লেনিনবাদী বলশেভিকবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (ইংরেজি: Leninist Bolsheviks Communist Party) হচ্ছে মার্কসবাদী পার্টি গঠনের উদ্দেশ্যে লেনিনীয় আদর্শে সজ্জিত বহুবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলশ্রুতিতে গঠিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সাম্যবাদী বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করবার লক্ষ্যে চালিত একটি কমিউনিস্ট পার্টি।
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদ, সংশোধনবাদ, অর্থনীতিবাদ, সংস্কারবাদ, নৈরাজ্যবাদ, মতান্ধতাবাদ ও বুর্জোয়া সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করে একটি বিপ্লবী মার্কসবাদী পার্টি গঠনে মনোযোগ ও অনুশীলন কেন্দ্রীভূত করেন। সেই লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন গ্রন্থে পার্টি গঠন সম্পর্কে বিতর্ক ও মতামতসমূহ উপস্থাপন করেন এবং অনুশীলনে সেসব কার্যকর করেন।
লেনিনবাদী পার্টি গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট
১৮৮৪-৯৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নারোদনিক মতবাদের ওপর বিজয় লাভ ও সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি গঠনের মতাদর্শমূলক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। ১৮৯৪-৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভিন্ন ভিন্ন মার্কসবাদী সংস্থাগুলিকে একটি সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টিতে গ্রথিত করার চেষ্টা হয়, অবশ্য সেটা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ঠিক পরবর্তি সময়ে পার্টির মধ্যেই মতাদর্শ ও সংগঠনমূলক বিভ্রান্তি বাড়িতে থাকে।
নারোদবাদের ওপর মার্কসবাদের জয়লাভ ও শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী কার্যাবলী মার্কসবাদীদের নীতির যথার্থতাকে প্রমাণ করে এবং মার্কসবাদের প্রতি বিপ্লবী যুব সমাজের সহানুভূতি আকৃষ্ট হয়। এমনকি মার্কসবাদ একটা ফ্যাসনে পরিণত হয়। ফলে মার্কসবাদী সংগঠনগুলিতে এমন সব তরুণ বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী দলে দলে প্রবেশ করতে লেগেছিল যারা মার্কসবাদ ভাল জানত না, রাজনৈতিক সংগঠন সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ ছিল এবং আইনি মার্কসবাদীদের যে সব সুবিধাবাদী লেখায় সংবাদপত্রগুলি বোঝাই থাকত সেগুলো হতে মার্কসবাদ সম্বন্ধে ভাসা-ভাসা ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুল ধারণা পোষণ করত। এতে মার্কসবাদী সংগঠনগুলির তত্ত্বগত ও রাজনৈতিক মানের অবনতি ঘটল, আইনি মার্কসবাদীদের সুবিধাবাদী ঝোঁকগুলি সংক্রমিত হতে লাগল এবং মতাদর্শগত ব্যাপারে বিভ্রান্তি রাজনীতির ক্ষেত্রে দোলায়মান ভাব এবং সংগঠন বিষয়ে অরাজকতা বেড়ে চলছিল।
শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান প্রবাহ এবং অদূরবর্তী বিপ্লবের অনিবার্যতা শ্রমিক শ্রেণির একটি সুসংহত ও কেন্দ্রীভূত পার্টি গঠনের দাবিকে জরুরি করে তুলেছিল। সেই সময়ে লেনিন এমন একটা পার্টির কথা ভাবছিলেন যা বিপ্লবী আন্দোলনকে পরিচালিত করবার ক্ষমতা রাখবে। কিন্তু স্থানীয় পার্টি সংগঠনগুলি, স্থানীয় কমিটি, দল বা চক্রগুলি এমনই শোচনীয় অবস্থায় ছিল, এবং তাদের সংগঠনগত অনৈক্য ও মতাদর্শগত বৈষম্য এত গভীর ছিল যে ঐরূপ পার্টি সৃষ্টির কাজ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল।
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাবাদ
