বিশ্বজুড়ে মার্কসবাদ, মুক্তি কোন পথে

মার্কসবাদের উদ্ভব উনিশ শতকে হলেও বিশ শতকে এই মতবাদের প্রায়োগিক দিক জাজ্বল্যমানরূপে দেখা দেয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর একে একে ষোলটি রাষ্ট্র, পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মার্কসবাদী বিশ্বের বাস্তব উদাহরণ হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, চেকশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, আলবেনিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, কিউবা সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিশ্বজুড়ে মার্কসবাদ ও মার্কসবাদী দলগুলো ক্রমাগত বিস্তার লাভ করতে থাকে। কিন্তু অর্ধ শতক যেতে না যেতেই সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশসমূহের ভেতরে শুরু হলো আলোড়ন। ১৯৬০-এর দশকের মহাবিতর্কে দেশে দেশে মার্কসবাদী রাজনৈতিক দলগুলো ভাঙনের কবলে পড়লো। পরিশেষে পৃথিবীর প্রথম সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা করে সমাজতন্ত্রের পথ বর্জন করে। চিন্তা ক্ষেত্রে ঝড় শুরু হয়।

মার্কসবাদ বর্জনের ডাক দেয় সমগ্র পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব। এমনকি ইতিহাসের শেষ হয়েছে বলেও দুচারজন প্রচার করা শুরু করে। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বলেন ইতিহাস শেষ হয়ে গেছে এবং জর্জ বুশ সিনিয়র নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা কায়েমের কথা বলেন। নাইন এলিভেন দুটি বক্তব্যকেই বাতিল করে দেয় এবং ২০০৬ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কট নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার পতনের ইঙ্গিত দেয়। অনেকে বলতে থাকে মার্কসবাদের মাধ্যমে পৃথিবীর আদৌ পরিবর্তন সম্ভব নয়। মার্কসবাদীদের একাংশ খুঁজতে শুরু করে মার্কসবাদ অনুসৃত দেশগুলোতে যে অনুশীলন হয়েছিলো সেগুলো মার্কসবাদসম্মত ছিলো কী না। মার্কসবাদী বিশ্বের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে পুনরায় মার্কসবাদের দিকে নজর দিতেও আরম্ভ করে কিছু মানুষ। মার্কসবাদী পার্টিগুলোর ভেতরে আলোচনা-সমালোচনা-আত্মসমালোচনার হাওয়ায় সেগুলো বদলাতে থাকে।

১৯৯০ সালের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন, ইতিহাসের পরিসমাপ্তি আর সভ্যতার সংঘাতের ডামাডোলের মধ্যেও কিছু কিছু জায়গায় মার্কসবাদ বিকশিত হতে থাকে। একুশ শতকের প্রথম দশকে যেসব দেশে মার্কসবাদ প্রভাব বাড়াতে থাকে সেগুলো হচ্ছে পেরু, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, ফিলিপাইন এবং নেপাল। ১৯৯১ সালেও পেরুতে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদীগণ তাঁদের শক্তি বাড়িয়েছেন। একুশ শতকে ফিলিপাইন এবং নেপালে গণযুদ্ধ চালিয়েছেন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদীগণ। নেপালে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ সবচেয়ে প্রবল রাজনীতির ধারা। ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও মার্কসবাদীদের প্রচণ্ড দাপট। তবে এসব দেশের পার্টিগুলো মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদকে পার্টির রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে ঘোষণা করে। এছাড়াও যেসব পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে প্রচার করে সেগুলো বামপন্থি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে এবং লাতিন আমেরিকায় এসব বামপন্থি পার্টির গত দুই দশকে জনভিত্তি কিছুটা শক্তিশালী হতে দেখা গেছে। এসব প্রবণতা থেকে দেখা যায় মার্কসবাদের প্রতি নিপীড়িত জনগণের আকাঙ্খা ও আগ্রহ উঠতির দিকে। ফলে মার্কসবাদকে বাস্তবে উপেক্ষা করার মতো সময় এখনও আসেনি। এখনও অন্তত আমাদের চারদিকে মার্কসবাদের প্রবল প্রভাব বিরাজ করে। বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙা ছাড়া বিগত দেড়শ বছরে মার্কসবাদ কখনো পেছনে হাঁটেনি।

