বুদ্ধিজীবী সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা নির্মাণে নিযুক্ত ব্যক্তি

বুদ্ধিজীবী বা মনীষা (ইংরেজি: Intellectual) হচ্ছেন এমন ব্যক্তি যিনি সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং পড়া, গবেষণা এবং সমাজ সম্পর্কে মানুষের আত্ম-প্রতিবিম্ব নির্মাণে নিযুক্ত।[১] কোনো নীতিগত প্রস্তাবকে রক্ষা বা সমর্থন করার জন্য অথবা কোনো অন্যায়কে অবসানের জন্য বুদ্ধিজীবীরা সৃজনশীল স্রষ্টা বা মধ্যস্ততাকারী হিসেবে সংস্কৃতির জগৎ থেকে এসে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।[২]

আবেগের দিক থেকে বুদ্ধিজীবি শব্দ দ্বারা চিন্তাশীল, এমনকি বিবেকবান, প্রগতিশীল একটি মহলকে বুঝান হয়। বাংলাদেশের সামাজিক রাজনীতির ইতিহাসের পটভূমিতে শিক্ষিত মহলে ‘বুদ্ধিজীবি’ কথাটি যেমন প্রভূত পরিমাণে ব্যবহৃত হয় তেমনি তার আবেগগত অর্থও বিদ্যমান। কথাটির এরূপ প্রচলন বিশেষভাবে ঘটেছে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নানা মর্মান্তিক ঘটনা থেকে। যদিও অন্যান্য দেশেও বুদ্ধিজীবি বলতে তেমন কোনো আবেগের সঞ্চার ঘটে না।[৩]

বুদ্ধিজীবীরা মতাদর্শগত রাজনৈতিক বিবিধ কাজগুলো করে থাকেন কোনো মতাদর্শকে প্রত্যাখ্যান, সৃষ্টি বা সম্প্রসারণের মাধ্যমে অথবা কোনো একটি মূল্যবোধের ব্যবস্থাকে রক্ষা কিংবা প্রতিরোধ করার মাধ্যমে।[২] শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষে লেখা হয়েছে “বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জাতির বিবেক, জাগিয়ে রাখেন তাদের রচনাবলীর মাধ্যমে, সাংবাদিকদের কলমের মাধ্যমে, গানের সুরে, শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা, প্রকৌশল, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে।”[৫]

ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও নিহিতার্থ

ব্যুৎপত্তিগতভাবে ইংরেজি ‘ইনটেলেকচুয়াল’র বাংলা অনুবাদ হিসাবে ‘বুদ্ধিজীবি’র এমন অর্থ প্রধান অর্থ নয়। ‘বুদ্ধি’ থেকে ‘বুদ্ধিজীবি’ শব্দটি তৈরি হয়েছে। অবশ্য অন্যান্য দেশেও এ শব্দের কিছু বিশেষ অনুষঙ্গ দেখা যায়। আবার ‘জীবি’ দ্বারা যদি জীবিকা বুঝায়, তাহলে আমাদের দেশেও কেবল বুদ্ধি দ্বারা কেউ জীবিকা নির্বাহ করে না। জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পেশা এবং এই পেশাগত সম্প্রদায় বা শ্রেণি আছে। তথাপি এই শব্দটির একটি সাধারণ প্রচলন আছে এবং বিশেষ করে আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবি বলতে কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রভৃতিকে বুঝানো হয়। আমাদের দেশের ইতিহাসের পটভূমিতে শব্দটি আবেগের দিক বাদ দিলে ‘বুদ্ধিজীবি’ কথাটি অনির্দিষ্ট কথা।

ইন্টেলেকচুয়াল বা বুদ্ধিজীবির আর একটি সহগামী শব্দ হচ্ছে ‘ইন্টেলিজেন্সিয়া’ বা ‘মনীষা’ শব্দ। এই ‘ইন্টেলিজেন্সিয়া’ বা ‘মনীষা’ শব্দ মার্কসবাদী অতিরিক্ত অর্থ ধারণ করে। মাও সেতুং এবং লেনিন মনীষীদের জনমত তৈরির উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ মিলিয়ে মনীষী শব্দটির ব্যুৎপত্তি দেখা দরকার। শুধু তত্ত্বচর্চা অবশ্যই মার্কসবাদসম্মত নয়; তবে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকাকে তত্ত্বচর্চা ও অনুশীলনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

