মাক্সিম গোর্কির কাছে

… [১] ঈশ্বর, ঈশ্বরপ্রতিম সংক্রান্ত প্রশ্নে এবং সেটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুতে আপনার মতাবস্থানে একটা স্ববিরোধ আছে ― আমার মনে হয় সেই একই স্ববিরোধ যেটাকে আমি দেখিয়ে দিতাম কাপ্রি-তে আমাদের শেষ বার দেখা হবার সময়ে আলাপের মধ্যে। ‘ভপেরিওদপন্থা’র[২] মতাদর্শগত ভিত্তিটাকে লক্ষ্য না করেই আপনি ‘ভপেরিওদ’-ওয়ালাদের সঙ্গে কাটান-ছিঁড়েন করেন (কিংবা কাটান-ছিঁড়েন করেন বলে মনে হয়)।

সেই একই ব্যাপার ঘটেছে এখন। আপনি ‘ত্যক্তবিরক্ত’ ― আপনি এইভাবে লিখেছেন ― ‘বুঝতে পারি নে আপাতত কথাটা ঢুকে পড়ল কিভাবে’, অথচ তার সঙ্গে সঙ্গে আপনি সমর্থন করছেন ঈশ্বর আর ঈশ্বর-গঠন সংক্রান্ত ধারণা।

‘ঈশ্বর হলো গোষ্ঠীর, জাতির, মানবজাতির গড়ে-তোলা সেইসব ধ্যানধারণার সাকল্য যা জাগিয়ে তুলে সংগঠিত করে এমন সামাজিক অনুভব যার লক্ষ্য হলো সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিকে সংযুক্ত করা এবং জান্তব ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের রাশ টেনে ধরা।’

এই তত্ত্বটা স্পষ্টতই বগদানভ[৩] এবং লুনাচারস্কি-র[৪] তত্ত্ব বা তত্ত্বদ্বয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

এটা স্পষ্টতই ভ্রান্ত, স্পষ্টতই প্রতিক্রিয়াশীল। খ্রীষ্টান সমাজতন্ত্রীদের (সবচেয়ে নিকৃষ্ট রকমের ‘সমাজতন্ত্র’, সমাজতন্ত্রের নিকৃষ্টতম বিকৃতি) মতো আপনি এমন একটা প্রণালী ব্যবহার করছেন যাতে (আপনার পরম শুভেচ্ছা সত্ত্বেও) পুনরাবৃত্ত হচ্ছে পাদরিদের ভেলকিবাজি: ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণা থেকে আপনি বাদ দিচ্ছেন এমন সবকিছু যা ঐহিতাসিক এবং বাস্তব জীবন থেকে উদ্ভূত (ময়লা, বদ্ধধারণা, পূত অজ্ঞতা আর হীনতা একদিকে, আর ভূমিদাসপ্রথা এবং রাজতন্ত্র অন্য দিকে), আর ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণায় ইতিহাস আর জীবনের বাস্তবতার বদলী হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে একটা মৃদু পেটি-বুর্জোয়া বুলি (ঈশ্বর = ‘যেসব ধ্যানধারণা জাগিয়ে তুলে সংগঠিত করে সামাজিক অনুভব’)।

