মার্কসের দৃষ্টিতে মানুষ হচ্ছে প্রাকৃতিক ও মানবিক বিষয়ের কেন্দ্র

মানুষই হলো মার্কস এঙ্গেলসের জীবনবীক্ষার কেন্দ্রীয় বিষয়। বর্তমানকে বদলাবার প্রয়োজন তারা অনুভব করেছিলেন এই মানব প্রজাতির জন্যই। প্রাণী হিসেবে ‘মনুষ্য’ নাম প্রযুক্ত হলেও সামাজিক প্রাণী হিসেবে বা নৃতাত্ত্বিক অবস্থা থেকে বর্তমান মনুষ্য হিসেবে ‘মানুষ’ শব্দটি একই সাধারণ অর্থ প্রকাশ করে না।

কার্ল মার্কস প্রাকৃতিক ও মানবিক এই দুই অর্থে মানুষকে দেখেছেন। অর্থাৎ মার্কসের মানুষ ও তার মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকৃতিবাদ ও মানবতাবাদের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। একদিকে মানুষ প্রকৃতির অংশ, প্রাকৃতিক সত্তা, প্রকৃতিরই সৃষ্টি, বিবর্তনের পথে সক্রিয় ভাবে পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া গঠন-পুনর্গঠনের পথে নিজেকে গড়ে তুলেছে। এটিই তার প্রাকৃতিক সত্তা। অন্যদিকে মানুষ অনুশীলনী সত্তা (ইংরেজি: Being of Praxis) মানুষ নিজেকে গড়ছে আবার বদলাচ্ছে, আবার প্রকৃতি থেকে নিজেকে পৃথকও করছে; একই সাথে পারিপার্শ্বিক প্রকৃতিকেও বদলে ফেলছে। এভাবে সে প্রাকৃতিক শক্তিকে আরো বেশি করে তার নিয়ন্ত্রণাধীন করে এবং নতুন মানবিক পরিবেশ তৈরি করে। এই সম্পূর্ণ অবস্থাটাই মানবিক। এই দুই ক্ষেত্রেই মানুষ একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক ও ক্রিয়ার ফল। তাই মার্কসবাদ অনুসারে মানুষ হলো, প্রাক্সিস, একটি আন্তঃক্রিয়া।

মার্কসের মানব প্রকৃতি তত্ত্ব পুঁজিবাদের সমালোচনায়, তাঁর সাম্যবাদী ধারনায়, ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণায় এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। তাঁর কাছে মানব প্রকৃতি শুধু মানুষের চিন্তা, অনুভব বা কাজের বৈশিষ্ট্য নয়, তাঁর কাছে মানব প্রকৃতি হচ্ছে প্রজাতি সত্তা বা প্রজাতি সারমর্ম (জার্মান: Gattungswesen) এবং একই সাথে মানুষ হচ্ছে সামাজিক সত্তার প্রতিনিধি। এই মানুষ একই সাথে ব্যক্তি আবার সমগ্রও। সে বিশিষ্ট একক ব্যক্তি। সে সামাজিক সত্তার প্রতিনিধি। মার্কস বলেছেন,

মানুষ একটি প্রজাতি সত্তা তা শুধু এজন্য নয় যে হাতে কলমে এবং তত্ত্বে সে তার বিষয় হিসেবে প্রজাতিটিকে গ্রহণ করে (তার নিজের এবং একই সঙ্গে অন্যান্য জিনিসেরও),_ বা একে প্রকাশ করার আরেকটি পথ মাত্র। বরং এ কারণেও যে সে হচ্ছে সেই প্রজাতি সত্তা যে নিজেকে দেখে বাস্তব, জীবন্ত প্রজাতি হিসেবে, আরো কারণ সে নিজেকে দেখে সার্বিক আর তাই একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে।[১]

মানুষ ইতিহাসের পথেই আবির্ভূত। তার মৌলিক বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তমান এবং ভিন্ন ভিন্ন স্বরূপে আবির্ভূত। যেমন যৌন অনুভূতি অপরিবর্তনীয়, কিন্তু যৌন জীবন পরিবর্তনশীল। প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র ব্যক্তি, কিন্তু সামাজিক মানুষ হিসেবে তার সৃজনশীলতার দ্বারা অন্যেও সমৃদ্ধ হয়। মানুষ সর্বদা সৃজনশীল এবং মুক্তিপ্রবণ। শ্রমবিভাজন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, পুঁজির শোষণ, মিথ্যাচেতনা তার সত্তাকে বর্তমান ঐতিহাসিক স্তরে আবদ্ধ করে রেখেছে। পরিস্থিতি বদলালে নতুন মানুষ আবির্ভূত হবে।[২] সচেতন ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মানুষ অন্য প্রাণী থেকে পৃথক হয়ে উঠেছে। বাস্তব জীবনক্রমের মধ্য দিয়েই মানুষ সচেতন প্রজাতি সত্তা হয়ে উঠেছে। মার্কস লিখেছেন,