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাবাদ হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সর্ববিধ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতিনির্ধারণ প্রণালী। এটি মূলত কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালন ব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক শাসন ও অর্থনীতি ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি এবং তত্ত্ব। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তাঁর কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে লেখায় কর্তৃত্বকে কেন্দ্রিকতাবাদ অর্থে ব্যাখ্যা করেছিলেন। এঙ্গেলসের মতে জটিল যন্ত্রপাতির বিকাশের সাথে সাথে কেন্দ্রিকতাবাদের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। আমরাও দেখি যান্ত্রিক বিকাশের সাথে সাথে কারখানা বা গবেষণাগার বা সংগঠনে কেন্দ্রিকতাবাদের গুরুত্ব অপরিসীম।
শৃঙ্খলা সম্পর্কে লেনিনবাদী পার্টি নীতি
পার্টি শৃঙ্খলা (ইংরেজি: Party Discipline) সম্পর্কিত আলোচনা দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদে স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত। অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলাকে লেনিন মোকাবেলা করার জন্য শৃঙ্খলা ও ঐক্য বিষয়ে বহু মতামত প্রদান করেছেন। শৃঙ্খলা সংক্রান্ত লেনিনবাদী চিন্তা গড়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাবাদের চিন্তার সাথে সমন্বয় করে।
বিপ্লবী সাম্যবাদী প্রচারণা
সাম্যবাদী প্রচারণা হচ্ছে রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রভাব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কমিউনিস্ট পার্টি ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন দ্বারা বিপ্লবী সাম্যবাদী মতাদর্শ প্রচারণা ও গঠনের উদ্দেশ্যে পার্টি পরিচালিত প্রচারমাধ্যমের কার্যকলাপ। ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী পার্টি গঠনের পথ অনুসরণ করে লেনিন বললেন যে, শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক পার্টি গঠনের কাজ শুরু করতে হলে সারা রুশদেশ জুড়ে একটি জঙ্গি রাজনৈতিক সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এই সংবাদপত্র বিপ্লবী সোস্যাল ডেমোক্রাসির মতবাদের স্বপক্ষে প্রচার আন্দোলন চালাবে; এই সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করাই হবে পার্টি গঠনের প্রথম ধাপ।
কমিউনিস্ট পার্টির গঠন ও কাঠামো
পার্টির কাঠামো ও গঠন সম্বন্ধে লেনিনের মত ছিল এই যে, পার্টির দুটি অংশ থাকবে: (ক) পার্টির নেতৃস্থানীয় নিয়মিত কর্মীদের নিয়ে একটি ঘনিষ্ঠ চক্র–এখানে প্রধানত সেই ধরনের কর্মীরা থাকবেন যাঁরা পেশাদার বিপ্লবী, অর্থাৎ এমন পার্টি কর্মী যারা পার্টির কাজ ছাড়া আর কিছু করেন না এবং যতটুকু থাকা দরকার অন্তত ততটুকু মার্কসবাদী জ্ঞান, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সংগঠনের অভ্যাস এবং জারের পুলিসের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ও এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন, (খ) স্থানীয় পার্টি সংগঠগুলির সুবিস্তৃত জাল এবং বহু সংখ্যক এমন পার্টি সভ্য যাঁরা লক্ষ লক্ষ মেহনতকারী জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন ভোগ করেন। লেনিন লিখেছিলেন,
