সাধারণত রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন সাধনের উপায় হিসাবে অহিংসার প্রয়োজনীয়তা গ্রহণ করেন। সুতরাং, উদাহরণস্বরূপ, তলস্তীয় এবং গান্ধীবাদী অহিংসা উভয়ই সামাজিক পরিবর্তনের জন্য একটি দর্শন এবং কৌশল যা সহিংসতার ব্যবহারকে প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু একই সাথে এটি অহিংস পদক্ষেপকে (যাকে নাগরিক প্রতিরোধও বলা হয়) নিপীড়নের নিষ্ক্রিয় গ্রহণযোগ্যতার বিকল্প হিসাবে দেখায় বা এটা সশস্ত্র সংগ্রামের বিরোধীতা করে। সাধারণভাবে, অহিংসার সক্রিয়তাবাদী দর্শনের সমর্থকরা সামাজিক পরিবর্তনের জন্য তাদের প্রচারণায় এটার বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যার মধ্যে রয়েছে সমালোচনামূলক রূপের শিক্ষা এবং প্ররোচনা, গণ-অসহযোগ, নাগরিক অবাধ্যতা, অহিংস প্রত্যক্ষ সংগ্রাম এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক রূপের হস্তক্ষেপ।
গান্ধীবাদী অহিংসা
আইনজীবী হবার কারণে গান্ধী জনৈক মক্কেলের পক্ষে ওকালতি সূত্রে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে এশীয়দের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণ প্রত্যক্ষ করেন। সেখানেই গান্ধী তার রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কিত প্রচারমাধ্যম কথিত “অহিংস সত্যাগ্রহ” কর্মপদ্ধতির প্রথম প্রয়োগ ও পরীক্ষা করেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ অবধি দক্ষিণ আফ্রিকায় তার নেতৃত্বে চালিত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা ছিলো মূলত নিজের জমিদারির অহং এবং রাজনীতিতে ব্রিটিশদের সমকক্ষ হবার তার রাজনৈতিক চাল। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতের জমিদারদেরকে রাজনীতিতে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। তার কর্মপদ্ধতি ছিল মিথ্যা, অসত্য ও অবৈজ্ঞানিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত “অহিংস সত্যাগ্রহ”।[১]
অহিংস আন্দোলনের অপর নাম সত্যাগ্রহ। গান্ধী সত্যাগ্রহের পথ গ্রহণ করেন এই বিশ্বাসে যে অহিংসার অস্ত্র দিয়েই হিংসা দমন করা যায়। তিনি মনে করতেন স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণের শ্রেষ্ঠ পথ হচ্ছে অহিংসার পথ। তিনি বিশ্বাস করেন যে সহিংস সন্ত্রাসমূলক পন্থায় শান্তির রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তাঁর কথায়, “violent means will give violent Swaraj” যে স্বাধীনতা হিংসার পথে আসে তা বিশ্বের জন্যও বিপজ্জনক। গান্ধী অহিংসাকে পরম ধর্ম জ্ঞান করেছেন।[২]
তিনি ছিলেন প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক, যিনি মিথ্যাচার, অসততা, কপটতা এবং ভন্ডামোকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। বুকের মধ্যে জনগণের জন্য অনিঃশেষ ঘৃণার লালনকারী এই গান্ধী “অহিংসা”র প্রচার করে জনগণের উপরে জমিদার-পুঁজিপতি-উপনিবেশবাদীদের নির্যাতন নিপীড়নকে চাপিয়ে দেয়ার জন্য হেন কোনো ষড়যন্ত্র নাই যাতে অংশ নেয়নি।