সচেতন জীবনক্রিয়া মানুষকে প্রত্যক্ষরূপে পশুর জীবন ক্রিয়া হতে পৃথক করে স্রেফ এজন্য নয় যে, মানুষ হচ্ছে প্রজাতি সত্তা। অথবা এটা শুধুই এজন্য যে, প্রজাতি সত্তা বলেই সে চেতন সত্তা, তার মানে তার নিজস্ব জীবন তার জন্য একটা বিষয়। তা শুধুমাত্র এই কারণে যে, তার ক্রিয়া হচ্ছে স্বাধীন ক্রিয়া। বিচ্ছিন্ন শ্রম এই সম্পর্কটাকে উলটে ফেলে। ফলে মানুষ শুধুমাত্র একটা চৈতন্য সত্তা বলেই সে তার জীবনক্রিয়া, প্রামাণিক সত্তাকে তার অস্তিত্ব রক্ষার নিছক একটা উপায় বানিয়ে ফেলে।

মানুষ তার ব্যক্তিগত ক্রিয়াশীলতা দ্বারা বস্তুসমূহের জগত সৃষ্টির কালে, অজৈব প্রকৃতির দিকে তার কাজে নিজেকে প্রমাণ করে চৈতন্যশীল প্রজাতি সত্তা হিসেবে। তার মানে এমন একটি সত্তা যা প্রজাতিসমূহকে নিজের প্রামাণিক সত্তারূপে বিবেচনা করে, কিংবা নিজেকে একটি প্রজাতি সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে।[৩]

মানুষ বলতে তা হলে কী বুঝি আমরা‒নৃতাত্ত্বিক মানুষ, সামাজিক মানুষ, অর্থনৈতিক মানুষ কিংবা কোনো আধ্যাত্মিক পবিত্র মানুষ। তার চেতনার স্বরূপই বা কী? মার্কসের কাছে মানুষ হয়ে যায় এক উৎপাদনশীল মানুষ এবং উৎপাদনের কর্মকাণ্ড তথা শ্রমকে মার্কস মানব প্রকৃতির মৌলিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেন। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে মিথষ্ক্রিক্রয়ার মূলে কাজ করে শ্রম। মানুষের শ্রম প্রকৃতিকে বদলায়, কেবল প্রকৃতিকে নয় শ্রমের দ্বারা মানুষ নিজেকেও বদলায়। মার্কসের মতে শ্রম একটি সামাজিক কর্মকাণ্ড, কারণ তা মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। কাজেই শ্রমের প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুটি দিক রয়েছে। এভাবে মানুষের শ্রমের ভূমিকা থেকে মার্কস এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, মানব প্রকৃতি অপরিবর্তনীয় বা চিরন্তন নয়।[৪] উৎপাদনের বিষয়টিই মানুষকে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করে। মানুষের কার্যাবলীর প্রায় সমস্ত দিকের উপরেই তার প্রভাব। কার্ল মার্কস বলছেন,

Man himself is the basis of his material production, as of any other production that he carries on. All circumstances, therefore, which affect man, the subject of production, more or less modify all his functions and activities, and therefore too his functions and activities as the creator of material wealth, of commodities. In this respect it can in fact be shown that all human relations and functions, however and in whatever form they may appear, influence material production and have a more or less decisive influence on it.[৫]

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষ সুসম্পূর্ণ অস্তিত্বসম্পন্ন কোনো সত্তা নয়। তার অস্তিত্ব অনবরত গড়ে ওঠার অনন্ত প্রক্রিয়ার চলমানতায়। জীবনক্রিয়াই মানুষকে প্রজাতি-চরিত্রের মধ্যে স্বতন্ত্র, মুক্ত বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে। তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে তাদের বৈষয়িক উৎপাদন কর্মকাণ্ডে। কার্ল মার্কস বলছেন,