মার্কসবাদ একাধিক শতক জুড়ে দুনিয়ার মানুষকে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করে চলেছে। আমাদের দেশেও তার প্রভাব গভীরতর। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, এ অঞ্চলের অন্যান্য মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী দলসমূহ, সমাজ-গণতন্ত্রী ও সমাজতান্ত্রিক দলসমূহ এবং প্রগতিশীল ও বামপন্থি রাজনৈতিক দলসমূহ কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন মাত্রায় মার্কসবাদী আদর্শকে অনুসরণ করেন। দুনিয়াজোড়াই বিশেষত সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত দরিদ্র দেশগুলোর রাজনৈতিক দলসমূহের অভ্যন্তরে মার্কসবাদের প্রভাব আজো গাঢ়। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়ার মুক্তির লড়াই বা কিউবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোতে মার্কসবাদী রাজনীতির প্রবল প্রভাব রয়েছে। ইন্দোচীনের মুক্তি সংগ্রামে মার্কসবাদ ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে।

বিশ্ব মার্কসবাদী সাম্যবাদী আন্দোলনের ভূমিকা বৃদ্ধি হচ্ছে বর্তমান সামাজিক বিকাশের একটি নৈর্বক্তিক নিয়ম। যুগ যুগ ধরে যে শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখে এসেছে মানবসমাজ, সাম্যবাদীরাই সেটাকে বাস্তবরূপ দেবার পথ প্রদর্শন করেছেন। প্রায়োগিক দিক থেকে কেবল সাম্যবাদীরাই একটি শোষণহীন সমাজ নির্মাণকে বাস্তবায়ন করবার সামর্থ্য রাখে। এই সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে সারা দুনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিগুলো একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তিরূপে এগিয়ে আসে। আন্তর্জাতিকতাবাদ ও শান্তির জন্য সঙ্গতিপরায়ণ সংগ্রামের ফলে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনে নিশ্চিত হয় গণতান্ত্রিক ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে ভূমিকা রাখা এবং সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াইয়ে সকল শক্তির ঐক্যবদ্ধ হবার সুযোগ। গোটা দুনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিগুলো এভাবে শ্রমিক ও মেহনতিদের অধিকারের জন্য আন্দোলন এবং নিপীড়িত জাতি ও জনগণের ন্যায্য অধিকার আর আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনে সক্রিয় অবদান রাখতে পারে।

মার্কসবাদী সাম্যবাদী আন্দোলনের শক্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ। এই মতবাদের বহুকালের ইতিহাস তর্কাতীতভাবে দেখিয়েছে যে এটিই একমাত্র মতবাদ যা সামাজিক প্রগতিশীলতার সাধারণ পথের সঠিক নির্দেশদানে সক্ষম। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সাম্যবাদীগণ যে কোনো মূর্ত-নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে শ্রমিক শ্রেণিকে যথোচিত একটি পথ গ্রহণ করাতে পারে। এমনকি অতি সুকঠিন অবস্থাতেও বাস্তব জীবন যেসব প্রশ্ন তোলে তার সঠিক জবাব খুঁজে পায় তারা। কমিউনিস্ট পার্টি দুনিয়ায় একমাত্র শক্তি যার আছে বিপ্লবের জন্য, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের বিজয়ের জন্য সংগ্রামের বিজ্ঞানসম্মত রণনীতি ও রণকৌশল।