সেটা করতে গিয়ে আপনি ‘শুভ এবং সদয়’ কিছু বলতে চেয়েছেন, দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন ‘সত্য আর ন্যায়’ এবং এইরকমের অন্যান্য জিনিস। কিন্তু আপনার শুভেচ্ছা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, একটা আত্মগত ‘নিষ্পাপ কামনা’ হয়েই থেকে গেছে। একটা কিছু লিখে দিলে সেটা চলে যায় জনসাধারণ্যে, তখন সেটার তাৎপর্য নির্ধারিত হয় লেখকের শুভেচ্ছা দিয়ে নয়, বিভিন্ন সামাজিক শক্তির পরস্পর-সম্পর্ক দিয়ে, শ্রেণিতে-শ্রেণিতে নৈর্বক্তিক সম্পর্ক দিয়ে। সেই সম্পর্কের কারণে দেখা যাচ্ছে (আপনার ইচ্ছা নির্বিশেষে এবং আপনার চৈতন্য থেকে অনপেক্ষভাবে) আপনি একটা খাসা রঙ আর সুমিষ্ট পোঁচ লাগিয়ে দিয়েছেন ক্লেরিকালদের, পুরিশকেভিচ[৫]-দের, ২য় নিকোলাই[৬]-দের আর স্ত্রুভে[৭]-দের ধারণার উপর, কেননা কার্যক্ষেত্রে ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণাটা মানুষকে দাসদশায় রাখতে তাঁদের সহায়ক। ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণাটাকে দেখতে সুন্দর করে তুলে আপনি সুন্দর করে দেখিয়েছেন অজ্ঞ শ্রমিক আর কৃষকদের তারা যেটা দিয়ে বেঁধে রেখেছে সেই শৃঙ্খলটাকে। এই তো ― পাদরি অ্যান্ড কোং বলবে ― কী খাসা, প্রগাঢ় এই ধারণাটা (ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণা), দেখুন গণতন্ত্রীমশাইরা, যা আপনাদের নেতারা পর্যন্ত মানেন: আর সেই ধারণার সেবক হলাম আমরা (পাদরি অ্যান্ড কোং)।

যা সামাজিক অনুভব জাগিয়ে তুলে সংগঠিত করে সেই সব ধ্যানধারণার সাকল্য হলো ঈশ্বর, এটা অসত্য। ওটা হল বগদানভী ভাববাদ যা ধ্যানধারণার বৈষয়িক উদ্ভব সংক্রান্ত সত্যটাকে চাপা দেয়। বহিঃ প্রকৃতি আর শ্রেণিগত জোয়াল এই দুইই মানুষকে পাশবিক উপায়ে দমন করে, এই অধীনতা থেকে পয়দা-হওয়া ধ্যানধারণা, যেসব ধ্যানধারণা সেই অধীনতাটাকে সংহত করে, শ্রেণিসংগ্রামকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, সর্বাগ্রে সেগুলোর সাকল্য হলো ঈশ্বর (ইতিহাসে এবং বাস্তব জীবনে)। ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণাটার এমন উদ্ভব এবং এমন সত্যিকারের অর্থ সত্ত্বেও ইতিহাসে একদা গণতন্ত্রের এবং প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম চলত একটা ধর্মীয় ধারণার বিরুদ্ধে অন্য একটার সংগ্রামের আকারে।

কিন্তু সেই সময়টাও দূর অতীতের বস্তু।

ইউরোপে আর রাশিয়ায় উভয়ত আজকাল ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণার যে কোনো, সবচেয়ে মার্জিত এবং সবচেয়ে শুভেচ্ছাপ্রণোদিত সমর্থন কিংবা ন্যায্যতা প্রতিপাদন হলো প্রতিক্রিয়াশীলতার ন্যায্যতা প্রতিপাদন ৷

আপনার গোটা সংজ্ঞার্থটা প্রতিক্রিয়াশীল এবং বুর্জোয়া — সর্বাংশে। ঈশ্বর = যেসব ধ্যানধারণা ‘জাগিয়ে তুলে সংগঠিত করে এমন সামাজিক অনুভব যার লক্ষ্য হলো সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিকে সংযক্ত করা এবং জান্তব ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের রাশ টেনে ধরা’, সেগুলোর সাকল্য।