মানুষ নিজে, যদি তাকে শ্রমশক্তির বিমূর্ত রূপ হিসেবে দেখা হয়, একটি প্রাকৃতিক সত্তা, একটি বস্তু, যদিও জীবন্ত ও সচেতন বস্তু, এবং শ্রম তার ভিতরকার এই শক্তির বহিঃপ্রকাশ।[৬]

মানুষ নিজেকে গড়ছে আবার বদলাচ্ছে, আবার প্রকৃতি থেকে নিজেকে পৃথকও করছে; একই সাথে পারিপার্শ্বিক প্রকৃতিকেও বদলে ফেলছে। এই সম্পূর্ণ অবস্থাটাই মানবিক। এই দুই ক্ষেত্রেই মানুষ একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক ও ক্রিয়ার ফল। তাই মার্কসবাদ অনুসারে মানুষ হলো, প্রাক্সিস, একটি আন্তঃক্রিয়া। প্রকৃতিকে বদলাতে গিয়ে মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটেছে। মানুষের চিন্তার উপর প্রকৃতিবিজ্ঞান ও দর্শনের পারস্পরিক প্রভাব ও এই দুটির সাথে মানুষের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে এঙ্গেলস লিখেছেন,

প্রকৃতি যেমন আছে তাই শুধু নয়, বিশেষত মানুষের দ্বারা প্রকৃতির পরিবর্তন সাধনই হচ্ছে মানবচিন্তার সব থেকে প্রয়োজনীয় ও অব্যবহিত ভিত্তি, এবং যে পরিমাণে মানুষ প্রকৃতিকে বদলাতে শিখেছে সেই পরিমাণে তার বুদ্ধিও বিকশিত হয়েছে।[৭]

প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কটি দ্বান্দ্বিক। প্রকৃতিবাদ বিশ্ব ইতিহাসের কর্মকে অনুধাবনে সমর্থ। মানুষ যে আত্মগত জগতের উপর নিভর্রশীল তা হলো বাইরের প্রকৃতিজগত এবং এই প্রকৃতিজগতই তার ভেতরে কর্ম স্পন্দন জাগিয়ে তোলে। মার্কস লিখেছেন,

মানুষ প্রত্যক্ষভাবে একটি প্রাকৃতিক সত্তা। প্রাকৃতিক সত্তা হিসেবে এবং এক জীবন্ত প্রাকৃতিক সত্তা হিসেবে সে একদিকে জীবনের প্রাকৃতিক ক্ষমতায়, জৈবনিক ক্ষমতায় সজ্জিত—সে এক সক্রিয় প্রাকৃতিক সত্তা। এই শক্তিগুলো তার মাঝে প্রবণতা এবং সক্ষমতা হিসেবে, প্রবৃত্তি হিসেবে অস্তিত্বশীল থাকে। অপরদিকে প্রাকৃতিক, শরীরী, সংবেদনগত নৈর্বক্তিক সত্তা হিসেবে সে জানোয়ার এবং বৃক্ষের মতোই যাতনা ভোগকারী, শর্তাবদ্ধ ও সীমাবদ্ধ সত্তা। তাই বলতে গেলে, তার প্রবৃত্তির সামগ্রীগুলো [objects] তার থেকে স্বাধীন সামগ্রী হিসেবে তার বাইরে বিরাজ করে, তবুও সেগুলো তার প্রয়োজনের সামগ্রী, এমন অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী যা তার ক্ষমতার চর্চা এবং নিশ্চয়তার জন্য অপরিহার্য। মানুষ এক শরীরী, জীবন্ত, বাস্তব, সংবেদনময়, নৈর্বক্তিক প্রাকৃতিক প্রাণশক্তিতে ভরপুর সত্তা—একথা বলা মানে তার সত্তা বা সে শুধু বাস্তব সংবেদনময় সামগ্রীতেই তার জীবন প্রকাশ করতে পারে। নৈর্বক্তিক, প্রাকৃতিক এবং সংবেদনময় হওয়া, এবং একই সময়ে কারোর বাইরে সামগ্রী, প্রকৃতি ও সংবেদন থাকা, বা তৃতীয় পক্ষের জন্য কারোর সামগ্রী, প্রকৃতি ও সংবেদনশীল হওয়া, একই কথা।[৮]

এই মানুষ নিছক প্রাকৃতিক সত্তাও নয়। মানুষ হিসেবে সে মানবিক সত্তাও। মানুষ প্রাকৃতিক এবং একই সাথে জীবনী শক্তির অধিকারী এক মূর্ত সত্তা, সক্রিয় সত্তা। প্রাকৃতিক ও জীবনী শক্তির বলেই মানুষ প্রকৃতির শক্তিকে জয় করে তা মানবিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারে। মার্কস লিখেছেন,