গত কয়েক হাজার বছরের বিভিন্ন চিন্তাধারার সমান্তরাল অবস্থান, তাদের ভেতরকার ওতঃপ্রোত সম্পর্কের ধারা মার্কসবাদে এসে একটা সামগ্রিক চিন্তার রূপ নিয়েছে। মার্কসবাদ তাই কেবল অর্থনীতি নয়, কেবল দর্শন নয়, কেবল রাজনীতি নয়, কেবল ইতিহাস চর্চাও নয়। মার্কসবাদ হচ্ছে মানব-মনীষার সংহতি, এক সামগ্রিক বিশ্বদর্শন। মার্কসবাদ একটি উন্নততর জীবনচেতনা। মার্কসবাদের লক্ষ্য সাম্যবাদী সমাজ, আবার তার থেকেও বড় অন্য কিছু। পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট যে বিভাজন, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ চলে আসছে সাম্যবাদী সমাজ হলো তার সমাপ্তি। প্রকৃত অর্থে মানুষের সত্যিকারের সভ্যতার সূত্রপাত হবে সাম্যবাদী সমাজ থেকে। সাম্যবাদ হলো এমন একটা পরিবেশ যেখানে মানুষের নানাবিধ ভাবনার প্রায়োগিক ক্ষেত্র হতে হবে পরিপূর্ণ।

বর্তমান পৃথিবী এমন এক পরিবেশের মধ্য দিয়ে চলেছে যেখানে প্রাচুর্য আর দারিদ্র, প্রেম আর বেশ্যাবৃত্তি, সাধুতা ও অপরাধ একত্রে অবস্থান করে মানুষের অন্তরকে নিরন্তর কলুষিত করে চলেছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন স্বাধীন চিন্তা নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখে হয়ে পড়ছে অকার্যকর। এই পরিবেশের পরিবর্তন, এই অবস্থার বদল, এই পরিস্থিতির অবসান ব্যতিরেকে শুভবুদ্ধির বিকাশ সম্ভব নয়। মার্কসবাদের সামনে তাই আসল প্রশ্ন হচ্ছে পরিবেশের বদল বা এককথায় সমাজ বদল। কীভাবে সমাজ বদলায়, কীভাবে এতোকাল সমাজ বদলেছে এবং ভবিষ্যতেই বা কীভাবে সমাজ বদলাবে তা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে জ্ঞান ও তার প্রয়োগের এক পাহাড় গড়ে তুলেছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ। সেই বিচার বিশ্লেষণ অ-মার্কসবাদী ভাবনা জগতের চেহারাটাও অনেক বদলে দিয়েছে। মার্কসবাদী চিন্তাচেতনা এতোদিনকার চিন্তাচেতনার গোড়া ধরেই নাড়া দিয়েছে।

মার্কসবাদ গোটা পৃথিবীকে যেভাবে আলোড়িত করেছে তাতে পৃথিবীর এমন কোনো দেশ বাদ নেই যেখানে মার্কসবাদী ভাবনার প্রবেশ ঘটেনি। উত্তরমেরুর গ্রিনল্যান্ড থেকে দক্ষিণমেরুর ফকল্যান্ড পর্যন্ত পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় যেখানেই মানুষ আছে সেখানেই এ-ভাবনার বিস্তার হয়েছে। এই গভীর ও বিস্তৃত চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুভাবেই। দেশে দেশে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষ ভাবছে, মার্কসবাদী মতাদর্শে নতুন সমাজ গঠনের কাজে এগিয়ে আসছে। এসব কাজ করতে গিয়ে মার্কসবাদ বহুধাবিভক্ত ও বহুমুখী ধারায় বিকশিত হয়েছে। ফলে এইসব চিন্তা ও কাজের মধ্যে কোন চিন্তা, কোন ধরনের কাজগুলো যে প্রকৃতপক্ষে মার্কসবাদী তা নির্ণয় করাও ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন চিন্তা, মতপার্থক্য ও দ্বন্দ্বে মার্কসবাদও বিভিন্ন দল, উপদল, গোষ্ঠীতে জটিল রূপ ধারন করেছে।

