মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণির মুক্তির পদ্ধতি সংক্রান্ত মতবাদ

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ (ইংরেজি: Marxism-Leninism) হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণির মুক্তির পদ্ধতি সংক্রান্ত মতবাদ। সর্বহারা শ্রেণি তার সংগ্রামে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন ও স্তালিনের শিক্ষাবলী দ্বারা পরিচালিত হয়। সর্বহারা শ্রেণির এসব মহান শিক্ষক ও নেতারা এক শক্তিশালী হাতিয়ার নির্মাণ করেছেন। তাঁরা সৃষ্টি করেছেন ও বিকশিত করেছেন সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী তত্ত্ব।

পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণির সংগ্রামে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী শিক্ষাবলী তার পথনির্দেশক। পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত সকল দেশের শ্রেণি-সচেতন শ্রমিকের হাতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এক শক্তিশালী হাতিয়ার, আর সর্বহারা বিপ্লবের বিজয়ের পর সমাজতন্ত্রের সকল শত্রুর বিরুদ্ধে সফলভাবে আরো অধিক সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্যে তা শ্রমিক শ্রেণিকে পথ দেখায়, একটি পরিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলায় সুনিশ্চয়তা দানকারী সঠিক কর্মনীতি পালন করায় তা তাদের সক্ষম করে তোলে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে তারা মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রকে কাজে লাগায়।

বলশেভিক পার্টির প্রথম খসড়া কর্মসূচীর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ত্রিশ বছরেরও পূর্বে লেনিন লিখেছিলেন যে, মার্কসীয় তত্ত্ব

“…….. প্রথমবারের মতো সমাজতন্ত্রকে কল্পলৌকিকতা থেকে বিজ্ঞানে রূপান্তরিত করে, এই বিজ্ঞানের জন্যে এক দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে এবং যে পথ ধরে এই বিজ্ঞানকে তার সর্বদিক দিয়ে আরো অধিক বিকশিত ও উন্নত করার কাজে অগ্রসর হওয়া যায় সেই পথ নির্দেশ করে। মজুরী দিয়ে শ্রমিক খাটানো, শ্রম-শক্তির ক্রয়, কিভাবে জমি, কারখানা, খনি ইত্যাদির মালিক ক্ষুদ্র এক দল পুঁজিপতিদের দ্বারা লক্ষ-কোটি বিত্তহীন মানুষের দাসত্ব আড়াল করে রাখে, তার ব্যাখ্যা দান করে তা আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্তর্বস্তুকে উদ্ঘাটন করে দেয়। তা দেখিয়ে দেয় আধুনিক পুঁজিবাদের। সামগ্রিক বিকাশ কিভাবে বড় বড় প্রতিষ্ঠান দ্বারা ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস সাধনের দিকে ঝোঁক প্রদর্শন করে, সৃষ্টি করে এমন এক অবস্থা যা সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির এক সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব ও জরুরী করে তোলে। প্রচলিত আচার-পদ্ধতি, রাজনৈতিক কূট-কৌশল, ভণ্ডামিপূর্ণ আইন-কানুন ও বিভ্রান্তিময় শিক্ষা-দীক্ষার পর্দান্তরালে তা চিনতে শেখায় শ্রেণি-সংগ্রামকে, সকল ধরনের বিত্তবান শ্রেণিসমূহের সাথে বিত্তহীন জনগণের তথা সর্বহারা শ্রেণির সংগ্রামকে, যে শ্রেণি সকল বিত্তহীন জনগণকে নেতৃত্ব দেয়। বিপ্লবী, সমাজতন্ত্রী পার্টিগুলোর প্রকৃত করণীয় তা সুস্পষ্ট করে দেয়? সমাজের পুনর্গঠনের জন্যে পরিকল্পনার ফানুস তৈরি করা নয়, শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি বিধানের জন্যে পুঁজিপতি শ্রেণি ও তাদের অনুগত ভৃত্যদের ধর্মোপদেশ শোনানো নয়, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত আঁটা নয়, বরং সর্বহারা শ্রেণির সংগ্রাম ও এই সংগ্রামের নেতৃত্ব সংগঠিত করা, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো –  সর্বহারাশ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা।”[১]

মানব জাতির ইতিহাস অধ্যয়নের প্রতি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী মার্কসবাদই সর্বপ্রথম তুলে ধরে। বুর্জোয়া বিজ্ঞানীরা সমাজ-বিকাশের নিয়মাবলী ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। সমাজের ইতিহাসকে তারা নিছক বিরামহীন দৈব-ঘটনা পরম্পরা হিসেবে তুলে ধরেন যেখানে সেগুলোকে সংযোগকারী কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। মার্কসই প্রথম দেখিয়ে দেন যে, সমাজ-বিকাশ প্রাকৃতিক বিকাশের মতই নির্দিষ্ট অভ্যন্তরীণ নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু, প্রকৃতির নিয়মাবলীর বৈসাদৃশ্যে, মানব সমাজের বিকাশের নিয়মাবলী মানুষের ইচ্ছা ও কর্ম-নিরপেক্ষভাবে নয়, বরং, তার বিপরীতে, ব্যাপক জনসাধারণের কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়েই কার্যকর হয়। মার্কসবাদ আবিষ্কার করে যে, পুঁজিবাদের ধ্বংস আপনা-আপনি আসবে না, বরং তা কেবল আসতে পারে বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণির তিক্ত শ্রেণি সংগ্রামের ফলশ্রুতিতেই। যেহেতু সমাজ নির্দিষ্ট নিয়মাবলী অনুযায়ী বিকাশ লাভ করে বলে ধরে নেয়া যায়, সেহেতু শ্রমিক শ্রেণি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে এবং এই নিয়মাবলী পুঁজিবাদের স্থলে যাতে সমাজতন্ত্র নিয়ে আসে তার জন্যে বসে থাকতে পারে –  এই স্যোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক তত্ত্ব হচ্ছে মার্কসবাদের এক নির্জলা বিকৃতি। সমাজ বিকাশের নিয়মাবলী স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয় না। সমাজে নিয়ত ঘটমান শ্রেণি-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সেগুলো ধীরে ধীরে পথ করে নেয়। 

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী শিক্ষায় সজ্জিত সর্বহারা শ্রেণি নিশ্চয়তার সাথেই সমাজতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম পরিচালনা করে। সমাজ-বিকাশের নিয়মাবলী সে জানে; তার সংগ্রাম, তার কাজ-কর্ম, তার কর্মতৎপরতায় সে এসব নিয়মাবলী মেনে চলে, যা পুঁজিবাদের অনিবার্য ধ্বংস আর সমাজতন্ত্রের বিজয়ের দিকে চালনা করে।

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ নিপীড়কদের বিরুদ্ধে বঞ্চিতদের শ্রেণি-সংগ্রামকে উদ্ঘাটন করার শিক্ষা দেয়। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ শিক্ষা দেয় যে, বুর্জোয়া শ্রেণির ক্ষমতার উচ্ছেদ আর তার নিজের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী একমাত্র পথটি চালিত হয় সর্বহারা শ্রেণির দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শ্রেণি-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই। 

তথ্যসূত্র

১. লেনিন, সংকলিত রচনাবলী, ২য় খণ্ড, “আমাদের কর্মসূচী”, পৃঃ ৪৯১, রুশ সংস্করণ
২. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ১-২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!