কিন্তু মানুষ শুধু প্রাকৃতিক সত্তা নয়, সে এক মানব প্রাকৃতিক সত্তা; মানে সে নিজের জন্য এক সত্তা এবং তাই সে এক প্রজাতি সত্তা; এবং সেটা তাকে তার সত্তায় এবং জানায় নিজেই নিশ্চিত ও বাস্তবায়িত করতে হয়। সেই ধারাবাহিকতায়, মানব সামগ্রী প্রত্যক্ষভাবে যে রকম নিজেদের জাহির করে সেভাবে তারা প্রাকৃতিক সামগ্রী নয়, মানব সংবেদনও তাদের তাৎক্ষণিক [immediate] ও নৈর্বক্তিক অস্তিত্বে মানব সংবেদনতা ও মানব বস্তুনিষ্ঠতা [objectivity] নয়। আত্মগত বা নৈর্বক্তিক কোনো বৈশিষ্ট্যেই প্রকৃতি মানব সত্তাতে অচিরেই যথার্থ হয়ে উপস্থিত হয় না।[৯]

মানুষ বিশিষ্ট একক ব্যক্তি, আবার সামগ্রিক সামাজিক অস্তিত্বও তারই মধ্যে প্রকাশমান। একজন বাস্তব একক মানুষ আবার মানব সমগ্রেও একই সাথে অস্তিত্বশীল, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সে সমাজের আত্মগত অস্তিত্বে বিরাজমান। সমাজের সামগ্রিক বিকাশ সেই প্রকৃত ব্যক্তির বিকাশই সূচিত করে আর এটি ঘটে সচেতন বা অসচেতনভাবে। মার্কস লিখেছেন,

মানুষের সামাজিক ইতিহাস হচ্ছে তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়নের ইতিহাস ভিন্ন কখনোই কিছু নয়, এ ব্যাপারে তারা সচেতন থাকুক আর নাই থাকুক।[১০]

ইতিহাসের প্রক্রিয়ায় মানুষ ক্রমশ তার ব্যক্তিস্বরূপকেই খুঁজে পেতে থাকে। এই ব্যক্তিস্বরূপ বিভিন্ন সমাজে ভিন্ন। যেমন সামন্ত সমাজ ভেঙে পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠায় সমাজের মূল উপাদান মানুষকে পালটে দিয়েছে। কিন্তু যে মানুষ দিয়ে নতুন সমাজের ভিত্তি গড়ে উঠলো সে হলো অহংসর্বস্ব মানুষ। মানব অধিকারের বিবেচনায় রাষ্ট্রের কাছে সে স্বীকৃতি পেল তার অহংসর্বস্বতার। মার্কস লিখেছেন,

তাই, মানুষ ধর্ম হতে মুক্ত হতে পারলো না, পেল ধর্মীয় স্বাধীনতা। সে সম্পত্তি হতে মুক্তি পেল না, পেল সম্পত্তির মালিক হওয়ার স্বাধীনতা। পেল না ব্যবসার অহংবাদ হতে মুক্তি, পেল ব্যবসার স্বাধীনতা।[১১]

পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের মুক্তি মূলত আইনি ব্যক্তিতে তার সংকোচন। পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মুক্তি হচ্ছে সিভিল সমাজের সদস্য হওয়া এবং অহংসর্বস্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া, যা এক বিচ্ছিন্ন মানুষ। এই অহংসর্বস্ব মানুষের সার্বিক মুক্তির প্রশ্নে মার্কস লিখেছেন,

বাস্তব, ব্যক্তি মানুষ যখন তার নিজের মাঝে অমূর্ত নাগরিকটিকে আবার দখল করে নিতে পারবে, তার প্রাত্যহিক জীবনে, তার সব কাজে, সব পরিস্থিতিতে ব্যক্তি মানবসত্তা হিসেবে সে যখন প্রজাতি-সত্তা হয়ে উঠতে পারবে, যখন মানুষ তার ‘নিজ ক্ষমতা’ সামাজিক ক্ষমতা হিসেবে চিনে নিতে, সংগঠিত করতে পারবে, আর তাই ফলস্বরূপ রাজনৈতিক ক্ষমতার আকারে আর নিজ হতে সমাজ ক্ষমতাকে আলাদা করবে না, কেবল তখনই মানব মুক্তি সম্পূর্ণ হবে।[১২]