এটা প্রতিক্রিয়াশীল কেন? কারণটা হলো এই যে, পাদরি আর সামন্ত মনিবদের প্রচারিত জান্তবতার ‘রাশ টেনে ধরা’ সংক্রান্ত ধারণাটাকে এতে কৃত্রিম রঙে ছোপানো হয়। আসলে ‘জান্তব ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে’র রাশ টেনে ধরেছিল ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণা নয়, সেই রাশ টেনেছিল আদিম যূথ এবং আদিম লোকসমাজ উভয়েই। ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণা বরাবর ‘সামাজিক অনুভব’কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে, ভোঁতা করে দিয়েছে সেটাকে; বরাবর দাসত্ব (সবচেয়ে নিকৃষ্ট, হতাশাময় দাসত্ব) সংক্রান্ত ধারণা হিসেবে সেটা জীবিতের জায়গায় এনেছে মৃতকে। ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণাটা ‘সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিকে সংযুক্ত’ করে নি কখনও: উৎপীড়কদের দেবত্বের প্রতি বিশ্বাসের সঙ্গে উৎপীড়িত শ্রেণিগুলিকে অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে বরাবর ।

সাহিত্য প্রসঙ্গে একটি আলোচনা শুনুন

আপনার সংজ্ঞার্থটা বুর্জোয়া (বিজ্ঞানসম্মত নয়, ইতিহাসভিত্তিক নয়), তার কারণ সেটার ক্রিয়া ঘটে ঢালাও সাধারণ নিয়ে, সাধারণভাবে ‘রবিনসন ক্রুসো’-ধাঁচের ধারণা নিয়ে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট ইতিহাসক্রমিক যুগে বিভিন্ন নির্দিষ্ট শ্রেণি নিয়ে নয়।

জিরিয়ানিন অসভ্য, ইত্যাদির (আধা-অসভ্যরা সমেত) মধ্যে ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণা এক জিনিস। স্ত্রুভে অ্যান্ড কোং-এর বেলায় সেটা একেবারেই ভিন্ন ব্যাপার। উভয় ক্ষেত্রে এই ধারণাটাকে সমর্থন করে শ্রেণিগত আধিপত্য (আর এই ধারণাটা সমর্থন করে সেটাকে)। ঈশ্বর আর ঐশী সংক্রান্ত ‘জনসাধারণ্যের’ ধারণা হলো ‘জনসাধারণ্যের’ অজ্ঞতা, হীনতা, তমস, ঠিক যেমন জার, শয়তান আর চুল ধরে বৌকে টানা সংক্রান্ত ‘জনসাধারণ্যের ধারণা’। ঈশ্বর সংক্রান্ত ‘জনসাধারণ্যের ধারণা’টাকে আপনি ‘গণতান্ত্রিক’ বলছেন কেমন করে তা আমি বুঝতে পারছি নে একেবারেই।

দার্শনিক ভাববাদের ‘বিবেচনায় থাকে সর্বদাই শুধু ব্যক্তির স্বার্থ’, এটা ঠিক নয়। ব্যক্তির স্বার্থ কি গাসেন্দি[৮]-র চেয়ে দেকার্ত[৯]-এর মনে ছিল বেশি পরিমাণে? কিংবা ফয়েরবাখ[১০]-এর সঙ্গে তুলনায় ফিখটে[১১] আর হেগেল[১২]-এর ?

‘ঈশ্বর-গড়াটা হলো ব্যক্তির মাঝে আর সমাজে বিভিন্ন সামাজিক উপাদানের অধিকতর বিকাশ আর সমাহারের প্রক্রিয়া’ — এটা স্রেফ ভয়াবহ!! রাশিয়ায় স্বাধীনতা থাকলে এমনসব জিনিসের জন্যে, নিছক বুর্জোয়া ধরন আর প্রকৃতির এমন সমাজবিদ্যা আর ঈশ্বরতত্ত্বের জন্যে গোটা বুর্জোয়াকুল আপনাকে প্রশংসা করে আকাশে তুলত।

আচ্ছা এখনকার মতো এটাই যথেষ্ট: এমনিতেই চিঠিখানা খুবই লম্বা। আবার আপনার করমর্দন করে আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

ভবদীয় ভ. ই.

