কেন ফ্যাসিবাদ জয়লাভ করতে পেরেছিল এবং কি ভাবে?
ফ্যাসিবাদ হলো শ্রমিক শ্রেণি এবং মেহনতী জনতার সবচেয়ে ক্ষতিকর শক্র। জার্মান জনগণের ১০ ভাগের ৯ ভাগ, অস্ট্রিয়ান জনগণের ১০ ভাগের ৯ ভাগ এবং অন্যান্য ফ্যাসিস্ট দেশের জনগণের ১০ ভাগের ৯ ভাগ লোকের শত্রু হলো ফ্যাসিবাদ। তাহলে কি ভাবে, কি করে, এই ভয়ঙ্কর শত্রু জয়লাভ করলো?
ফ্যাসিবাদ যে ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল তার প্রাথমিক কারণ হলো, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক নেতাদের বুর্জোয়াদের সঙ্গে শ্রেণি-সহযোগিতার নীতির দরুন শ্রমিক শ্রেণি বুর্জোয়া আক্রমণের মুখে বিভক্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে নিরস্ত্র প্রমাণিত হয়। আবার অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টিগুলিও এত শক্তিশালী ছিল না, যাতে তারা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বাদ দিয়ে অথবা তাদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও জনগণকে জাগাতে পারে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাদের একটি চূড়ান্ত সংগ্রামে নেতৃত্ব নিতে পারে।
আর বাস্তবিকই কমিউনিস্ট ভাইদের সঙ্গে যারা এখন ফ্যাসিস্ট বর্বরতার বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করছে, সেই লক্ষ লক্ষ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট কর্মীদের এখন গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। ১৯১৮ সালে যখন জার্মানি ও অস্ট্রিয়াতে বিপ্লব হয় তখন অস্ট্রিয়ান ও জার্মান সর্বহারা শ্রেণি যদি অস্ট্রিয়াতে অটো বাউআর, ফ্রিডরিশ অ্যাডলার ও কার্ল রেনে, আর জার্মানিতে এবার্ট ও সাইদেমান, এই সব সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের নেতৃত্ব না মেনে রাশিয়ান বলশেভিকদের পথ, লেনিন ও স্ট্যালিনের পথ অনুসরণ করতো, তাহলে অস্ট্রিয়া বা জার্মানি, ইতালী অথবা হাঙ্গেরী, পোল্যাণ্ড বা বলকান অঞ্চলে এখন ফ্যাসিবাদ থাকতো না। বুর্জোয়ারা নয় বরং শ্রমিক শ্রেণি বহুকাল আগেই ইউরোপীয় রাজনীতির কর্ণধার হতে পারতো। … …
এইভাবে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা শ্রমিক শ্রেণির বাহিনীকে অসংগঠিত ও খণ্ড বিখণ্ড করে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও স্পেনে ফ্যাসিবাদের ক্ষতমালাভের পথ পরিষ্কার করেছে।
কমরেডগণ, ফ্যাসিবাদ জয়ী হয়েছে আরো এই জন্য যে, সর্বহারারা তাদের স্বাভাবিক মিত্রদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদ জয়ী হয়েহে কৃষকদের একটি বড় অংশকে দলে টানতে পেরেছে বলে, কারণ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা শ্রমিক শ্রেণির নামে যে নীতি অনুসরণ করেছে, তা হলো কৃষকবিরোধী নীতি। কৃষক অনেকগুলি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দেখেছে, সে সবগুলিই তার চোখে শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতার প্রতিরূপ, কিন্তু তাদের কেউই কৃষকের অভাব দূর করার চেষ্টা করেনি, কেউই কৃষকদের জমি দেয়নি। জার্মানিতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা জমিদারদের স্পর্শ করেনি। তারা কৃষি-শ্রমিকদের ধর্মঘটের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, ফলে হিটলারের ক্ষমতায় আসার অনেক আগেই জার্মানিতে কৃষিশ্রমিকরা সংস্কারপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি ছেড়ে দিতে আরম্ভ করে, এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা স্টলহেলম্ ও ন্যাশনাল সোশ্যালিস্টদের দলে যেতে শুরু করেছে।
ফ্যাসিবাদ জয়লাভ করেছে আরো এই জন্য যে, সে তরুণদের মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছে, যেখানে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা শ্রমিক শ্রেণির যুবশক্তিকে শ্রেণিসংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে; আর বিপ্লবী সর্বহারারা তরুণদের মধ্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানের কাজ করে উঠতে পারেনি, এবং তাদের বিশেষ স্বার্থ এবং দাবির সংগ্রামের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি। ফ্যাসিবাদ তরুণদের সংগ্রামী কাজকর্মের তীব্র প্রয়োজন বুঝতে পেরেছে এবং তাদের একটি বড় অংশকে তার জঙ্গী বাহিনীতে আকর্ষণ করে নিয়ে গেছে। নতুন যুগের তরুণ-তরুণীরা যুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেনি। অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্র ভেঙ্গে পড়ার পুরো চাপটা তারা অনুভব করেছে। কিন্তু ভবিষ্যতের কোনো রকম সম্ভাবনা দেখে অসংখ্য তরুণ; বিশেষ ভাবে ফাঁকা ফ্যাসিস্ট বক্তৃতা গ্রহণ করেছে, কারণ ফ্যাসিবাদ তাদের মনে এক লোভনীয় ভবিষ্যতের মোহ জাগাতে পেরেছে।