শ্রমিকের শ্রমসৃষ্ট তাঁদের থেকে বিচ্ছিন্ন দ্রব্য উৎপাদনের ব্যাপারে মার্কসের ধারনাটি পুঁজির মধ্যে বিকশিত সবচেয়ে মৌলিক পয়েন্টগুলোর একটাতে ব্যক্ত হয়েছে, তিনি যাকে বলছেন, “পণ্য-পূজা” (ইংরেজি: the fetishism of commodities)। এরিখ ফ্রম তাঁর মার্কসের মানুষ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ‘পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ককে কতকগুলো জিনিসের গুণের সম্পর্কে রূপান্তরিত করে ফেলে, আর এই রূপান্তরই পুঁজিবাদী উৎপাদনে পণ্যের স্বভাব গঠন করে’।[১৩] মানুষ তার নিজ হাতে সৃষ্ট জিনিসের কাছে দাস হয়ে যায়। মার্কস লিখেছেন, ‘ধর্মে যেমন মানুষ তার নিজের মস্তিষ্কের সৃষ্টিগুলির দ্বারা শাসিত হয়, পুঁজিবাদী উৎপাদনেও তেমন সে শাসিত হয় নিজ হাতে সৃষ্টি করা জিনিসের দ্বারা’[১৪]। ‘যন্ত্রপাতি দূর্বল মানুষকেই যন্ত্র বানিয়ে ফেলতে নিজে মানুষের দূর্বলতার স্থানে জায়গা করে নেয়’[১৫]।

মানব সত্তা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিমানুষের মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। নানাবিধ সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেই তার পরিচয় মেলে। বাস্তবে মানুষ হচ্ছে ‘সামাজিক সম্পর্কের সম্মিলন’[১৬]। মার্কসের মতে, ইচ্ছা নিরপেক্ষভাবে মানুষের যে উৎপাদনশক্তি ও সামাজিক সম্পর্কের কাঠামো বর্তমান থাকে এবং যা ব্যক্তি মানুষের জীবন গড়ে তোলে তাই হলো মানব সত্তার ভিত্তি। কিন্তু মানুষ কোনো নিষ্ক্রিয় পদার্থ নয় যে উৎপাদন ব্যবস্থার আদলেই সে পুরোপুরি গড়ে উঠবে; সে এক সক্রিয় জীবন সত্তা, নিজেই নিজের ইতিহাস ও নিজের মুক্তির তত্ত্ব সৃষ্টি করে। মানুষের কাছে সব থেকে মূল বিষয় হলো মানুষ। মার্কস লিখেছেন,

সমালোচনার অস্ত্র নিশ্চয়ই পারে না, অস্ত্রটির সমালোচনার বদলি হতে; বস্তুগত শক্তিকে উচ্ছেদ করতে হয় বস্তুগত শক্তি দিয়েই। কিন্তু যে মুহূর্তে জনগণকে আকৃষ্ট করে সেই মুহূর্তেই ঐ তত্ত্বটি বস্তুগত শক্তিতে পরিণত হয়। তত্ত্ব জনগণকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় যেইমাত্র সেটা দেখায় যে কোনো ব্যক্তির কাছে উপযুক্ত প্রমাণ আর সেটা যে কোনো ব্যক্তির কাছে উপযুক্ত প্রমাণ দেখায় যেইমাত্র সেটা হয়ে ওঠে র‌্যাডিকাল। র‌্যাডিকাল হবার অর্থ হলো বিষয়টার মূলটাকে উপলব্ধি করা। কিন্তু মানুষের বেলায় মূলটা হলো মানুষ নিজেই। … মানুষ মানুষের কাছে সবচেয়ে সমুন্নত জীব। তাই প্রয়োজন সেই সমস্ত সম্পর্কের শর্তহীন উচ্ছেদ যেখানে মানুষ হয়ে রয়েছে হেয়, দাসে পরিণত, বিস্মৃত ও ঘৃণিত জীব।[১৭]

