সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতামত

সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ইংরেজি: Maulana Bhashani on Socialism) যে মত প্রদান করেন তা হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করবার পরবর্তী স্তর হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা। তিনি নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ভেতরে একটি সাযুজ্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন। সেই কারণে মওলানা ভোটবাজিকে অন্যান্য পাজী নেতাদের মতো চাপার জোরে ব্যবহার করেননি। মওলানা ভাসানী চাপাবাজদের গণতন্ত্র অপেক্ষা অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।

ভাসানীর মতে শোষিত জনগণের মুক্তি এবং কায়েমী স্বার্থচক্রের ধ্বংস ব্যতিরেকে গণতন্ত্র সার্থকতা লাভ করে না। অর্থাৎ, রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সাফল্যের পুর্বশর্ত অর্থনৈতিক গণতন্ত্র। তিনি কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতী, পিয়ন, আর্দালী প্রভৃতি শোষিত শ্রেণীর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। তার আন্দোলনের প্রধান বুলি ছিল: লাঙ্গল যার জমি তার। তিনি বলেন:

এই বিশ্বচরাচরে যা কিছু আছে এ সবেরই সার্বভৌম অধিকারী হচ্ছেন রাব্দুল আলামিন। আর মানুষ হলো এ দুনিয়ায় তার প্রতিনিধি খলিফা। এই ভিত্তিতেই জমির উপর মানুষর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে মানুষ লাঙল চালায় সেই জমির অধিকারী।[১]  

অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী একটি সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা তৈরি করেন। এই পরিকল্পনার সারমর্ম নিম্নে প্রদত্ত হলো:

এক. প্রতি গ্রামে কৃষক সমিতি, ইউনিয়ন কৃষক সমিতি এবং জেলা কৃষক সমিতি গঠনের মাধ্যমে ‘কৃষক মজুর রাজ’ কায়েম করতে হবে; 
দুই. দেশী-বিদেশী সর্বপ্রকার পুঁজি বিনা খেসারতে বাজেয়াপ্ত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে জাতীয়করণ করতে হবে; 
তিন. অবৈধ পথে যারা অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছে ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দিতে হবে; 
চার. ব্যাংক, বীমা, কুটিরশিল্প, বৃহৎ শিল্প, যানবাহন ইত্যাদি জাতীয়করণ করতে হবে; 
পাঁচ. শাসনতন্ত্রে প্রত্যেক ইউনিয়নকে একটি কেন্দ্র স্বীকার করে – সেটা পঞ্চায়েত বোর্ড হোক, সেই ইউনিয়নে যা উৎপাদন হবে বা মোট আয় (gross income) হবে তার মধ্যে সরকারের থাকবে শুধু পাঁচ ভাগ এবং বাকী ৯৫ ভাগ সেই কেন্দ্রকে দিতে হবে। সেই কেন্দ্রে যারা মেহনত দ্বারা ফসল উৎপন্ন করে অথবা কোন ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানা স্থাপন করে লভ্যাংশ অর্জন করে, একমাত্র তারাই হবে তার অংশীদার। যারা আঠারো বছর বয়সের কম অথবা পাঁচ বছর বয়সের উর্ধ্বে — মেয়ে হলে পঞ্চাশ বছরের উর্ধ্বে, তাদের পেনশন দিতে হবে। জীবিত থাকা পর্যন্ত তাদের খোরাক পোশাক-চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব পঞ্চায়েত বোর্ড গ্রহণ করবে। যারা নাবালক, নাবালিকা তাদের প্রতিপালনের জন্য এবং বৃদ্ধ, invalid, অন্ধ, পঙ্গু মজুরদের প্রতিপালনের জন্য নির্ধারিত হবে আয়ের শতকরা ত্রিশ ভাগ। এবং বাকী ৬৫ ভাগ income সেই পঞ্চায়েত বোর্ডের অধীনে যারা বাস করে – শুধু বাস করে না, শরীরে খেটে পরিশ্রম করে ফসল উৎপন্ন করে – সে মেয়ে বা পুরুষ হোক, তাদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা হবে।”[২]

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ইউরোপীয়, বিশেষত ফরাসি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রীরাও এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ চার্লস ফুরিয়ের-এর সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁর সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু সমবায়-পল্লী। সমবায়-পল্লীর যে রূপরেখা তিনি দিয়েছেন তা সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক, অবাস্তব। কিন্তু মওলানা ভাসানী আজীবন সাধারণ মানুষের কাছে কাছে ছিলেন যে কারণে তাদের জীবন সম্পর্কে তাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা ছিল। সাধারণ মানুষের কল্যাণার্থে তিনি একটি বাস্তবসম্মত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। যেহেতু পুঁজিবাদী সমাজে সমাজতন্ত্র প্রবর্তন করা একটি দুরূহ কাজ, সে কারণে মওলানা ভাসানী তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। 

তথ্যসূত্র:

১. সৈয়দ মকসুদ আলী, রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তায় উপমহাদেশ, বাংলা একাডেমী ঢাকা, দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণ, জানুয়ারি ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ১৯৭
২. সৈয়দ আবুল মকসুদ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী; বাংলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ, মে ১৯৯৪ ঢাকা পৃষ্ঠা-৪৫১।

রচনাকাল: ১২ এপ্রিল ২০২১, এসজিআর।

Leave a Comment

error: Content is protected !!