গান্ধী যে অর্থনৈতিক কাঠামোর সুপারিশ করেন সেটা মূলত ছিলো গ্রামভিত্তিক, যেই গ্রাম হাজার হাজার বছর ধরে প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের ও পুরুষতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে টিকে ছিলো। বৃহৎ আধুনিক শিল্প, জাতীয়করণ, পুঁজিবাদ, নগরায়ণ এবং শ্রমের পরিবর্তে মূলধন নিবিড় যান্ত্রিক উৎপাদন প্রবণতার তিনি বিরোধী ছিলেন। ভারতের জনবহুলতা, বেকার সমস্যা, মন্থর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পক্ষে উপযোগী ব্যবস্থা হিসেবে তিনি গ্রাম-নির্ভর কুটির ও খাদি-শিল্প এবং বিকেন্দ্রিত বিধিব্যবস্থার সুপারিশ করেন। আর্থিক আত্মনির্ভরতা ও গ্রামীণ স্বয়ম্ভরতার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে চরকার উপযোগিতার কথা বলেন।
তার সমাজতত্ত্বকে অনেকে একপ্রকার নৈরাজ্যবাদ হিসেবে দেখেন। কারণ তিনি চাইতেন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত সমাজ, যে সমাজে জনগণের কোনো স্বাধীনতা থাকবে না। জনগণ হয়ে পড়বে কৌম প্রথার অধীন এক দাস। আলোকহীন সে-সমাজ অন্তর্মুখী, বহির্মুখী নয় এবং বড় ছোট পদাধিকারীদের কোনও রকম আদেশ কিংবা তাঁদের প্রতি আনুগত্যের অবকাশ সেখানে নেই। সবাই যে যার নিজের উপর কর্তৃত্ব করে এবং সমাজের কল্যাণে নিজেই নিজের ক্রিয়াকর্মের নিয়ন্তা।[৩]
অহিংসার ভিত্তিতে চালিত সমাজ গ্রামকেন্দ্রিক গোত্রাধিপতিদের নিয়ন্ত্রণে চালিত, সেখানে শান্তি ও মর্যাদার সঙ্গে লোকে স্বেচ্ছাসমবায়ে জীবন অতিবাহিত করে বলে তিনি এক আজগুবি চিন্তা করেছিলেন। গ্রামগুলোর সম্পদ লুট করেই যে স্বৈরতন্ত্রীরা নিপীড়ক হয়েছে গান্ধী নামক ধুরন্ধরটি তা বলতে চায়নি।
সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ ও বিপ্লবের বিরোধী এই লোক একদিকে কাজের স্বাধীনতা থাকা অন্যদিকে সম্পদের মালিকানা-প্রবৃত্তিমুক্ত তাঁর আজগুবি সমাজ গড়ে উঠবে বলে মিথ্যা প্রচার করেছেন। তিনি এমন এক প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ প্রচার করেছেন যাতে গ্রামে কৃষি ও কুটির শিল্প যেন কারিগর নির্ভর শ্রমবিভাজনমূলক এক বৈষম্যনির্ভর জীবিকা চালানোর উপায় হিসেবে টিকে থাকে। এই রকমের গ্রামীণ কৃষি ও কুটির শিল্পে ভারতের মতো দেশে জমিদার ও সম্রাটেরা যে হাজার হাজার বছর ধরে শোষণ চালিয়েছে, গান্ধী সেই নিপীড়ক সমাজ পুনরায় ফেরত আনতে চেয়েছিলেন।
তিনি মনে করতেন স্বাধীন ক্ষুদে মালিকানার কৌম সমাজে রাষ্ট্র, আদালত, জেলখানা, পুলিশ ইত্যাদি অবদমনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই, এইভাবে তিনি প্রচার চালিয়েছেন, কিন্তু প্রাচ্য ইতিহাসের অনিবার্য প্রয়োজনেই নরবলি, সতীদাহসহ অন্যান্য নিপীড়ন যে ভারতে তৈরি হয়েছিল, সেই রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে তিনি নিশ্চুপ থেকেছেন।
তিনি মনে করতেন, আদর্শ সমাজ একটা পরিবারের মতো হবে, যেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র কিংবা সমষ্টিবাদ প্রকট আকার ধারণ করবে না। অর্থাৎ পুঁজিবাদের একটি খারাপ দিক দেখলেও স্বৈরতন্ত্রের হাজারো বর্বর দিকগুলো তিনি বলতে নারাজ। তিনি কিছু ক্ষেত্রে সীমিত কর্মপরিধিসম্পন্ন কল্যাণ রাষ্ট্রের বিকল্প ব্যবস্থা সাময়িকভাবে অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন, যদিও টাটা বিড়লাদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে পার্টি চালাতে তার কখনই অসুবিধা হয়নি।
তথ্যসূত্র
১. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৯৮-৯৯।
২. সৈয়দ মকসুদ আলী, রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণ জানুয়ারি ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৯৫।
৩. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।