‘আমি জোর করে বলছি যে, (১) ধারাবাহিকতা রক্ষা করবার জন্য যদি নেতাদের কোনো স্থিতিশীল সংগঠন না থাকে তা হলে কোনো বিপ্লবী আন্দোলনই স্থায়ী হয় না; (২) জনগণ যতই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অধিক সংখ্যায় সংগ্রামের দিকে আকৃষ্ট হয় ….. ততই ঐরূপ সংগঠনের প্রয়োজন আরও গুরুতর হয়ে ওঠে, এবং ততই সংগঠনকে আরও মজবুত করবার দরকার হয়; (৩) যে সমস্ত লোক বিপ্লবকেই তাদের জীবনের একমাত্র পেশা বলে মেনে নিয়েছে প্রধানত তারাই এই সংগঠনে থাকবে; (৪) একটা স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমরা এই সংগঠনের সভ্যসংখ্যা যত বেশি পেশাদার বিপ্লবী এবং যারা বিপ্লবী কাজ কর্মে পুলিশকে প্রতিহত করতে অভ্যস্ত ও সুকৌশলী, তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারি, ততই রাজনৈতিক পুলিশের পক্ষে এই সংগঠন ধ্বংস করা দুঃসাধ্য হবে; এবং (৫) শ্রমিক শ্রেণি সমাজের অন্যান্য শ্রেণির জনগণ ততই বেশি সংখ্যায় আন্দোলনে যোগ দিতে ও সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারবে।’[১]
কি করতে হবে
মার্কসবাদের সৃজনশীল অনুসারী হিসেবে লেনিন মার্কসবাদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহকে খুঁজে বের করেন, সার সংকলন করেন এবং একটি পরিকল্পনা পেশ করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বলশেভিক ধরনের পার্টি গঠনের ভিত্তি গড়ে ওঠে। লেনিন ‘অর্থনীতিবাদীদের’ সুবিধাবাদী নীতির সমালোচনা করেন। লেনিনের পরিকল্পনার স্বপক্ষে ‘ইসক্রা’র সংগ্রাম দীর্ঘমেয়াদে পরিচালিত হয়। ফলশ্রুতিতে আমরা পাই লেনিনের বই কী করতে হবে? যা মার্কসবাদী পার্টির মতাদর্শগত বুনিয়াদ।
বিপ্লবী কাজকর্মের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত থাকার কারণে লেনিনের মনে এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে বিপ্লবকে সফল করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়ােজন, আর এর জন্য প্রয়ােজন হয় একটি রাজনৈতিক দলের।
১৯০২ সালে লেনিন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন এবং কী করতে হবে গ্রন্থে দলের কার্যাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন, এখানে স্বতঃস্ফূর্ততা ও সচেতনতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। লেনিন বলেছেন সুসংগঠিত দল তৈরি করতে হলে প্রয়োজন মতাদর্শের। এই মতাদর্শ যে শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করবে এমন কোনো কথা নেই, রাজনৈতিক মতাদর্শ শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে প্রচার করতে হবে। মতাদর্শের প্রতি অখন্ড আনুগত্য ছাড়া বিপ্লবকে সফল করে তোলা যায় না। সুরতাং দল গঠন তাকে পরিচালনা করা এবং বাস্তব অবস্থায় তৎপরতার সৃষ্টির ব্যাপারে স্বতঃস্ফূর্ততার কোনো ভূমিকা নেই।[২]
অর্থনীতিবাদ বিরোধী সংগ্রামে লেনিনবাদী পার্টি
অর্থনীতিবাদ বিরোধী সংগ্রাম হচ্ছে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বলশেভিকবাদী কমিউনিস্ট পার্টির একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য যা পার্টিকে রাজনৈতিক সংগ্রামে দক্ষ করে। অর্থনীতিবাদকে পরাজিত করে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে কমিউনিস্ট পার্টি কাজ করে থাকে। যেসব সংগঠন কেবলমাত্র অর্থনীতিবাদী কাজে ব্যাপৃত থাকে সেগুলোকে সাধারণভাবে সংস্কারবাদী ও সুবিধাবাদী সংগঠন বলা হয়ে থাকে।
তথ্যসূত্র
১. ভি আই লেনিন, সিলেকটেড ওয়ার্কস, কী করতে হবে, রুশ সংস্করণ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৫৬।
২. গোবিন্দ নস্কর, Political thought, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ৩৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।