মানব প্রকৃতি বা মানুষের স্বরূপ (ইংরেজি: Human nature) তৈরির চেষ্টা করেছেন সেইসব দার্শনিক ও লেখকবৃন্দ যারা তাঁদের সমাজের ভেতরে থেকে নিজ শ্রেণির হয়ে কাজ করেছেন। এসব কারণে দাস সমাজের দার্শনিকেরা সেই দাসত্বকে নীতিসম্মতভাবে উপস্থাপন করেন, সামন্তবাদী সমাজে সামন্তবাদকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করেছেন। পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিকেই ন্যায্য হিসেবে কিছু দার্শনিক তুলে ধরেছেন। সমাজের প্রাধান্যকারী চিন্তাটি দাস, সামন্ত ও পুঁজিবাদকে রক্ষার জন্যই তৈরি করা হয়, ফলে বিভিন্ন সমাজের মানুষের স্বরূপ সেসব সমাজের চিন্তার উপরে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে।
কিছু মানুষের মেরুদণ্ড থাকে, কিছুর থাকে না। কিছু মানুষ নিজের মেরুদণ্ডকেই নিজের খুঁটি হিসেবে কাজে লাগায়। আর কিছু মানুষ অন্যের খুঁটির উপরে ভর করে বেঁচে থাকে। মানুষকে বিশ্লেষণ করা সবচেয়ে কঠিন।
মানুষ শুধু তার চারপাশ সম্পর্কে সচেতন হয় না, সে চারপাশকে পরিবর্তন করে, তার প্রয়োজনে। এই প্রয়োজন থেকে যে পরিবর্তন ঘটে তা মানুষেরই কাজে লাগে এবং মানুষকে এগিয়ে দেয়। মানুষ অন্যের কাছ থেকে প্রাপ্ত উন্নতির জন্য অন্যের উপর কৃতজ্ঞও থাকে। যেমন, আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন
“দিনে শতবার আমি নিজেকে এ কথাই স্মরণ করাই যে, আমার গোটা জীবনটাই নির্ভর করে আছে অপরের শ্রমের উপর_তাদের কেউ জীবিত, কেউ বা মৃত এবং তাদের কাছ থেকে যা আমি পেয়েছি ও আজো পাচ্ছি ঠিক সমানভাবেই তার প্রতিদান আমাকে অবশ্যই দিতে হবে।….
আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তা অপরে তৈরি করে, যে বস্ত্র পরিধান করি তাও অপরের প্রস্তুত, যে গৃহে বাস করি অপরেই তা নির্মাণ করে। অপরের দ্বারা জ্ঞান ও উপলব্ধির প্রায় সমস্ত অংশের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটেছে ভাষার মধ্য দিয়ে_ যে ভাষা অপরেই সৃষ্টি করেছে।”[১]
বাঙালি লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মানব প্রকৃতি ও মানুষের মহত্ত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, “মহত্ত্ব জিনিসটা কোথাও ঝাঁকে ঝাঁকে থাকে না। তাকে সন্ধান করে নিতে হয়। মানুষ যখন মহত্ত্বের সন্ধান করতে ভুলে যাবে তখন সে নিজেকে ছোট করে আনবে।”[২]
মানব প্রকৃতি সম্পর্কে অনুপ সাদির আলোচনা শুনুন
তিনি মানুষের অতিপ্রাকৃতিক শক্তির উপর বিশ্বাসের কারণ সম্বন্ধে বলেছেন “চিরদিন সংসারে অত্যাচারিত, পীড়িত, দুর্বল বলিয়া মানুষের সহজ অধিকার হইতে যাহারা সবলের দ্বারা প্রবঞ্চিত, নিজের উপরে বিশ্বাস করিবার কোনো কারণ যাহারা দুনিয়ায় খুঁজিয়া পায় না, দেবতা ও দৈবের প্রতি তাহাদেরই বিশ্বাস সবচেয়ে বেশি।”[৩]
সব মহান ব্যক্তিই মানুষকে বড় করতে চেয়েছেন এক্ষেত্রে একেক ব্যক্তির পথ একেক রকম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষকে বড় করার জন্য বলেছেন, “মনের চলাচল যতখানি, মানুষ ততখানি বড়। মানুষকে শক্তি দিতে হইলে মানুষকে বিস্তৃত করা চাই।”[৪]
তথ্যসূত্র
১. আলবার্ট আইনস্টাইন
২. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; ‘বাংলা সাহিত্যসভার বার্ষিক অধিবেশনে অভিভাষণ’ থেকে।
৩. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; পথের দাবি।
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; লোকহিত; কালান্তর।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।