মার্কসবাদী দর্শনে মনীষা

মূল নিবন্ধ: মনীষী সামাজিক শ্রেণিগত ক্রিয়াকলাপ দ্বারা সমাজকে রূপান্তর করেন

মার্কসবাদী দর্শনে উল্লেখ করা হয়, মনীষীদের (ইংরেজি: Intelligentsia) সামাজিক শ্রেণিগত ক্রিয়াকলাপকে হতে হবে সমাজকে রূপান্তরিত করার জন্য প্রগতিশীল ধারণার উৎস হিসেবে। মনীষীদের কাজ হবে রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ এবং পরামর্শ প্রদান; শহুরে শ্রমিক ও কৃষক জনগণের কাছে দেশের রাজনীতির ব্যাখ্যা প্রদান; এবং তাদের নিজস্ব প্রয়োজনীয় পদমর্যাদার নেতাদের সরবরাহ করা।

বুদ্ধিজীবীরা কি অনেক বড় অথবা বেশ ছোট বিশেষ গোষ্ঠীর বা জন পরিমণ্ডলের অন্তর্গত? এ বিষয়ে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিশ শতকে দুটো পরস্পরবিরোধী মতামতের কথা উল্লেখ করেছেন এডোয়ার্ড সাইদ। ইতালিয়ান মার্কসবাদী, একনিষ্ঠ কর্মী, সাংবাদিক ও মেধাবী রাজনৈতিক এবং দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামসির বক্তব্য এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইতালিয়ান সাম্যবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি (১৮৯১- ১৯৩৭) জন পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে কার্ল মার্কসের মনীষা সংক্রান্ত ধারণাটি তৈরি করেছিলেন।

১৯২৬-১৯৩৭ সময়কালে গ্রামসি মুসোলিনির কারণে কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি প্রিজন নোটবুকস-এ লেখেন, সব মানুষই বুদ্ধিজীবী একথা প্রত্যেকেই বলতে পারে কিন্তু সমাজে সব মানুষ বুদ্ধিজীবীর কাজ করে না। গ্রামসি তার নিজের জীবনে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন প্রশিক্ষিত ভাষাবিজ্ঞানী। তিনি ছিলেন একাধারে ইতালীয় শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের সংগঠক এবং সাংবাদিকতা-জীবনে দক্ষ সমাজ-বিশ্লেষকদের একজন। তার লক্ষ্য শুধু সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাই নয়, ঐ আন্দোলনের সাথে যুক্ত পুরো সংস্কৃতি ও সংগঠনও নির্মাণ করা।[৬]

বুদ্ধিজীবী হত্যা

সর্বগ্রাসী সরকার রাজনৈতিক ভিন্নমতকে দমন করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধীতাকে কাজে লাগায় এবং প্রয়োগ করে। স্পেনের গৃহযুদ্ধে (১৯৩৬-১৯৩৯) বর্বর জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর পরবর্তী একনায়কত্বের (১৯৩৯-১৯৭৫) সময়, সাদা সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়াশীল দমন কালীন (১৯৩৬-১৯৪৫) সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল, যার মধ্যে বেশিরভাগ ২০০,০০০ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিল। পদচ্যুত দ্বিতীয় স্প্যানিশ প্রজাতন্ত্রের (১৯৩১-১৯৩৯) সময়ে স্পেনের বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদ, শিল্পী এবং লেখককে হত্যা করা হয়। নাৎসি জার্মানি ও ইতালির শাসক, ইয়ং তুর্কি এবং বাংলাদেশে, সাবেক যুগোস্লাভিয়া এবং পোল্যান্ডের সংঘাতে এবং রোমানিয়ায় বুদ্ধিজীবীদেরও লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করা হয়েছিল।

