বিপ্লবের মার্কসবাদী তত্ত্ব হচ্ছে আজ পর্যন্ত উঠে আসা সব থেকে স্পষ্ট বৈপ্লবিক চিন্তা

বিপ্লবের মার্কসবাদী তত্ত্ব বা বিপ্লবের মার্কসীয় তত্ত্ব (ইংরেজি: Marxist theory of Revolution) সম্ভবত আজ পর্যন্ত উঠে আসা সব থেকে স্পষ্ট বৈপ্লবিক চিন্তা। মার্কসবাদীদের মতে বিপ্লব হলো একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যা সামাজিক পরিবর্তনের পথকে প্রশস্ত করে এবং যার মাধ্যমে শাসকশ্রেণির উচ্ছেদ ঘটে ও নতুন প্রগতিশীল শাসকশ্রেণির উদ্ভব ঘটে।[১]

উনিশ শতকের পুঁজিবাদী উৎপাদনের অমানবিক দিকটার ফলে কার্ল মার্কস তার জীবনের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে ব্যবস্থা উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে আন্দোলন করেন। বিপ্লবের উপর তার লেখা সম্ভবত উনিশ শতকের প্রথমার্ধের ইউরোপের বিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে অবিরাম লড়াই থেকে সৃষ্ট। 

মার্কসীয় চিন্তায় সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ায় সমাজের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন থেকে আসবে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বুর্জোয়া বিপ্লব উচ্ছেদ করে পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠা করবে। এই পর্যায়ের শ্রেণি সংগ্রামের ফলে ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করে পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হবে—মাঝে শ্রমিক শ্রেণির একনায়কতন্ত্রের একটা পর্যায় থাকবে। এটাই হচ্ছে বিপ্লবের মার্কসবাদী তত্ত্ব বা মার্কসীয় তত্ত্বের মূল কথা।

মার্কসবাদী চিন্তায় সামাজিক বিবর্তনের নিয়মেই সমাজে একদিন শ্রমিক শ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে, মার্কস বৈপ্লবিক কর্মসুচিও প্রস্তাব করেন। পুঁজিবাদী শ্রেণিকে যে বিপ্লব উচ্ছেদ করবে সেটিকে অন্য সব বিপ্লব থেকে পৃথক মনে করা হয়। এই বিপ্লব অবদমিত সংখ্যাগরিষ্ঠকে ক্ষমতায় আনবে। যে অবধারিত সামাজিক বিপ্লবের কথা মার্কস বলেন সেটির লক্ষ্য সমস্ত শোষণ ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা। বিপ্লব হবে শ্রেণি সংগ্রামের অনিবার্য ফল। বিপ্লবের প্রথম কাজ হবে শ্রমিক শ্রেণি দ্বারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্ট সমাজে পোঁছনো সম্ভব হবে না। মাঝে একটা সময়ে শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব প্রয়োজন হবে। সেই সময়ে মানুষের মন থেকে পুঁজিবাদী মানসিকতা দূর করা প্রয়োজন হবে।

বিপ্লবের মার্কসবাদী তত্ত্ব বিকাশে লেনিন

মার্কসের বিপ্লব সম্পর্কিত চিন্তাভাবনাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান ভি আই লেনিন। এটা মার্কসবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে তার অন্যতম বড় অবদান। লেনিনের মূল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল রুশ পরিস্থিতি আর সেই বিষয়ে তাত্ত্বিক বাখ্যা করতে গিয়ে মার্কসবাদী বিপ্লবী রণকৌশল গড়ে তোলেন। ১৯০৫-এ Two Tactics গ্রন্থে লেনিন শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের কথা বলেন।