এই প্রসঙ্গে আমরা কমিউনিস্ট পার্টিগুলি যে অনেক ভুল করেছে তা এড়িয়ে যেতে পারি না, যে সব ভুল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
আমাদের দলের মধ্যে এমন অনেক লোক ছিলেন, যারা ফ্যাসিস্ট বিপদকে অসহনীয় রকমে ছোট করে দেখেছেন, এবং এই প্রবণতা আজ পর্যন্ত সর্বত্র দুর হয়নি। এই ধরণের মতামত আগে আমাদের পার্টির মধ্যে ছিল যে, ‘জার্মানি ইতালি নয়’, অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ ইতালীতে সফল হতে পারে, কিন্তু জার্মানিতে তার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না, কারণ জার্মানি শিল্প ও সংস্কৃতির দিক থেকে অত্যন্ত উন্নত দেশ, এখানে ৪০ বছরের শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহ্য আছে, এবং এখানে ফ্যাসিবাদ অসম্ভব! অথবা এই ধরণের মত যা এখন দেখ যায়, অর্থাৎ ‘চিরায়ত’ বুর্জোয়া গণতন্ত্রী দেশগুলিতে ফ্যাসিবাদের কোনো জমি নেই। এই ধরণের মতামত ফ্যাসিষ্ট বিপদের বিরুদ্ধে সতর্ক প্রহরাকে দুর্বল করে দেয়, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সর্বহারার সমাবেশকে অনেক কঠিন করে দেয়, এবং তাই দিয়েছে।
এরকম অনেক উদাহরণের উল্লেখ করা যেতে পারে যেখানে কমিউনিস্টরা ফ্যাসিস্টদের চকিতে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে একেবারে সচেতন ছিল না। … …
আরো পড়ুন
- যুক্তফ্রন্ট ও যুবসমাজ
- ট্রেড ইউনিয়ন ঐক্যের জন্য সংগ্রাম
- ময়মনসিংহে সাম্প্রতিক বর্ণবাদচর্চা
- ফ্যাসিবাদ-বিরোধী গণফ্রন্ট
- যুক্তফ্রন্টের সারবস্তু ও রূপ
- যুক্তফ্রন্ট-বিরোধীদের প্রধান যুক্তি
- যুক্তফ্রন্টের গুরুত্ব
- ফ্যাসিবাদ একটি হিংস্র কিন্তু অস্থিতিশীল শক্তি
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উৎস ও চরিত্র
- ফ্যাসিবাদের জয় কি অনিবার্য?
- বিজয়ী ফ্যাসিবাদ জনগণের জন্য কী বহন করে আনে?
- ফ্যাসিবাদের শ্রেণি চরিত্র
- সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদী চিন্তা হচ্ছে আগ্রাসনবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী
- সুভাষচন্দ্র বসুর রাষ্ট্রচিন্তা হচ্ছে স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ও জাতীয় মুক্তি
অনেকগুলি দেশে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণসংগ্রামের যে প্রয়োজনীয় অগ্রগতি, তার জায়গায় দেখা গেছে সাধারণভাবে ফ্যাসিবাদের চরিত্র সম্বন্ধে বন্ধ্যা চুলচেরা বিচার, এবং পার্টির সত্যিকার রাজনৈতিক সমস্যাগুলি উপস্থাপনা এবং সমাধানে সংকীর্ণ দলীয় মনোভাব।
কমরেডগণ, আমরা যে ফ্যাসিবাদের জয়লাভের কারণ আলোচনা করছি, শ্রমিক শ্রেণির পরাজয়ের জন্য সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব নির্দেশ করছি এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের নিজেদের ক্রটিও নির্দেশ করছি, তার কারণ এই নয় যে, আমরা অতীতকে খুড়ে বার করতে চাই। আমরা জীবন্ত বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন ইতিহাসবিদ নই; আমরা, শ্রমিক শ্রেণির প্রত্যক্ষ যোদ্ধারা, লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে যে প্রশ্ন জর্জরিত করছে তার উত্তর দিতে বাধ্য: ফ্যাসিবাদের জয় কি রোধ করা যাবে, এবং কী ভাবে যাবে? আর আমরা এই লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে উত্তর দিচ্ছি: হ্যাঁ, কমরেডগণ, ফ্যাসিবাদের আসার পথকে রুদ্ধ করা যাবে। এটা যথেষ্ট সম্ভব। এটা নির্ভর করছে আমাদের উপর-শ্রমিক, কৃষক এবং সমস্ত মেহনতী জনতার উপর! এইগুলিই হলো ফ্যাসিবাদের অগ্রযাত্রা এবং তার ক্ষমতা দখল রোধ করার প্রধান শর্ত।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।