একটি নৃত্য দেখুন

বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা

বাংলাদেশের সামাজিক রাজনীতির ইতিহাসের পটভূমিতে শিক্ষিত মহলে ‘বুদ্ধিজীবি’ কথাটি বেশ পরিমাণে ব্যবহৃত হয় তেমনি তার আবেগগত অর্থও বিদ্যমান। কথাটির এরূপ প্রচলন বিশেষভাবে ঘটেছে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিভিন্ন মর্মান্তিক ঘটনা থেকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যে গণহত্যা শুরু করে তাকে এবং পরবর্তীতে যুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এবং তাদের এদেশীয় অনুচরদের হাতে ঢাকা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা ও শহরের অগণিত চিকিৎসক, শিক্ষক, ছাত্র, কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক নির্মমভাবে নিহত হন। এরা শহীদ বুদ্ধিজীবি বলে শ্রদ্ধার সাথে স্মৃত হন এবং আমাদের অনুপ্রেরণা দান করেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রাথমিক মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষকদের শিক্ষাবিদ হিসেবে এবং অন্যান্য পেশার যেমন সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী ছাড়াও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলীদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে মূল্যায়িত করে যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা গণনা করা হয়েছে তাতে মোট বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন ১১১১ জন। এসব বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশকেই ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের এই তালিকায় ২৪ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রয়েছেন।[৭]

বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান আমাদের জানাবেন যে, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনষ্ক বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত’ করবে তার মূল কারণটি এখানে যে তারা গণতন্ত্র চেয়েছিল। গণতন্ত্র কীভাবে আসবে সেই প্রশ্ন যদি করা হয় তাহলে দেখব যে স্কুল কলেজের শিক্ষক সমাজবিজ্ঞানের শত শত বিষয়কে অবিরাম ব্যাখ্যা করে চলেছেন। আলোচনায়, জনসভায়, আড্ডায়, কথোপকথনে, পুস্তিকায় লিফলেটে চিঠিপত্রে যে ব্যাখ্যা আমরা পাই তা এই জনপরিমণ্ডলে চালিত বিতর্ক ও জনমত তৈরির ফল। বুদ্ধিজীবীদের উপরে আক্রোশ তাই গণতন্ত্রবিরোধীদের অনেক পুরোনো।

১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া ব্যক্তিত্ব জহির রায়হান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। গোবিন্দ চন্দ্র দেব ব্যাখ্যা করেছিলেন দর্শনের জগতটিকে, যেমন তাঁর একটি বইয়ের নাম ছিলো আমার জীবন দর্শন (১৯৬০)। শহীদুল্লা কায়সার (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৭ – ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) ছিলেন একজন সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। তাঁর উপন্যাসগুলো কিন্তু সারেং এবং নদীর জীবনের কথাই বলে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভূমিকা বাংলা ভাষা রক্ষায়। আবার মোফাজ্জল হায় দার চৌধুরী রবি পরিক্রমা নামে বই লিখেন যা পাকিস্তানীদের খেপিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো।

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র:

১. The New Fontana dictionary of Modern Thought. Third Ed. A. Bullock & S. Trombley, Eds. (1999) p. 433.
২. Pascal Ory and Jean-François Sirinelli, Les Intellectuels en France. De l’affaire Dreyfus à nos jours (The Intellectuals in France: From the Dreyfus Affair to Our Days), Paris: Armand Colin, 2002, p. 10.
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৩২। ৪. Ibid, Pascal Ory and Jean-François Sirinelli,
৫. আলী মো. আবু নাঈম ও ফাহিমা কানিজ লাভা, শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ, আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০১৯, পৃষ্ঠা ১৩
৬. এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদ, রিপ্রেজেন্টেসনস অব দ্য ইন্টেলেকচুয়াল, দেবাশীষ কুমার কুন্ডু অনূদিত এবং ড. মাহবুবা নাসরীন সম্পাদিত, সংবেদ ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ২০-২১
৭. Khan, Muazzam Hussain (২০১২)। “Killing of Intellectuals”। Islam, Sirajul; Jamal, Ahmed A.। Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh (Second ed.)। Asiatic Society of Bangladesh।

রচনাকাল ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!