প্রয়োগের ক্ষেত্রে মার্কসবাদ যেমন বিভিন্ন দিকে তার শাখা বিস্তৃত করেছে তেমনি সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশসমূহের পতনের পর তার প্রয়োগ কিছুটা হলেও থমকে দাঁড়িয়েছে। অথচ প্রয়োগ ছাড়া শেষ পর্যন্ত মার্কসবাদী তাত্ত্বিক সত্যতার কোনো অর্থ থাকছে না। মার্কসবাদকে অন্ধ মতবাদ হিসেবে না দেখে এটাকে কর্মের পথনির্দেশক হিসেবে বলা হয়েছে। ফলে ‘জ্ঞান ও অনুশীলনের মধ্যে, জানা ও করার মধ্যে সম্পর্ক’ বিষয়ক সমস্যার সমাধান করেই কেবল মার্কসবাদের সঠিকটাকে জারি রাখা যায়। মার্কসবাদের বর্তমান সমস্যা হচ্ছে তত্ত্ব ও প্রয়োগের সেতু বন্ধনের সমস্যা, এবং প্রয়োগের প্রয়োজনে তত্ত্বের বিকাশের সমস্যা। মার্কসবাদী দর্শনকে প্রয়োগসম্মত করতে হলে মতান্ধতাবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের কবল থেকে মুক্ত করে তাকে কর্মের পথনির্দেশক হিসেবে উচ্চতর স্তরে উন্নীত করতে হবে।

মার্কসবাদী সাম্যবাদী আন্দোলন একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলন এবং সেই কারণে প্রতিটি পার্টি শ্রেণিগত, মতাদর্শগত ও প্রায়োগিক বিপ্লবের লক্ষ্যে আত্মীয়তার সম্পর্কে থেকে কাজ করে। সেই সঙ্গে প্রতিটি পার্টিই কাজ করে তাদের বিশেষ পরিস্থিতিতে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের প্রতিষ্ঠাতাগণ এই কথাই বারবার জোর দিয়েছেন যে শ্রমিক আন্দোলনের আন্তর্জাতিক নীতিকে কখনো পরিত্যাগ করা যাবে না। সাম্যবাদের শিক্ষকগণ মনে করতেন যে প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত বৈপ্লবিক শ্রমিক আন্দোলনের রণনীতি ও রণকৌশলগত ভিত্তি। তাই সাম্যবাদীগণ সমাজ বিকাশের নৈর্বক্তিক জ্ঞানকে প্রয়োগ করে প্রতিটি আলাদা দেশের মূর্ত-নির্দিষ্ট অবস্থা এবং সেদেশের ঐতিহ্যকে হিসাবে নিয়ে। জাতীয় পার্থক্যকে তারা বাড়িয়েও দেখে না, আবার উপেক্ষাও করে না। মার্কসবাদী এবং সাম্যবাদীদের প্রতিটি পদক্ষেপ হয় সমগ্রভাবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির হিসাব আর বিশ্ব বৈপ্লবিক মুক্তি আন্দোলনের কাছে দায়িত্বের চেতনা নিয়ে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন হলো স্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সংগ্রামী মৈত্রী, যারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ ও প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতার নীতি অনুসারে দুনিয়ার বৈপ্লবিক নবায়নের জন্য, শ্রমজীবীদের স্বার্থের জন্য একত্রে সংগ্রাম চালাচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষণে মার্কসবাদ রাজনৈতিক ও মানবিক মুক্তির যুগ্মগুরুত্ব উপস্থাপন করেছে। রাজনৈতিক মুক্তি কখনোই মার্কস-এঙ্গেলসের কাছে পূর্ণাঙ্গ মুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়নি এবং তাদের কাছে মানুষের সকল রকমের মুক্তিই হচ্ছে প্রলেতারিয়েতের মুক্তির শর্তাধীন। তাঁদের কাছে এই বিবেচনা ছিলো যে প্রলেতারিয়েত নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারলেই কেবল সব রকমের মুক্তি অর্জন সম্ভব। নতুবা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কথা বাগাড়ম্বর হয়েই থেকে যাবে। রাজনৈতিক মুক্তির ফলেই মানুষ স্বৈরাচারের দমনমূলক আধিপত্যের হাত থেকে বাস্তবে মুক্তি পেতে পারে, আর সরকারের কাজকর্মে শ্রেণি-আধিপত্য লুপ্ত হলে জনগণের মানবিক অধিকার বাস্তবে দেখা দেয়। বুর্জোয়া কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক মুক্তি নিঃসন্দেহে শ্রমিকশ্রেণির একটি বড়ো লাভ, তবে রাজনৈতিক মুক্তি এলেই মানবিক মুক্তি আসে না। এক সর্বাত্মক বিপুল সম্ভাবনাময় সাম্যবাদী বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতি হিসেবেই বাস্তবে মানবিক মুক্তি নিশ্চিত হতে পারে। চলমান অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শ্রেণিকাঠামোব্যবস্থার প্রগতিমুখি রূপান্তর না ঘটা পর্যন্ত মানবিক মুক্তির আরম্ভ ও বিকাশ কখনোই ফলপ্রসূ হতে পারে না।