ফলে মানব প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসের ক্ষেত্রে আমরা পাবো বেশ কিছু ধারনা। মার্কসবাদে ন্যায়পরতার ধারনা, পুঁজিবাদী সমাজে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা এবং তার উৎপন্ন পণ্য থেকে বিচ্ছিন্নতার ধারনা এবং এই উভয়বিধ বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত মানুষের ধারনা_এসব মিলিয়ে মার্কসবাদে মানব প্রকৃতির ধারনা বা মানব প্রকৃতি তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। তবে মার্কসের তত্ত্ব শুধু মানব প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করেই ক্ষান্ত হয় না, এটি উৎখাত করতে নেমে পড়ে বর্তমানের মানব সমাজে বিদ্যমান এমন সকল রকম সম্পর্ক যেখানে মানুষ হয়ে রয়েছে হেয়, দাসে পরিণত, বিস্মৃত ও ঘৃণিত জীব। কেননা মানুষই মানুষের কাছে সবচেয়ে সমুন্নত জীব।[১৮]

তথ্যসূত্র:

১. কার্ল মার্কস, ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস ১৮৪৪, জাভেদ হুসেন অনূদিত, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১২, পৃষ্ঠা-৬৩।
২. সমীরণ মজুমদার, মার্ক্সবাদ বাস্তবে ও মননে, স্বপ্রকাশ, কলকাতা, ১ বৈশাখ, ১৪০২, পৃষ্ঠা ৩৭
৩. কার্ল মার্কস, ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস ১৮৪৪, জাভেদ হুসেন অনূদিত, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১২, পৃষ্ঠা- ৬৪। ইংরেজি বাক্যগুলোর লিংক: https://www.marxists.org/archive/marx/works/1844/manuscripts/labour.htm
৪. হারুন রশীদ, মার্কসীয় দর্শন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ১২৫ হারুন রশীদ, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ১২৫
৫. Karl Marx, Theories of Surplus Value, Part 1, Progress Publishers, Moscow, p. 288
৬. কার্ল মার্কস, পুঁজি, প্রথম খণ্ড, অধ্যায় আট, স্থির পুঁজি ও অস্থির পুঁজি, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, পৃষ্ঠা-২৫৬
৭. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১৪৬
৮. কার্ল মার্কস, ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস ১৮৪৪, অনু জাভেদ হুসেন, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ১৩৩-১৩৪। ইংরেজি বাক্যগুলোর লিংক: https://www.marxists.org/archive/marx/works/1844/manuscripts/hegel.htm
৯. দেখুন, কার্ল মার্কস, ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস ১৮৪৪, অধ্যায় হেগেলের দ্বান্দ্বিক ও সাধারণ দর্শনের পর্যালোচনা, জাভেদ হুসেন অনূদিত, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ১৩৫
১০. কার্ল মার্কস, প. ভ. আন্নেনকভ সমীপে চিঠি, ২৮ ডিসেম্বর ১৮৪৬, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১২৮
১১. কার্ল মার্কস, ইহুদি প্রশ্নে, ১৮৪৩, অনু জাভেদ হুসেন, সংহতি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯, পৃষ্ঠা ৫১
১২. কার্ল মার্কস, ইহুদি প্রশ্নে, ১৮৪৩, অনু জাভেদ হুসেন, সংহতি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯, পৃষ্ঠা ৫২
১৩. এরিক ফ্রম, মার্কসের মানুষ, মনোজ দে ও জাভেদ হুসেন অনূদিত, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা ৮৪
১৪. কার্ল মার্কস, পুঁজি, প্রথম খণ্ড, অধ্যায় ২৫, পুঁজিবাদী সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়ম, প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় অংশ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো পৃষ্ঠা-১৪৯
১৫. কার্ল মার্কস, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি ১৮৪৪, অধ্যায় ব্যক্তি সম্পত্তি শাসনের অধীনে এবং সমাজতন্ত্রে মানবিক প্রয়োজনসমূহ বুর্জোয়া সমাজে শ্রমবিভাগ, জাভেদ হুসেন অনূদিত, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ১০১
১৬. কার্ল মার্কস, ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমূহ, ৬ নং থিসিস, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় অংশ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৮৮
১৭. কার্ল মার্কস, Critique of Hegel’s Philosophy of Right, দেখুন, মার্কস ও এঙ্গেলস, ধর্ম প্রসঙ্গে; এনবিএ, কলকাতা; সেপ্টেম্বর, ২০০৪; পৃষ্ঠা ৩৮
১৮. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] লিখিত ভাষাপ্রকাশ থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত মার্কসবাদ গ্রন্থের ১০২-১১১ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং ৭ আগস্ট ২০১৭ তারিখে রোদ্দুরে ডট কমে প্রকাশ করা হয়। সেখান থেকে লেখাটি ২৪ জুন ২০২২ তারিখে ফুলকিবাজ ডট কমে প্রকাশ পুনরায় প্রকাশ করা হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ৬ আগস্ট ২০১৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!