লেখা হয় ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসের দ্বিতীয়ার্ধে। পাঠান হয় ক্রাকোভ থেকে ক্যাপ্রিতে

আরো পড়ুন

টিকা

১. চিঠিখানার শুরুটা পাওয়া যায় নি। — সম্পাদক
২. বাম সুবিধাবাদের মতাবস্থানে চলে গিয়েছিলেন প্রাক্তন বলশেভিক বগদানভ আর আলেক্সিনস্কি, তাঁরা ১৯০৯ সালে গড়েছিলেন ‘ভপেরিওদ’ গ্রুপ। এই গ্রুপের মধ্যে ছিল ‘অৎজোভিস্ত’-রা (রুশ ‘অতোজভাৎ’ মানে ‘প্রত্যাহ্বান’), এরা বৈধ সংগঠনে পার্টি কাজের বিরোধিতা করে দুমা থেকে সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক ডেপুটিদের প্রত্যাহ্বান করার দাবি করেছিল; এই গ্রুপে ছিল ঈশ্বর-গঠনকারীরাও (ম্যাক্সিম গোর্কির কাছে লিখিত পূর্বের চিঠির ৪ নং টীকা দ্রষ্টব্য)। রাশিয়ার শ্রমিকদের মধ্যে ‘ভপেরিওদ’ গ্রুপের কোনো সমর্থক ছিল না, গ্রুপটা লোপ পেয়ে গিয়েছিল ১৯১৩ সাল নাগাদ।
৩. বগদানভ, (মালিনোভস্কি), আলেক্সান্দর আলেক্সান্দ্রভিচ (১৮৭৩-১৯২৮) — রুশ সোশ্যাল-ডেমোক্রাট, ভাববাদী দার্শনিক; ১৯০৫-১৯০৭ সালের বিপ্লবের পরে অৎজোভিস্ত।
৪. লুনাচারস্কি, আনাতোলি ভাসিলিয়েভিচ – রুশী পণ্ডিত ব্যক্তি, সোশ্যাল-ডেমোক্রাট। রাশিয়ার সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পরে বলশেভিক। ১৯০৫-১৯০৭ সালের বিপ্লবের পরাজয়ের পরে পার্টি-বিরোধী ‘ভপেরিওদ’ গ্রুপে শামিল হন, ঈশ্বর-গড়ার প্রচার চালান। অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে শিক্ষা জন-কমিসার।
৫. পুরিশকেভিচ, ভ্লাদিমির মিত্রফানভিচ (১৮৭০-১৯২০) — মস্ত ভূস্বামী, উন্মত্ত প্রতিক্রিয়াশীল, রাজতন্ত্রী।
৬. নিকোলাই, দ্বিতীয় (১৮৬৮-১৯১৮) — রাশিয়ার শেষ সম্রাট (১৮৯৪-১৯১৭)।
৭. স্ত্রুভে, পিওতর বের্নগার্দভিচ, (১৮৭০-১৯৪৪) — উনিশ শতকের শেষ দশকে ‘বৈধ মারক্সবাদ’-এর অগ্রণী প্রবক্তা; পরে কাদেতী পার্টির অন্যতম নেতা; অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লবী দেশান্তরী।
৮. গাসেন্দি, পিয়ের (১৫৯২-১৬৫৫) — ফরাসি বস্তুবাদী দার্শনিক, পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবেত্তা।
৯. দেকার্ত, রেনে (১৫৯৬-১৬৫০) — ফরাসি দ্বৈতবাদী দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, নিসর্গবেদী।
১০. ফয়েরবাখ, ল্যুডভিগ (১৮০৪-১৮৭২) – প্রাক-মার্কসীয় কালের শ্রেষ্ঠতম জার্মান বস্তুবাদী দার্শনিক।
১১. ফিখটে, ইয়োহান গটলিব (১৭৬২-১৮১৪) — জার্মান দার্শনিক, আত্মগতভাবে ভাববাদী।
১২. হেগেল, গেওর্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ (১৭৭০-১৮৩১) — মহান জার্মান ভাববাদী দার্শনিক, ভাববাদী দ্বন্দ্ববাদ গড়ে তোলেন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!