মুক্ত বাজার আর অবাধ প্রতিযোগিতার অর্থনীতি এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্র বর্তমান দুনিয়ার সামনে কোনো মৌলিক পরিবর্তনের দিশা দেখাতে পারেনি। গণতন্ত্রের যতো রকমের ধারনা আজ পর্যন্ত বিবৃত হয়েছে তার কোনোটিই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জনগণের শাসন, নাগরিকের সম অধিকার, আইনের চোখে সকলের সমতা, সকল নাগরিকের সমান সুযোগ ইত্যাদি ধারনা টাকার ক্ষমতার কাছে ধরাশায়ী হয়েছে, ফলে এসব ধারনার কোনো বাস্তবসম্মত উদাহরণ দুনিয়ায় নেই। দাস, সামন্ত ও পুঁজিবাদী সমাজের জটিল শ্রেণিবিভাজনের ভেতরে গণতন্ত্রের যে ছিটেফোঁটা দেখা গেছে তা সবই উপর তলার গণতন্ত্র। ক্ষমতা ও অর্থ যার নেই, গণতন্ত্র তার কাছে কেবল কোনো ক্ষমতাশালী বা অর্থশালীকে সমর্থন করার অধিকার মাত্র। মুক্তবাজারের রাহুগ্রাসে ‘অবাধ নির্বাচন’, ‘মুক্ত সংবাদপত্র’ ও ‘স্বাধীন বিচারব্যবস্থা’ আজ আর কোনো অর্থ বহন করে না। গণতন্ত্র যখন পুঁজিবাদের জন্য পরিণত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ আর অস্ত্র বিক্রির মধুর প্রক্রিয়ায় তখন সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনে বিপ্লবী মার্কসবাদের গুরুত্ব এক বিন্দুও কমেনি।

তথ্যসূত্র

১. সমীরণ মজুমদার, মার্ক্সবাদ বাস্তবে ও মননে, স্বপ্রকাশ, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১ বৈশাখ ১৪০২, পৃষ্ঠা ৯-৩১।
২. সুজিত সেন, মার্কসবাদ তাত্ত্বিক রূপরেখা, মিত্রম, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ: জুন ২০০৯, ISBN: ৯৭৮-৯৩-৮০০৩৬-০০-৭.
৩. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] লিখিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত মার্কসবাদ গ্রন্থের ১৫৩-১৫৯ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরে ডট কমে ৩১ আগস্ট ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত। সেখান থেকে লেখাটি ১৫ জুলাই ২০২২ তারিখে ফুলকিবাজ ডট কমে পুনরায় প্রকাশ করা হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ১১ অক্টোবর ২০১৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!