বৈপ্লবিক সংগ্রামের ক্ষেত্র লেনিন বিপ্লবী দলকে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রণী ভূমিকা দেন। সেটিই একমাত্র শ্রমিক শ্রেণির হয়ে কথা বলবে ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিপ্লবী চেতনা নিয়ে আসবে। দলের সংগঠনের ভিত্তি হবে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাবাদ’। ‘গণতান্ত্রিক’ কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে পর্যন্ত সব সদস্য আলোচনায় অংশ নিতে পারবে; আর, ‘কেন্দ্রিকতাবাদ’ কারণ সংগঠনের লাইনের উপরের দিকে একবার সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে নীচের দিকের সদস্যরা তা মানতে বাধ্য থাকবে। এই ধাপে ধাপে সংগঠিত দল বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে।

বিপ্লবের মার্কসবাদী তত্ত্ব বিকাশে মাও সেতুং

বললে হয়তো ভুল হবে না যে রুশীদের মধ্যে দিয়ে চীনারা মার্কসবাদকে পায়। অক্টোবর বিপ্লব চীনাদের ওপর প্রভাব ফেলে। রুশ স্বৈরতন্ত্রকে উচ্ছেদ করায় বলশেভিক সাফল্য অনেক চীনা প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করে। সাধারণ ভাবে পাশ্চাত্যের দর্শন সম্পর্কে মোহভঙ্গ হওয়ায় চীনা বুদ্ধিজীবীরা বেশি করে মার্কসবাদের দিকে ঝোঁকে। ১৯২১-এ সাংহাই শহরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। তার তেরজন সদস্যরে মধ্যে মাও সেতুং ছিলেন।

১৮৯৩ সালে দক্ষিণ কেন্দ্রীয় চীনের হুনান অঞ্চলের শাওশান-এ মাও সেতুংয়ের জন্ম। শুরুতে তিনি আমূল সংস্কারবাদী জাতীয়তাবাদী ছিলেন, পরে মার্কসবাদী হয়ে চীনের কমিউনিস্ট দলকে জয়ের পথে নিয়ে যান। মাওবাদকে লেনিনবাদ ও সনাতন কিছু চীনা চিন্তাভাবনার সংমিশ্রণ হিসাবে দেখা যায়। মাওবাদের কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—

প্রথম, কৃষকদের উপর গুরুত্ব দেওয়া। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি মূলত কৃষক দল হিসাবে গঠিত হয়। আর, বিপ্লবে কৃষকদের সক্রিয় সহযোগিতা আবশ্যক মনে করা হয়। 

দ্বিতীয়ত, চেতনার উপর মাওবাদ গুরুত্ব আরোপ করে। মার্কসবাদ মুলত শ্রমিক শ্রেণির নীতি ছিল। ফলে কৃষকদের মধ্যে প্রলেতারিয় সামাজিক চেতনা গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল। পুঁজিবাদ পর্যায়কে সমাজতান্ত্রিক পর্যায়ের সঙ্গে যুক্ত করায় এটা বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়। ফলে উঠে আসে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধারণা।

তৃতীয়ত, গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে মাও-এর নীতি, যা ১৯৩০ সালে গড়ে তোলেন। বলা যায়, মাও সেতুংয়ের গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে রণনীতি মার্কসবাদের ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় অবদান। অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করার দীর্ঘমেয়াদী কৌশল। এ বিষয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে আছে Problem of Strategy in Guerrilla War Against Japan ও On Protracted War. দুটিই ১৯৩৮ সালে রচিত।

মনে রাখা দরকার বিপ্লব সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্ব কোনো বিশেষ দেশ বা বিশেষ কতকগুলি দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সর্বত্রই, আগে বা পরে, বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার কথা। সে দিক থেকে মার্কসীয় তত্ত্ব আন্তর্জাতিক। প্রথমবার সব জায়গার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক দেখা হয়। অর্থাৎ, মার্কসীয় দৃষ্টিতে বিপ্লবকে দেখতে হলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের দর্শন হিসেবে মার্কসবাদ, মার্কসবাদ, ভাষাপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৫২
২. দেবী চ্যাটার্জী, রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়সমূহ, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ১৩৬-১৩৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!