স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মিলের ধারণা হচ্ছে কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা সমস্যার সমাধান

স্বাধীনতা বা আজাদী প্রসঙ্গে (ইংরেজি: Liberty) জন স্টুয়ার্ট মিলের ধারণা হচ্ছে কর্তৃত্ব এবং স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্কের সমস্যার সমাধান নির্ধারণ করা। মিলের স্বাধীনতা সংক্রান্ত ভাবনার পরিপূরক হিসাবে স্বাধীনতা সম্পর্কে (ইংরেজি: On Liberty) গ্রন্থের রচনা হয়। তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন, যাকে তিনি উচ্চতর আনন্দকে পূর্বশর্ত হিসাবে বিবেচনা করেন — যেটি উপযোগবাদ তত্ত্বের গণমঙ্গল বা সর্বহিতের দিক।

স্বাধীনতা সম্পর্কে মিলের বক্তব্য গড়ে উঠেছে পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক তাত্ত্বিকদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষত ফরাসী বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সের ঘটনাবলী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা ও ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রকৃতি পর্যালোচনার মাধ্যমে। মিলের মতে ব্যক্তি যেহেতু সমাজ বিচ্ছিন্ন জীব নয় সেই কারণে সমাজ নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা গড়ে উঠতে পারে না। গণতন্ত্রকেও তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবজ বলে মনে করেননি। গণতন্ত্রের নামে যে গণসমাজ গড়ে উঠে তা যদি রাজনীতি সচেতন না হয়ে অজ্ঞ, দরিদ্র, মাদকাসক্ত হয় তাহলে সংখ্যা গরিষ্ঠের শাসন ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খর্ব করে।

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে রাজনৈতিক ঘটনাবলী ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্পর্কে মিলকে শঙ্কিত করে তোলে। ইংল্যান্ডের ১৬৮৮ সালে গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ রাজতন্ত্র গড়ে উঠে এবং পার্লমেন্ট প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ক্রমশ গণতন্ত্রের প্রসার ঘটতে থাকে যদিও জনগণের প্রতিনিধিত্ব ছিল নিয়ন্ত্রিত। ফ্রান্সের ১৭৮৯ সালে বিপ্লব স্বাধীনতা ও সাম্যের লক্ষ্যে পরিচালিত হলেও বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সে ব্যক্তির স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়নি।

গণতন্ত্রের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্র ব্য অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে নিরাপদ নয় বলে মিল মনে করতেন। মিলের ব্যক্তি যেহেতু সৃজনশীল এবং যুক্তিবোধ সম্পন্ন সেইজন্য সৃজনশীলতাকে রুদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের বাঞ্ছনীয় নয়। ব্যক্তির নতুন চিন্তাভাবনা করার সুযোগ না থাকলে অস্তিত্ত্বের সংকট দেখা দিবে, তাই ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে ভাবনা ও কাজের সুবিধার পরিবেশ দেওয়া।

ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মিল

জন স্টুয়ার্ট মিল ছিলেন গণতন্ত্র এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার আপসহীন সমর্থক। তাঁর মতে ব্যক্তিমাত্রেরই চিন্তার স্বাধীনতা এবং তা প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত। সংখ্যা কিংবা শক্তির আধিক্য ব্যক্তির এই মৌলিক স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করতে পারে না। সেরূপ করার কোনো অধিকার কারোর নেই। ব্যক্তি স্বাধীনতার অলঙ্ঘনীয়তার উপর জোর দিতে গিয়ে মিল বলেছিলেন,

“এমন যদি হয় যে, সমগ্র মানবজাতি একদিকে এবং একটিমাত্র ব্যক্তি বিপরীত দিকে, সমগ্র মানবজাতি একটি মতের পোষক এবং একটিমাত্র ব্যক্তি ভিন্নমতের পোষক, তা হলেও আমি বলব, ঐ একটি মাত্র ব্যক্তির বিরোধী মতকে দমন করার অধিকার সমগ্র মানবজাতির নেই। যেমন নেই ঐ একটিমাত্র ব্যক্তির (যদি তার সে ক্ষমতা থাকে) মানব জাতির মতকে দমন করার।”[২]

ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মিল বলেন ব্যক্তি স্বাধীনতা যেহেতু সমাজ নিরপেক্ষ নয় এবং অন্য ব্যক্তির স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই এই দুটি দিককেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত: নিজস্ব ক্ষেত্রে (Self Regarding Aspect) প্রতিটি ব্যক্তি স্বাধীন এবং রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত অপর ক্ষেত্রে (Outer Regarding Aspect) ব্যক্তির কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করা যেতেও পারে যাতে তা অন্য কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে বা অন্য কারও স্বাধীনতার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কোনো ব্যক্তি যদি বাড়িতে ধূমপান বা কবিতা পাঠ করে সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি স্বাধীন এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই তা করতে পারে। কিন্তু সেই ব্যক্তি যখন গাড়ি চালায় তখন তাকে রাস্তায় নিয়মবিধি মেনে চলতে হয়, যাতে অন্যের চলাচলে বিঘ্ন না ঘটে।

নারী স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মিল 

১৮৬৯ সালে প্রকাশিত The Subjection of Women গ্রন্থটি ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত On Liberty বা স্বাধীনতা প্রসঙ্গে গ্রন্থের পরিপূরক বলা যেতে পারে। এই গ্রন্থে মিল রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পুরুষদের অধিকারের বিরোধিতা করেছেন এবং নারীদের এতে সমান অধিকার আছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। এই গ্রন্থে শুধুমাত্র নারী পুরুষের বৈষম্যের বিষয়টি আলোচনা করেননি, পরিবার বিবাহ ব্যবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলেন, যে কারণে The Subjection of Women গ্রন্থটি নারীবাদী আন্দোলনে এক স্মরণীয় গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। 

মিলের লক্ষ্য হলো এক পক্ষের ক্ষমতা সুযোগ সুবিধা এবং অন্য পক্ষের ক্ষতি বা বঞ্চনার পরিবর্তে নারী-পুরুষ সম্পর্কের পরিবর্তন করে যথার্থ সমতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত করা। মিলের সময় নারীর কোনো সম্পত্তির অধিকার ছিল না, স্বামী কর্তৃক দৈহিক বা যৌন নির্যাতন থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় ছিল না। এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদ ও সন্তানের উপর অধিকার ছিল না। নারী বিশেষত বিবাহিত মহিলাদের তিনি ক্রীতদাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পারিবারিক জীবনে নারীর অবস্থা ক্রীতদাস স্বরূপ–স্বামীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই কারণে তিনি বিবাহ ব্যবস্থাকে ক্রীতদাস ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রকৃত সাম্য ও বন্ধুত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে চান, বিবাহ বিচ্ছেদকে সমর্থন করেন, নারীর অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদানকে নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে ব্যাখ্যা করেন।

মিলের মতে নারীর এই অবস্থা প্রাকৃতিক কারণে নয়, কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট। এক্ষেত্রে তিনি নারীর অবস্থাকে সেই গাছের সঙ্গে তুলনা করেছেন যে গাছটি প্রখর তাপে দূষিত হয়ে পড়ছে। নারীর বর্তমান অবস্থাও তার স্বাভাবিক প্রকৃতি নয়–সামাজিক তাপে, পুরুষ শাসিত সমাজ ও সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণে তা বিকৃতভাবে সৃষ্ট। মিলের স্বাধীনতার অন্যতম বক্তব্য হলো প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণগুলির স্বাভাবিক বিকাশ ঘটানো, অথচ নারীর ক্ষেত্রে এই বিকাশ সামাজিক সাংস্কৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত। নারী প্রকৃতি নিয়ে সমসাময়িক তাত্ত্বিকদের বক্তব্যকে মিল নীতিবাচক, অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করেন।

মিলের কাছে লিঙ্গ নয়, মেধাই হচ্ছে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রকৃত দাবিদার। নারীকে বঞ্চনার ফলে সমগ্র মানব সমাজ নারীর তথা অর্ধেক মানুষের মেধা সম্পদ থেকে বঞ্চিত। তাছাড়া শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত নারীরা নিজেদের মর্যাদা লাভে স্বামীর উপর চাপ তৈরি করে এবং স্বামীর প্রতি এক শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করে। পরিবর্তে মিল চান, পুরুষ ও নারীর মধ্যে এক ধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক যা বিবাহের মধ্য দিয়ে সম্ভবপর হতে পারে যদি নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রকৃত সাম্য বজায় থাকে। সমমর্যাদা সম্পন্ন নারী ও পুরুষ যদি শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে একই ধরনের সুযোগ পায়, যারা নিজেদের দায়-দায়িত্ব-দায়িত্ববান হয়, তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে বিবাহিত জীবন সুখের হয় আর যেখানে বিবাহ নারীকে পুরুষের তুলনায় অধস্তন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে সেখানে বিবাহ উভয়ের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

তথ্যসূত্র

১. গোবিন্দ নস্কর, Political thought, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ২৭-২৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!